শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বেচাকেনা কিছুটা বাড়লেও পশুর হাট এখনো জমেনি

নূর মোহাম্মদ
  ৩১ জুলাই ২০২০, ০০:০০
রাজধানীর পশুর হাটগুলোতে ক্রেতাসমাগম বাড়ছে। ছবিটি বৃহস্পতিবার শাহজাহানপুর থেকে তোলা -যাযাদি

ঈদের আর বাকি মাত্র একদিন। কিন্তু এখনো সেভাবে জমে ওঠেনি রাজধানীর পশুর হাটগুলো। অন্য বছর এ সময়ে হাটে উপচে পড়া ভিড় থাকলেও এবার অলস সময় পার করছেন পশু ব্যবসায়ীরা। ক্রেতারা বলছেন, ব্যবসায়ীরা গরুর বাড়তি দাম হাঁকছেন। বিক্রেতারা বলছেন, ক্রেতারা যে দাম বলছেন, সে দামে বিক্রি করলে লোকসানে পড়তে হবে তাদের। দু'পক্ষই অপেক্ষা করতে চান ঈদের আগের রাত পর্যন্ত। গত কয়েকদিনের তুলনায় গতকাল পশু বিক্রি বাড়লে আশানুরূপ নয় বলে জানিয়েছেন ইজারাদার ও ব্যাপারীরা। রাজধানীর কয়েকটি পশুর হাট ঘুরে দেখা গেছে, গতকাল বিকাল পর্যন্ত একটি গরুও বিক্রি করতে পারেননি এমন ব্যাপারী রয়েছেন। তাদের চোখেমুখে লস আর পশু ফিরতি নিয়ে যাওয়ার বাড়তি খরচের দুশ্চিন্তা। ব্যাপারী জানান, শুরু থেকে বেচাবিক্রিতে ধস থাকলেও বৃহস্পতিবার হাটগুলোতে ক্রেতার সমাগম \হবাড়বে এমন আশায় ছিলেন। কিন্তু গতকালও আশানুরূপ বেচাকেনা হয়নি। তবে ঈদের আগের দিন চিত্রটা একটু বদলাতে পারে বলে ধারণা তাদের। এদিকে গরু বিক্রি কম হওয়ায় ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছেন ইজারাদারও। তারা বলছেন, গত কয়েক বছরের তুলনা করলে গতকাল পর্যন্ত প্রায় ৫০ শতাংশ গরু কম বিক্রি হয়েছে। এর পিছনে অন্যতম কারণ- করোনায় অর্থনৈতিক সংকট, স্বাস্থ্য ঝুঁকি এবং গ্রামের বাড়িতে কোরবানি দেওয়া এবং অনলাইনে প্রচুর পশু বিক্রি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনেকেই পরিবার, চাকরি হারিয়ে কিংবা ব্যবসা বন্ধ থাকায় গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করছেন। তাই এবার কোরবানিও বাড়িতে দিচ্ছেন। রাজধানীর কয়েকটি পশুর হাট ঘুরে দেখা গেছে, ঈদের দুদিন আগে হাটগুলোতে উপচে পড়া ভিড় থাকলেও এবার সেটি নেই। অন্যান্য বছর এ সময়ে বাসাবাড়িতে কোরবানির পশু চলে এলেও এবার তা দৃশ্যমান নয়। করোনাভাইরাসের কারণে আগে যারা ২-৩ জন মিলে কোরবানি দিতেন, তাদের অনেকেই কোরবানি দিতে পারবেন না। মিরপুর, মোহাম্মদপুর, লালবাগ, মতিঝিল এলাকাগুলোতে কোরবানি ঈদের তেমন প্রস্তুতি চোখে পড়েনি। এবার ৩০ শতাংশ কোরবানি কম হবে- এমনটা বলছেন স্থানীয় কাউন্সিল ও সংশ্লিষ্টরা। আর্থসামাজিক অবস্থার পাশাপাশি স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির কথা চিন্তা করে অনেকেই কোরবানি দিচ্ছেন না। ছোট-মাঝারিতে চাপ বড় গরুতে ধস রাজধানীর কয়েকটি পশুর হাট ঘুরে দেখা গেছে, বরাবরের মতো বড় গরুর তুলনায় মাঝারি ও ছোট গরুর চাহিদা বেশি। ছোট ও মাঝারি আকৃতির ৪০ থেকে ৭০ হাজার টাকার গরুর চাহিদা বেশি। গরুর ব?্যাপারীরা জানান, গত কয়েকদিন হাটে মাঝারি ও ছোট গরুর ক্রেতা বেশি। গত বছর যে গরু কিনতে ক্রেতাদের দেড় থেকে দুই লাখ টাকা লেগেছে এবার ১ লাখ ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকায় তা পাওয়া যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত বড় গরুগুলো বিক্রি হবে কি না তা নিয়ে চিন্তায় রয়েছে ব্যাপারীরা। কুষ্টিয়া থেকে হাটে এসেছেন শাহজাহান ব?্যাপারী। তিনি বলেন, আমি এবার ৫টি গরু নিয়ে হাটে এসেছি। এর মধ্যে ৪টি ছোট আর একটি বড় গরু। এখন এই বড় গরুটা নিয়েই মনে হচ্ছে বিপদে পড়তে হবে। ছোট গরুর মধ্যে তিনটি বিক্রি হয়ে গেছে। কিন্তু বড় গরুটি এখনো বিক্রি হয়নি। দেড় লাখ টাকা কি না এ গরুর এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ দাম উঠছে ১ লাখ ৩০ হাজার। শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করব। দেখি কি হয়। ঢাকার উত্তরার বৃন্দাবন হাটে সোয়া ৩ লাখ টাকায় একটি গরু বিক্রি করে ব্যাপারী আবদুর রহিম বলেন, একটা গরুতে ২৫ হাজার টাকা লস খাইলাম। একই হাটে রহিম একটি গরু দাম হেঁকেছিলেন ৫ লাখ টাকা। গত কয়েকদিনে সর্বোচ্চ সোয়া ৩ লাখ টাকা দাম উঠেছে। গরুটা কেনা সাড়ে ৩ লাখ টাকায়। এখন লসে বিক্রি করতে হবে। কী করমু? গরু তো আর ফিরায়া নিতে পারমু না। এইবার সব গরুই প্রায় লস দিয়া বেচন লাগব। ব্যাপারীরা জানান, গরু কিনে দেশের নানা প্রান্ত থেকে ঢাকায় আনেন বিক্রির জন্য। বিক্রি না হলে সেগুলো ফেরত নিতে হলেও ট্রাক ভাড়া যায় অনেক, ফলে লস হলেও বিক্রি করতে হবে। কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থেকে আসা ব্যাপারী কদম আলী ১২টি ষাঁড় নিয়ে এসেছিলেন গাবতলীর হাটে। মঙ্গলবার পর্যন্ত তিনি চারটি বিক্রি করেছেন। দেশি আবাল, দেশি শাহীওয়াল ক্রস- এ তিন ধরনের ৬০টি গরু নিয়ে পোস্তগোলা শ্মশান ঘাটের কোরবানির হাটে এসেছিলেন কুষ্টিয়ার ব্যাপারী মাসুদ রানা। তিনি গতকাল বলেন, বহু জন এসে দাম জিজ্ঞাসা করে চলে গেছে। কিন্তু কেউ কিনতে চায় না। একটা গরুও বিক্রি করতে পারিনি। কী করব আর। গরু মনে হয় ফিরায়ে নিয়ে যাব। একই হাটে কুষ্টিয়ার মোহাম্মদ মহসিন বলেন, ১১টা গরু আনছিলাম। কিন্তু বিক্রি হয়েছে মাত্র ৩টা। লাখের গরু ছাড়তে হইছে ৭০-৮০ টাকায়। পাবনার একটি ফার্মের মালিক শামসুদ্দীন টগর বলেন, ২০০০ সাল থেকে গরুর ব্যবসা করছি। কিন্তু এমন খারাপ অবস্থা আর কখনো আসেনি। ৪-৫ দিন হাটে আসছি, একটা গরুও বিক্রি করতে পারছি না। এবার ব্যবসা পুরোটাই লস বলা চলে। করোনাভাইরাস ধসিয়ে দিল এবারের ব্যবসা। ভাটারার ছোলমাইদ হাটে ২০টি ষাঁড় নিয়ে এসেছিলেন পাবনার আতাইকুলার আর এস আর অ্যাগ্রো ফার্মের খামারি জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেন, আমাদের একেকটা ষাঁড়ের দাম পড়বে দেড় লাখ থেকে ৪ লাখ টাকা। কিন্তু ক্রেতারা যে দাম বলছেন, তাতে আমাদের পোষাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত গরু কিছু বিক্রি করতে পারব, আর কিছু পারব না। ক্ষতির মুখে ইজারাদাররাও হাটে গরু বিক্রি না হওয়ায় এবার কোরবানির হাটের ইজারাদাররাও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কারণ গরু বিক্রি থেকে পাওয়া অর্থের একাংশ থেকে তাদের আয় আসে। উত্তরখানের মৈনারটেক হাটের ইজারাদার পারভেজ মিয়া জানান, এবার সাড়ে ৪ লাখ টাকা ইজারামূল্যসহ নানা ভ্যাট-ট্যাক্সসহ তাকে ১৫-১৬ লাখ টাকা খরচ করতে হয়েছে কোরবানির হাটে। হাটটা তেমন বড় নয়, মোটে ৫০০-৬০০ গরু আসছে। বৃহস্পতিবার বিকাল পর্যন্ত বিক্রি হইছে মাত্র ৩১টা গরু। এবার তো মনে হইতেছে, গজব নামছে। গত হাটে ৫ লাখ টাকা হ্যান্ডক্যাশ লস হইছিল। এবার তো মনে হইতাছে, আরও লস হইবে। কাওলার শিয়ালডাঙ্গা হাটের ইজারাদার রুবেল শওকত বলেন, আমারে ১৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা দেওয়া লাগছে কোরবানির হাটের ইজারার জন্য। এখন গরু বিক্রি না হলে সেই টাকা কেমনে উঠাব? সব মিলায়ে তো মনে হইতাছে, এক কোটি টাকার গরুও বিক্রি হবে না এবারের হাটে। এ ক্ষতি কত বিশাল বোঝানো যাইব না। পূর্বাচলের মাস্তুলের হাটের ইজারাদার মাহমুদুল হাসান অসুস্থ থাকায় হাটের সার্বিক দেখভাল করছেন ৪৩ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শরীফুল ইসলাম ভুঁঞা। তিনি বলেন, ৪০ লাখ টাকা ইজারাসহ ৫১ লাখ টাকা দিতে হয়েছে সিটি করপোরেশনকে। ১ কোটি টাকা লগ্নি আছে এই হাটের পেছনে। কিন্তু সেই টাকার কত পারসেন্ট ওঠাতে পারব জানি না। গরু বিক্রিই তো নাই। কোরবানির হাট ঘুরে অনলাইন হাটে ভিড় করোনার কারণে অনলাইনে প্রথম গরু বিক্রির উদ্যোগে ক্রেতারা প্রথম দিকে আশ্বস্ত না হলেও হাট ঘুরে আসার পর অনেকেই অনলাইন হাটে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। অনেকেই সেখান থেকে গরু কিনেছেন। অনলাইনে গরু বিক্রেতারা বলছেন, অনলাইন হাটগুলোতে গরুর দাম নিয়ে শুরু থেকে অসন্তোষ ছিল ক্রেতাদের। সময়ের ব্যবধানে ক্রেতারা এখন অনলাইনে কেনাকাটার সুবিধা বুঝতে পারছেন। হাটে দালালের দৌরাত্ম্য, স্বাস্থ্যবিধির সমস্যা, বেশির ভাগ সময় ঠকে যাওয়ায় ঘটনা অনলাইনে তুলনামূলক কম। এজন্য শেষ মুহূর্তে অনলাইনে বেচাকেনা বেশ জমেছে। অনেকের ধারণা ছিল, ঢাকার গরুর হাটগুলো শুরু হলে অনলাইনে বেচাকেনা কমে যাবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে সাধারণ হাটের চেয়ে ই-কমার্স শপগুলোতে দাম কম। তাই হাট চালু হওয়ার পর ই-কমার্স শপগুলোর বেচাকেনা দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এ ব্যাপারে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াহেদ তমাল বলছেন, প্রচলিত হাটের সঙ্গে অনলাইন মার্কেট পেস্নসগুলোতে দামের পার্থক্য দেখে প্রচুর ক্রেতা এখন ডিজিটালি গরু কিনছেন। গত দুদিনে অনলাইন মার্কেট পেস্নসগুলো থেকে হাজারের বেশি গরু বিক্রি হয়েছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, ক্রেতাদের অনলাইন হাট থেকে পশু কেনার আগ্রহ দেখা যাচ্ছে গত ২ দিন ধরে। বিশেষ করে রাজধানীর গরুর হাটগুলো চালু হওয়ার পর। যখনি ক্রেতারা হাটে গিয়ে এবং অনলাইন ভিজিট করে গরুর দামের পার্থক্য দেখছে তখনি প্রচুর ক্রেতা সমাগম ও বিক্রি বেড়ে গেছে অনলাইনে। করোনাভাইরাস মহামারিকালে কোরবানির পশু কেনাবেচায় গত ১১ জুলাই থেকে অনলাইন পস্ন্যাটফরম 'ডিজিটাল হাট'র যাত্রা শুরু হয়। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ, ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) ও বাংলাদেশ ডেইরি ফার্ম অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে বাস্তবায়িত হয়েছে এই ডিজিটাল হাট। খামারিদের ক্ষতি পোষাতে আশ্বাস মন্ত্রীর প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর ১ কোটি ১৮ লাখ ৯৭ হাজার ৫০০ পশু কোরবানির জন্য মজুত ছিল। এসব পশুর মধ্যে হৃষ্টপুষ্ট গরু-মহিষের সংখ্যা ৪৫ লাখ ৩৮ হাজার এবং ছাগল-ভেড়ার সংখ্যা ৭৩ লাখ ৫৫ হাজার ও অন্যান্য চার হাজার ৫০০টি। রাজধানীর কোরবানির হাটে পর্যাপ্ত পশু আসার পরও বিক্রি তেমন না হওয়ায় প্রান্তিক খামারিদের যখন মাথায় হাত, তখন তাদের পাশে দাঁড়ানোর কথা জানালেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম। তিনি বলেন, প্রান্তিক খামারিদের আমরা আর্থিক প্রণোদনা দেওয়ার কথা ভাবছি। তাদের স্বল্প সুদে লোন দেওয়ার কথা ভাবছি, প্রাণীর খাবারের জন্য ভর্তুকির কথাও ভাবনায় রয়েছে আমাদের।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে