গ্রামাঞ্চলে ঈদ আনন্দ ফিকে

প্রকাশ | ৩১ জুলাই ২০২০, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
দুয়ারে কড়া নাড়ছে ঈদ। তাই শহুরে মানুষ করোনাভীতি ঠেলে কিছুটা সীমিত পরিসরে হলেও কোরবানির পশু ও নতুন জামা-কাপড় কেনার পাশাপাশি আনুষঙ্গিক আনুষ্ঠানিকতার সাধ্যমতো প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে। অথচ এ মহামারি পরিস্থিতিতে শহরে কর্মরত স্বজনদের কাছ থেকে ঈদখরচার টাকা ও বিদেশ থেকে পর্যাপ্ত রেমিটেন্স না আসাসহ নানা আর্থিক সংকটে গ্রামাঞ্চলে এ উৎসবের আনন্দ অনেকটাই ফিকে হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে দেশের বন্যাকবলিত ১৮ জেলার যেসব এলাকায় বিভিন্ন ফসল ও গবাদি পশুর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে; বেড়িবাঁধ ভেঙে যাদের ঘরবাড়ি এখনো পানিতে তলিয়ে রয়েছে-তাদের কাছে ঈদের আনন্দ যেন বিষাদে রূপ নিয়েছে। ধর্মীয় বৃহত্তর উৎসব ঘিরে সবার এখন কোরবানির পশু, পোলাউয়ের চাল-দুধ-চিনি-সেমাই কেনায় মেতে থাকার কথা থাকলেও বন্যাকবলিত উপকূলীয় গ্রামের মানুষ এখন তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই মেরামতে ব্যস্ত সময় পার করছে। এর ওপর গ্রামাঞ্চলে নতুন করে করোনার প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ায় সে ভীতিতে গ্রামীণ জনগপদে ঈদ আনন্দ অনেকটাই বিলীন হয়ে গেছে। গ্রামের স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানান, বিগত সময় শহরে কর্মরত যেসব আত্মীয়স্বজন সারা বছর নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা পাঠানোর পাশাপাশি ঈদসহ নানা পার্বণে বাড়তি খরচা পাঠাতেন, তারাই এখন অনেকে চাকরি হারিয়ে গ্রামে এসে ঠাঁই নিয়েছেন। করোনা পরিস্থিতিতে দীর্ঘ দিন বেকার থাকায় তাদের অনেকের দীর্ঘদিনের সঞ্চয় এরই মধ্যে অনেকটাই ফুরিয়ে এসেছে। এ পরিস্থিতি তাদের মনে ঈদের খুশি উবে গিয়ে স্ত্রী-সন্তান, ভাইবোনসহ পরিবারের অন্যদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তার কালো মেঘ ভর করেছে। ঈদ আয়োজন তাই তাদের কাছে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদিকে নানা প্রতিকূলতায় এখনো যারা শহরের কর্মস্থলে রীতিমতো যুদ্ধ করে টিকে আছে, নানা নির্দেশনার বেড়াজালে তারাও এবার অনেকে ঈদের ছুটিতে গ্রামে ফিরতে না পারায় তাদের নিকটাত্মীয়-স্বজনদের মাঝে ঈদ আনন্দ অনেকটাই ম্স্নান হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে সরকারি চাকরিজীবী ও গার্মেন্টকর্মীসহ যেসব ব্যক্তিমালিকাধীন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মস্থল না ছাড়তে সুস্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তাদের গ্রামের আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে ঈদ আনন্দের জোয়ারে যেন ভাটার টান ধরেছে। গণপরিবহণ-সংশ্লিষ্টরা জানান, ঈদের সপ্তাহখানেক আগে থেকেই গ্রামমুখী মানুষের যে ঢল নামে সে চিত্র এবার যেন উধাও হয়ে গেছে। ঈদের আর মাত্র দুই দিন বাকি থাকলেও বাস-ট্রেন-লঞ্চসহ কোনো পরিবহণেই গাদাগাদি ভিড় নেই। অথচ প্রতি বছর ঈদুল ফিতরের চেয়ে ঈদুল আজহায় কয়েকগুণ বেশি মানুষ শহরের কর্মস্থল ছেড়ে গ্রামে ফিরে যায়। শুক্রবার থেকে ঈদের ছুটি শুরু হলেও সেদিনও ঈদযাত্রায় তেমন বেশি যাত্রী পাওয়া যাবে না বলে আশঙ্কা করছেন পরিবহণ মালিক-শ্রমিকরা। তাদের এ আশঙ্কা যে অমূলক নয়, তা ঢাকায় বসবাসকারী সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তা এম এ হাবিব জানান, ঈদের ছুটির তিন দিন কর্মস্থলে থাকার জন্য সরকারি নির্দেশ রয়েছে। তবে তা নজরদারির কেউ না থাকলেও পাছে গ্রামে গিয়ে আকস্মিক কোনো বিপদে পড়ে সেখানে আটকা পড়লে চাকরিক্ষেত্রে সমস্যা হতে পারে এ আশঙ্কায় এবার ঈদের ছুটিতে অনেকেই গ্রামে যাচ্ছে না। এছাড়া ঈদের ছুটি মাত্র তিন দিনের হওয়ায় গ্রামে ফেরার ব্যাপারে অনেকে অনাগ্রহ দেখাচ্ছেন। রামপুরার এ বি গার্মেন্টেস মেশিন অপারেটর খোদেজা বেগম জানান, গ্রামে তার বাকপ্রতিবন্ধী স্বামী ও তিন শিশুসন্তান রয়েছে। ঈদের ছুটিতে বেতন-বোনাস নিয়ে তিনি গ্রামে ফিরলে তার পরিবারের ঈদ আনন্দের পূর্ণতা পাবে। অথচ বুধবার পর্যন্ত বেতন-বোনাস কিছুই হাতে পাননি। এর ওপর ছুটি কর্মস্থল না ছাড়তে গার্মেন্ট থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় তার পরিবারে ঈদ আনন্দ বিষাদে রূপ নিয়েছে। ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা ও শেরপুর এলাকার স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেখানকার বিপুলসংখ্যক মানুষ ঢাকা-গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন পোশাক কারখানার শ্রমিক। গত রোজার ঈদে গণপরিবহণ বন্ধ থাকলেও নানা ভোগান্তি ঠেলে তারা গ্রামে ফিরলেও এবার তাদের অনেককেই শহরের কর্মস্থলে থাকতে হচ্ছে। ফলে তাদের পরিবারে ঈদ আনন্দ যেন উধাও হয়ে গেছে। এদিকে বন্যাদুর্গত ১৮ জেলার ২৬ লাখ মানুষকে ঈদ উৎসব ভুলে দু'মুঠো খেয়ে বেঁচে থাকার লড়াই চালাতে হচ্ছে। বিশেষ করে যে ৫ লাখ ৮০ হাজার পরিবার এখনো পানিবন্দি। তাদের কাছে এ উৎসব যেন বিষাদের বার্তা নিয়ে এসেছে। বন্যার পানি থেকে বাঁচতে এসব মানুষ কেউ নিজের বাড়িতে উঁচু মাচা করে, কেউ সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে, কেউ বেড়িবাঁধের ওপর, কেউ নিজের বাড়িঘর ছেড়ে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে, আবার কেউ খোলা আকাশের নিচে বাস করছেন। মাত্র ক'দিন আগেও যাদের গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ ছিল তাদের অনেকের এখন সরকারি-বেসরকারি ত্রাণের জন্য এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতে হচ্ছে। বন্যাকবলিত লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নীলফামারী, রংপুর, সুনামগঞ্জ, জামালপুর, টাঙ্গাইল, রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলার স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানান, দুর্গত মানুষ ঈদ উৎসবের কথা অনেকটাই যেন ভুলে গেছে। তারা এখন পরিবার-পরিজন নিয়ে কোনোভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। আর বন্যার পানিতে ডুবে যাদের শিশুসন্তানসহ বিভিন্ন সদস্য মারা গেছে, তাদের পরিবারে এখনো শোকের মাতাম চলছে। অথচ এরই মধ্যে চোখের পানি মুছে তাদের ত্রাণের জন্য বিভিন্ন জায়গায় ছুটতে হচ্ছে। এদিকে শুধু বন্যার্ত এলাকাতেই নয়, দেশের অন্যান্য জেলার গ্রামগুলোতেও একধরনের থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। স্থানীয়রা জানান, এ নেপথ্যে করোনার ভীতি থাকলেও মূলত অর্থনৈতিক মন্দা মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। তাদের ভাষ্য, বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হলেও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ শহরে ও বিদেশে কর্মরত স্বজনদের আর্থিক সহায়তার ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। অথচ করোনা পরিস্থিতিতে সে সহায়তাপ্রাপ্তিতে বড় ধস নেমেছে, যা কাটিয়ে ওঠা তাদের জন্য রীতিমতো কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। যশোর মনিরামপুর উপজেলার দূর্বাডাঙা গ্রামের বাসিন্দা আবুল কাশেম মাস্টার জানান, তার ছয় ছেলে মেয়ে ঢাকার বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করত। করোনা পরিস্থিতিতে তাদের মধ্যে দুইজন চাকরি হারিয়ে এরই মধ্যে গ্রামে ফিরে এসেছে। ঈদের পর আর এক ছেলে স্থায়ীভাবে গ্রামে ফিরে আসবে বলে খবর দিয়েছে। বাড়ির ছোট্ট ভিটেতে তাদের সবার জন্য কোথায় ঘর তুলবে তা নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। অবসরপ্রাপ্ত এ স্কুল শিক্ষক বলেন, গত বছর কোরবানির ঈদের আগেও তিনি শহরে থাকা ছেলেমেয়েদের জন্য চিড়া-মুড়ি-নারকেল ও নানা ধরনের পিঠা জোগাড়ের জন্য ব্যস্ত থেকেছেন। পালের কোন গরু কোরবানি দিবেন তা নিয়ে টেলিফোনে সন্তানদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করেছেন। অথচ এক বছরের ব্যবধানে এখন সবকিছুই তার উলট-পালট হয়ে গেছে। আবুল কাশেম মাস্টার জানান, শুধু তার পরিবারেই নয়, গ্রামের আরো অনেকেই এখন একই সংকটের মুখে পড়েছে। তাই গোটা গ্রামের ঈদের আগাম আনন্দ যেন বিলীন হয়ে গেছে। দূর্বাডাঙা গ্রামে প্রতিবছর বাড়ি-বাড়ি কোরবানি হলেও এবার ৩০ শতাংশ মানুষ তা দিতে সক্ষম হবেন কিনা তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন তিনি। এদিকে গত রোজার ঈদেও গ্রামের মানুষের মধ্যে করোনাভীতি ততটা না থাকলেও ইদানীং এ মরণ ব্যাধির প্রকোপ শহরের গন্ডি পেরিয়ে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ায় তারা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে উঠেছে। গ্রামাঞ্চলের মানুষের ধারণা, রোজার ঈদের বিপুলসংখ্যক প্রবাসী ও শহুরে মানুষ গ্রামে ফেরায় তাদের মাধ্যমে সেখানকার মানুষ সংক্রমিত হয়েছে। তাই কোরবানির ঈদেও শহর থেকে আসা আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে গ্রামেও এ রোগের বিস্তার মহামারি আকারে ছড়াতে পারে এমন আশঙ্কায় অনেকেই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন। গ্রামীণ জনপদের জনপ্রতিনিধিদের ভাষ্য, ঢাকাসহ অন্যান্য জেলা শহরে সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি অত্যাধুনিক বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক ও ডায়াগনোস্টিক সেন্টার রয়েছে। তাই শহরের মানুষ সহজেই করোনার নমুনা পরীক্ষা এবং এর প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিতে পারছেন। অথচ গ্রামে এ ধরনের সুযোগ-সুবিধা নেই বললেই চলে। এ অবস্থায় গ্রামাঞ্চলে করোনাভাইরাসের প্রকোপ বাড়লে তাদের অনেককে বিনা চিকিৎসাতেই মরতে হবে। তাই আগে গ্রামের মানুষ ঈদের ছুটিতে শহরের আত্মীয়স্বজনদের ফেরার অপেক্ষায় থাকলেও এখন তাদের আগমনী বার্তা উল্টো ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্রামের ব্যবসায়ীরা জানান, সেখানকার মানুষের মধ্যে ঈদ-আনন্দ কতটা ফিকে হয়ে পড়েছে তা স্থানীয় হাট-বাজার, বিপণিবিতান ও মার্কেটগুলোর বিকিকিনির চিত্র দেখলেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। তাদের ভাষ্য, গ্রামাঞ্চলের দোকানপাটে গত রোজার ঈদে যে সংখ্যক তৈরি পোশাক, প্রসাধনী ও অন্যান্য উপহার সামগ্রী বিক্রি হয়েছে; এবার তার এক-তৃতীয়াংশও বেচাকেনা হয়নি। এমনকি পোলাউয়ের চাল, চিনি, সেমাই, ঘি ও দুগ্ধজাত পণ্যসহ ঈদকেন্দ্রিক যেসব খাদ্যপণ্য এ সময়ে সাধারণত বেশি বিক্রি হয়, তার বেচাকেনাতেও চরম ধস নেমেছে। এদিকে প্রতি বছর ঈদুল আজহায় স্থানীয় এমপিসহ অন্যান্য জনপ্রতিনিধি এবং শহরে থাকা বিত্তশালী শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা নিজ নিজ গ্রামে ফিরে বিশাল আকৃতির এক বা একাধিক গরু কোরবানি দিয়ে তার মাংস স্থানীয় দরিদ্র মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দেন। এছাড়া নগদ টাকাসহ অন্যান্য উপহারসামগ্রীও বিলি-বণ্টন করেন। অথচ করোনার ভয়ে এবার এ প্রস্তুতি নেই বললেই চলে। স্থানীয় এমপিরা অনেকে করোনা শুরুর পর আর গ্রামমুখো হননি। বিত্তশালীরাও অনেকেই এখন গ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছেন। সবমিলিয়ে প্রতি বছর ঈদের সময় গ্রামীণ দরিদ্র মানুষ যে আর্থিক সহায়তা পেতেন তা একরকম বন্ধ হয়ে গেছে। তাই তাদের কাছে ঈদের আনন্দ যেন নিরানন্দ হয়ে উঠেছে। ব্যাংক সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে, ঈদুল ফিতরের আগে দেশে রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স এলেও এবার তাতেও বেশখানিকটা ভাটার টান ধরেছে। কেননা গত কয়েক মাস থেকে নতুন শ্রম বাজার তো খুলছেই না, বরং ছুটিতে এসে দেশে হাজার হাজার প্রবাসী আটকা পড়ে আছেন। আর যারা বিভিন্ন দেশে আছেন, তারাও করোনার আগের মতো ভালো অবস্থায় নেই। বিশ্লেষকদের ধারণা, রোজার ঈদের আগে অনেকে বেশি পরিমাণ টাকা পাঠালেও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে তারাও এবার আগের মতো রেমিটেন্স পাঠাতে পারছেন না। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।