যৌথ সংবাদ সম্মেলনে সেনা ও পুলিশপ্রধান

এ ঘটনায় দুই বাহিনীর সম্পর্কে চিড় ধরবে না

প্রকাশ | ০৬ আগস্ট ২০২০, ০০:০০

জাবেদ আবেদীন শাহীন, কক্সবাজার ও আরাফাত সানী, টেকনাফ
সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ ও পুলিশের মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদ বুধবার সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যাকান্ডের স্থান কক্সবাজারের বাহারছড়া এলাকা পরিদর্শন করেন -আইএসপিআর
পুলিশের গুলিতে সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা মোহাম্মদ রাশেদের মৃতু্যর ঘটনায় যৌথ সংবাদ সম্মেলন করেছেন সেনাবাহিনীপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ ও পুলিশের মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদ। বুধবার দুপুরে কক্সবাজার সৈকতের বালিয়াড়ি লাগোয়া সেনাকল্যাণ ট্রাস্টের রেস্ট হাউস 'জল তরঙ্গে' হওয়া সংবাদ সম্মেলনে জেনারেল আজিজ আহমেদ বলেন, এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এতে দুই বাহিনীর সম্পর্কে চিড় ধরবে না। পুলিশপ্রধানও এ সময় পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো ব্যত্যয় হবে না উলেস্নখ করে তিনি বলেন, সিনহার মৃতু্যতে গঠিত কমিটি প্রভাবমুক্ত পরিবেশে তদন্ত করবে। তাদের দেওয়া সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এদিকে কক্সবাজারে পুলিশের গুলিতে সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান নিহতের ঘটনায় টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও গুলিবর্ষণকারী ইন্সপেক্টর লিয়াকতসহ ৯ জনের নামে আদালতে খুনের মামলা দায়ের করা হয়েছে। গতকাল বুধবার নিহতের বোন শারমিন শাহারিয়া কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলাটি দায়ের করেন। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছেনর্ যাব-১৫ কক্সবাজার ক্যাম্পের অধিনায়ককে। এমন পরিস্থিতিতে টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে বরখাস্ত করে থানার ইন্সপেক্টর তদন্ত এবিএমএস দোহাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। ওদিকে সিনহা মৃতু্যর ঘটনায় পুলিশের দায়েরকৃত দুটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে সিনহার গাড়িতে অবস্থানকারী সিফাত ও রেস্ট হাউস থেকে আটক শিপ্রা রানী দেবনাথকে। তারা সিনহার সঙ্গে ডকুমেন্টারি ফিল্ম বানাতে সেখানে যাওয়ায় তাদের কাল হয়েছে বলে দাবি স্বজনদের। স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের এই ছাত্র-ছাত্রীর পরিবারে এখন শুধুই কান্নার রোল। তারা অবিলম্বে তাদের মুক্তি দাবি করেছেন। জানা গেছে, সিনহা মৃতু্যর ৬ দিন পর গতকাল দুপুর পৌনে ১টার দিকে একটি বিশেষ হেলিকপ্টারে সেনাপ্রধান ও আইজিপি কক্সবাজার বিমানবন্দরে পৌঁছান। পরে তারা সৈকতের বালিয়াড়ি লাগোয়া সেনাকল্যাণ ট্রাস্টের রেস্ট হাউস 'জল তরঙ্গে' ওঠেন। সেখানে দুই বাহিনীর সিনিয়র কর্মকর্তারা মতবিনিময় করেন। পরে দুপুর আড়াইটায় তারা সংবাদ সম্মেলন করেন। পরে তারা বিকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। সংবাদ সম্মেলনে সেনাবাহিনীরপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ বলেন, কক্সবাজারে আসার উদ্দেশ্য একটাই। সেটা হলো গত ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজারে একটি ঘটনা ঘটেছে। যেখানে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার মৃতু্যর ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনা উপলক্ষেই আমাদের এখানে আসা। এখানে এসে আমরা এই এলাকার সেনাবাহিনীর সিনিয়র অফিসার ও পুলিশের সিনিয়র অফিসারের সঙ্গে মতবিনিময় করেছি। সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশ যেকোনো প্রয়োজনে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। যে ঘটনাটি ঘটেছে তাতে সেনাবাহিনী ও পুলিশ মর্মাহত। তিনি বলেন, আমরা এটাকে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখতে চাই। যে ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে একটি যৌথ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। যারা গতকাল তাদের কাজ শুরু করেছে। প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস ও তদন্ত কমিটির প্রতি আমাদের আস্থা আছে। জেনারেল আজিজ আহমেদ বলেন, আমরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই, দুই বাহিনীর সম্পর্কে চিড় ধরে এমন কিছু হবে না। এ ঘটনা নিয়ে যেন সেনাবাহিনী ও পুলিশের ভেতর অনাকাঙ্ক্ষিত চিড় ধরানোর মতো ঘটনা না ঘটে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকারও অনুরোধ করেন তিনি। সংবাদ সম্মেলনে আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ আধুনিক গণতান্ত্রিক দেশ। এখানে আইনের শাসন আছে। সংবাদমাধ্যম সর্বোচ্চ স্বাধীনতা ভোগ করছে। বিচার বিভাগ মুক্ত। এ ঘটনা নিয়ে অনেকে উসকানিমূলক কথা বলার চেষ্টা করছেন। যারা উসকানি দিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করছে, তাদের উদ্দেশ্য সফল হবে না। তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাদের পারস্পরিক শ্রদ্ধা, বিশ্বাস ও আস্থার সম্পর্ক। মেজর (অব.) সিনহার মৃতু্যতে পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো ব্যত্যয় হবে না। কমিটি প্রভাবমুক্ত পরিবেশে তদন্ত করবে। কমিটি যে সুপারিশ দেবে, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এদিকে গতকাল সকালে পুলিশের গুলিতে সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান নিহতের ঘটনায় মামলা দায়ের করেছেন সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়া। কক্সবাজারের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারহার আদালতে মামলাটি দায়ের করেন তিনি। দন্ডবিধির ৩০২, ২০১, ৩৪ ধারায় দায়ের করা এ মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ও পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে। তার বাড়ি চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার পূর্ব হুলাইন গ্রামে। দুই নম্বর আসামি হয়েছেন টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। মামলার অপর সাত আসামি হলেন থানার এসআই দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আব্দুলস্নাহ আল মামুন, এএসআই লিটন মিয়া, এসআই টুটুল ও কনস্টেবল মো. মোস্তফা। মামলার প্রধান সাক্ষী করা হয়েছে নিহত সিনহার সঙ্গে থাকা সাহেদুল ইসলাম ওরফে সিফাতকে। তার বাড়ি বরগুনার পূর্ব শফিপুর গ্রামে। পরে আদালত মামলাটি তদন্ত করার জন্যর্ যাবের প্রতি নির্দেশ দেওয়া হয়। মামলার এজাহারে বলা হয়, ৩১ জুলাই বিকালে মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান সঙ্গী সাহেদুল ইসলাম ওরফে সিফাতকে নিয়ে কক্সবাজারের হিমছড়ি নীলিমা রিসোর্ট থেকে তথ্যচিত্রের ভিডিওচিত্র ধারণের জন্য টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের পাহাড়ে যান। এ সময় সিনহার পরনে ছিল কমব্যাট গেঞ্জি, কমব্যাট ট্রাউজার ও ডেজার্ট বুট। তথ্যচিত্রের ভিডিওচিত্র ধারণ করার উদ্দেশ্যেই এ পোশাক তিনি পরেছিলেন। এজাহারের ভাষ্যমতে, রাত ৮টা পর্যন্ত পাহাড়ে ছিলেন সিনহা ও সিফাত। তারা পাহাড়ে দিনের ও সন্ধ্যাকালের দৃশ্য ধারণ করেন। রাত ৯টা ২৫ মিনিটের দিকে নিজস্ব প্রাইভেটকারে শামলাপুর তলস্নাশিচৌকিতে পৌঁছলে পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ আসামিরা গাড়িটির গতিরোধ করেন। এ সময় সিনহা নিজেকে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দেন। তখন আসামিরা সিফাতকে গাড়ির সামনের বাঁ দিকের দরজা খুলে টেনেহিঁচড়ে বের করে নিয়ে যান। এ সময় সিফাত দুই হাত ওপরে তুলে নিজের এবং গাড়িতে বসা সিনহার পরিচয় দেন। এতে আসামিরা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তারা চালকের আসনে বসে থাকা সিনহাকে অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করেন। এক পর্যায়ে সিনহা গাড়ি থেকে নেমে দুই হাত ওপরে তুলে বারবার নিজের পরিচয় দিতে থাকেন। কিন্তু সিনহাকে উদ্দেশ্য করে আরও গালমন্দ শুরু করেন মামলার প্রধান আসামি লিয়াকত আলী। তিনি বলতে থাকেন, 'তোর মতো বহুত মেজরকে আমি দেখছি। এইবার খেলা দেখামু।' এরপর লিয়াকত আলী টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে ফোন দিয়ে সলাপরামর্শ করতে থাকেন। একপর্যায়ে লিয়াকত আলী ফোনে ওসি প্রদীপকে বলতে থাকেন, 'ঠিক আছে, শালারে শেষ কইরা দিতাছি।' এরপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই লিয়াকত আলী সম্পূর্ণ ঠান্ডা মাথায় পূর্বপরিকল্পিতভাবে মেজর (অব.) সিনহার শরীরে কয়েকটি গুলি করেন। গুলির আঘাতে সিনহা রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়ে যান। নিজের জীবন রক্ষার্থে তিনি ঘটনাস্থল থেকে উঠে পালানোর চেষ্টা করেন। তখন অন্য আসামিরা তাকে চেপে ধরে পুনরায় মাটিতে ফেলে দেন। এ সময় সিনহার মৃতু্য নিশ্চিত করতে আরও একটি গুলি করেন লিয়াকত আলী। পরে ঘটনাস্থলে আসেন ওসি প্রদীপ। তিনি গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মাটিতে পড়ে থাকা সিনহার শরীর ও মুখে কয়েকবার লাথি মেরে মৃতু্য সম্পর্কে নিশ্চিত হন। এছাড়া নিজের বুট দিয়ে ঘষা মেরে সিনহার মুখমন্ডল বিকৃত করার চেষ্টা করতে থাকেন। এ সময় মামলার সাক্ষীদের ও ঘটনাস্থলের আশপাশের লোকজনকে আসামিরা অস্ত্র উঁচিয়ে হত্যার হুমকি দিয়ে ঘটনাস্থল থেকে তাড়িয়ে দেন। রাত ১টা ৪৫ মিনিটের দিকে সিনহাকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ওদিকে সিনহা মৃতু্যর ঘটনায় পুলিশের দায়েরকৃত দুটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে সিনহার গাড়িতে অবস্থানকারী সিফাত ও রেস্ট হাউস থেকে আটক শিপ্রা রানী দেবনাথকে। গ্রেপ্তার সিনহার খালা অ্যাডভোকেট নিলু বেগম জানান, সিফাতের পরিবারের সদস্যরা দেশের বাইরে থাকেন। ছোটবেলা থেকেই খালা-খালুর সঙ্গে সিফাত রাজধানীর আগারগাঁও এলাকার বাসায় বসবাস করে। ঘটনার কয়েক মিনিট পর খালা নিলুর সঙ্গে দুই মিনিট কথা হয় সিফাতের। এসময় সিফাত তার খালাকে জানান, কোনোকিছু বুঝে ওঠার আগেই সিনহাকে গুলি করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে ক্যামেরা ছাড়া পুলিশ কিছুই পায়নি। এরপরও এই পুলিশের দায়েরকৃত মামলায় সিফাতকে আসামি করা হয়েছে। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত শেষে দ্রম্নতই সিফাতের মুক্তি দাবি করেন খালা নিলু বেগম। একই ঘটনা ঘটেছে শিপ্রা রানী দেবনাথের ক্ষেত্রেও। পুলিশ সিনহার রুম থেকে বিদেশি মদ ও গাঁজা পাওয়ার পরও শিপ্রাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে বলে দাবি করেছেন তার ছোট ভাই শুভজিৎ দেবনাথ। তিনি বলেন, শিপ্রা ও সিফাত একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ২য় বর্ষের ছাত্র। তারা সিনহার ডকুমেন্টারি প্রোগ্রামে কাজ শেখার জন্য গিয়েছিল; কিন্তু তারা এভাবে পুলিশের মামলায় ফেসে যাবেন তা চিন্তা করলে তার বোনকে সেখানে পাঠাতেন না বলে দাবি করেন। স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মতিউর রহমান জানান, তার দেখা মতে সিনহার সঙ্গে যাওয়া শিপ্রা, সিফাত ও তাহসিন খুবই ভালো ছেলে-মেয়ে। তারা কোনো ধরনের মাদক বা খারাপ কাজে যুক্ত থাকার সম্ভাবনা নেই। তাহসিনকে পরিবারের জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হলেও বাকি দুই ছাত্রছাত্রীকে গ্রেপ্তার দেখানোর নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, দ্রম্নতই তদন্ত শেষে তাদের মুক্তি দেওয়া হোক।