বৈরুত বিস্ফোরণে নিহতের সংখ্যা ১০০ ছাড়াল

প্রকাশ | ০৬ আগস্ট ২০২০, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
লেবাননের রাজধানী বৈরুতে রাসায়নিক দ্রব্যের গুদামে ভয়াবহ বিস্ফোরণে এলাকাটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় -ইন্টারনেট
লেবাননের রাজধানী বৈরুতে একটি রাসায়নিক দ্রব্যের গুদামে স্মরণকালের ভয়াবহ বিস্ফোরণে নিহতের সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়ে গেছে। কয়েক দফা বিস্ফোরণে আহত হয়েছে অন্তত চার হাজার মানুষ। তাদের মধ্যে অনেকের অবস্থা গুরুতর। ফলে নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। এ ঘটনায় শোকে স্তব্ধ পুরো লেবানন। মঙ্গলবারের বিস্ফোরণের ঘটনায় তিনদিনের শোক পালন করছে লেবানন। দেশটিতে বুধবার শুরু হওয়া এই রাষ্ট্রীয় শোক শুক্রবার পর্যন্ত চলবে। এ ছাড়াও দুই সপ্তাহের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হতে পারে বলে আভাস দিয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো। লেবাননের কর্মকর্তারা বলছেন, বিস্ফোরণস্থলের ধ্বংসস্তূপ সরাতে কাজ করে যাচ্ছেন উদ্ধারকর্মীরা। পরিস্থিতি পর্যালোচনায় লেবাননের প্রেসিডেন্ট মিশেল আউন বুধবার মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠক ডেকেছেন। সংবাদসূত্র : বিবিসি, রয়টার্স, এএফপি, গার্ডিয়ান মঙ্গলবার স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টার পরপর ওই বিস্ফোরণে বৈরুত ছাড়াও আশপাশের অনেক শহর কেঁপে ওঠে। পুরো শহর যখন পরপর কয়েকটি বিস্ফোরণে প্রকম্পিত, তখন শহরের বাসিন্দারা ভূমিকম্প মনে করে ছোটাছুটি শুরু করে। বলা হচ্ছে, বিস্ফোরণে ৩.৩ মাত্রার ভূমিকম্পের সমান কাঁপুনি অনুভূত হয়েছে। কম্পন অনুভূত হয় ২৪০ কিলোমিটার দূরের দ্বীপরাষ্ট্র সাইপ্রাসেও, সেখানকার বাসিন্দারা এ ঘটনাকে ভূমিকম্প বলে মনে করেছিল। কর্মকর্তারা প্রাথমিকভাবে জানিয়েছেন, বন্দরের এক রাসায়নিক দ্রব্যের গুদামে মঙ্গলবারের ওই বিস্ফোরণের সূত্রপাত হয় আগুনের মাধ্যমে। বিস্ফোরণের পর ধোঁয়ার মেঘ কয়েক কিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। দেশটির প্রেসিডেন্ট মিশেল আউন এক টুইটে বলেছেন, কোনো ধরনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করে দুই হাজার ৭৫০ টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট বন্দরে মজুত করে রাখা হয়েছিল, যা কোনোভাবে 'গ্রহণযোগ্য নয়'। লেবাননের প্রধানমন্ত্রী হাসান দিয়াব এ ঘটনাকে বিপর্যয় হিসেবে বর্ণনা করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন। তিনি এই দুর্যোগ ও ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা চেয়েছেন। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইরান, ইসরাইলসহ কয়েকটি দেশ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে লেবাননকে সহযোগিতার প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রও বলেছে, তারা পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে। বিস্ফোরণের কারণ বের করতে এরই মধ্যে তদন্ত শুরু হয়েছে। দায়ীদের 'সর্বোচ্চ সাজার' মুখোমুখি হতে হবে বলে হুঁশিয়ার করেছে লেবাননের সুপ্রিম ডিফেন্স কাউন্সিল। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, ২০১৩ সালে একটি জাহাজ থেকে ওই অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট জব্দ করার পর সেগুলো বন্দরের একটি ওয়্যারহাউসে রাখা হয়। এরপর থেকেই বিপজ্জনক ওই রাসায়নিক দ্রব্য সেখানেই পড়ে ছিল। দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা প্রধান আব্বাস ইব্রাহিম বলেন, আফ্রিকায় চালান দেওয়ার জন্য বৈরুত বন্দরে রাখা হয়েছিল দুই হাজার ৭০০ টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট। সেখান থেকেই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। লেবাননের উচ্চ প্রতিরক্ষা পরিষদের সভা শেষে এই মন্তব্য করেন ইব্রাহিম। মঙ্গলবার বিস্ফোরণের পর ঘটনাস্থলে অসংখ্য মৃতদেহ ও ধ্বংসস্তূপ দেখা গেছে। হাসপাতালগুলোতে ছিল আহত ও রক্তাক্তদের উপচেপড়া ভিড়। স্থানীয় গণমাধ্যমের ছবিতে ধ্বংসস্তূপের নিচে বহু মানুষকে আটকেপড়া অবস্থায় দেখা যায়। এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, বিস্ফোরণের শব্দে তার কানে তালা লেগে গিয়েছিল। ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, বৈরুতের বন্দর এলাকা থেকে বড় গম্বুজ আকারে ধোঁয়া উড়ছে, এর কিছুক্ষণের মধ্যে বিকট বিস্ফোরণে গাড়ি, ভবন উড়ে যেতে দেখা যায়। বিস্ফোরণের ধাক্কায় বাড়িঘরের জানালার কাচ ও ব্যালকনি ভেঙেও অনেকে আহত হন। বিস্ফোরণের পরপরই বৈরুত যেন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। বুধবারও যেখানে-সেখানে পড়ে ছিল ভাঙা কাচ। আশপাশের ভবনগুলো আগুনে পুড়ে গেছে। বিস্ফোরণের মূল এলাকা থেকে চার কিলোমিটার দূরে থাকা ভবনগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। লেবাননে গৃহযুদ্ধ চলার সময়ও এতটা ধ্বংসযজ্ঞ দেখা যায়নি। বিস্ফোরণের পরপরই বন্দর এলাকায় নিখোঁজদের সন্ধানে স্বজনদের ভিড় জমাতে দেখা গেছে। ভাইয়ের খোঁজে আসা এক তরুণী নিরাপত্তারক্ষীদের কাছে বারবার খোঁজ জানতে চেয়েছিলেন। ভাইকে চেনাতে তার শারীরিক গঠনের বর্ণনা দিচ্ছিলেন। বলছিলেন, 'তার নাম জাদ। তার চোখগুলো সবুজ।' তবে নিরাপত্তারক্ষীরা তাকে ভবনের ভেতর প্রবেশ করতে দেয়নি। আর ওই নারী বারবার তাদের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছিলেন ভেতরে যেতে দেওয়ার জন্য। পাশেই আরেক নারীকে দেখা যায় স্বজনের খোঁজে এসে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন। তিনিও গিয়েছিলেন ভাইয়ের খোঁজে। তার ভাইও বন্দরেই কাজ করতেন। ওই এলাকায় নিয়োজিত এক সেনা সদস্য বিস্ফোরণের পর বলেন, 'ভেতরের অবস্থা খুবই খারাপ। মাটিতে মানুষের মৃতদেহ পড়ে আছে। এখনো মৃতদেহ উদ্ধার করে সেগুলোকে অ্যাম্বুলেন্সে ওঠানোর কাজ চলছে।' বৈরুত বন্দরের পাশে কয়েক দশক ধরে বসবাস করছেন অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক মাকরোহি ইয়েরগানিন। তিনি বলেন, 'এটি ছিল পারমাণবিক বোমার মতো। আমার সবকিছুরই অভিজ্ঞতা রয়েছে। তবে আগে কখনো এ ধরনের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হইনি। এমনকি ১৯৭৫-১৯৯০ সাল পর্যন্ত চলা গৃহযুদ্ধের সময়ও এমনটা দেখিনি। আশপাশের সব ভবন ভেঙে পড়েছে। অন্ধকারের মধ্যে আমি কাচ আর ধ্বংসস্তূপের ভেতর দিয়ে হেঁটে এসেছি।' বিস্ফোরণস্থলের কাছেই ২০০৫ সালে এক গাড়িবোমা হামলায় লেবাননের সাবেক প্রধানমন্ত্রী রফিক হারিরি নিহত হয়েছিলেন। শুক্রবার নেদারল্যান্ডের দ্য হেগে জাতিসংঘের এক বিশেষ ট্রাইবু্যনালে দেড় দশক আগের ওই হত্যাকান্ড নিয়ে রায় হওয়ার কথা। এর আগেই এমন ভয়াবহ বিস্ফোরণের সাক্ষী হলো দেশটি। অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত লেবানন এমনিতেই পুরনো গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব ও করোনাভাইরাস সংকট সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। ইরান সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুলস্নাহর সঙ্গে ইসরাইলের সাম্প্রতিক মুখোমুখি অবস্থানের কারণেও দেশটি নাজুক অবস্থানে রয়েছে। বৈরুতের বিস্ফোরণ দুর্ঘটনা নয়, বোমা হামলা : ট্রাম্প লেবাননের বৈরুতে শক্তিশালী বিস্ফোরণের ঘটনাকে ভয়াবহ বোমা হামলা বলে দাবি করেছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় হোয়াইট হাউসের করোনাভাইরাস ব্রিফিংয়ে ট্রাম্প এমন মন্তব্য করেন। ট্রাম্প বলেন, বৈরুতে যে বিস্ফোরণ ঘটেছে, সেটা কোনো কারখানার বিস্ফোরণ নয়। বরং এটি কোনো না কোনোভাবে বোমা হামলা। এটিকে ভয়াবহ হামলা হিসেবে উলেস্নখ করার পর সাংবাদিকরা তাকে প্রশ্ন করেন, 'বৈরুতের বিস্ফোরণ একটি হামলার ঘটনা ছিল; এ বিষয়ে কি আপনি আত্মবিশ্বাসী?' জবাবে ট্রাম্প বলেন, মার্কিন সামরিক কর্মকর্তারা তাকে যা বলেছিলেন, এর ভিত্তিতে এটি 'মনে হচ্ছে'। এটি হামলার ঘটনা ছিল। ট্রাম্প বলেন, 'আমি আমাদের কয়েকজন জেনারেলের সঙ্গে কথা বলেছি এবং তারা মনে করছেন, এটি কোনো উৎপাদন-সংক্রান্ত বিস্ফোরণ ধরনের ঘটনা নয়। তারা মনে করেন, এটি হামলার ঘটনা ছিল। এটি ছিল এক ধরনের বোমা বিস্ফোরণ। তারা আমার চেয়ে আরও ভালো জানেন।'