শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
মেজর সিনহা হত্যাকান্ড

প্রদীপ-লিয়াকতসহ রিমান্ডে তিন, ৪ জন কারাগারে

প্রথম দফা শুনানিতে ৭ জনকেই কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। পরের্ যাবের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দ্বিতীয় দফা শুনানিতে আদালত এ সিদ্ধান্ত দেয়
তানভীর হাসান, ঢাকা ও জাবেদ আবেদীন শাহীন, কক্সবাজার
  ০৭ আগস্ট ২০২০, ০০:০০
সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলায় টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ (লাল বৃত্তে চিহ্নিত) অন্য আসামিদের বৃহস্পতিবার কক্সবাজারের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয় -সংগৃহীত

পুলিশের গুলিতে সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলায় টেকনাফ থানার সাবেক ওসিসহ ৩ জনকে ৭ দিনের রিমান্ড ও বাকি ৪ জনকে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। বৃহস্পতিবার বিকালে প্রথম দফা শুনানিতে ৭ জনকেই কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। পরবর্তীতের্ যাবের আবেদনের প্রেক্ষিতে দ্বিতীয় দফা শুনানিতে আদালত এ সিদ্ধান্ত দেন। রিমান্ডে যাওয়া আসামিরা হচ্ছেন টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, ইন্সপেক্টর লিয়াকত ও এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিত। জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদ করা আসামিরা হচ্ছেন- কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আব্দুলস্নাহ আল মামুন ও এএসআই লিটন মিয়া। এর আগেই তারা পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। মামলার অপর দুই আসামি এসআই টুটুল ও কনস্টেবল মোস্তফাকে এদিন আদালতে হাজির করা হয়নি।

এদিকে, প্রথম দফা শুনানি শেষে কক্সবাজারের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের পাবলিক প্রশিকিউটর ফরিদুল আলম জানান, সিনহা হত্যা মামলার ৯ আসামির মধ্যে ৭ জন আত্মসমর্পণ করে। দীর্ঘ এক ঘণ্টা শুনানি শেষে আদালত সাবেক ওসি

\হপ্রদীপ কুমার দাশ, ইন্সপেক্টর লিয়াকতসহ ৭ জনকে কারাগারে পাঠায়। মামলার অপর দুই আসামি এসআই টুটুল ও কনস্টেবল মোস্তফার বিষয়ে আদালতে কোনো আলোচনা হয়নি।

দ্বিতীয় দফা শুনানি শেষে বাদীপক্ষের আইনজীবী মো. মোস্তফা কামাল সাংবাদিকদের বলেন,র্ যাবের আবেদনের প্রেক্ষিতে রাত ৮টার দিকে মো. হেলালউদ্দিনের আদালতে শুনানি শেষে সাবেক ওসিসহ ৩ জনকে ৭ দিনের রিমান্ড ও ৪ জনকে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেওয়া হয়। প্রথম দফার শুনানিও একই আদালতে হয়েছিল।

জানা গেছে, গতকাল বিকাল সাড়ে ৪টায় কক্সবাজার পুলিশ লাইন থেকে মামলার প্রধান আসামি ইন্সপেক্টর লিয়াকতসহ ৬ জনকে আদালতের গারদখানায় নিয়ে আসা হয়। এরপর বিকাল ৫টায় পুলিশি পাহারায় চট্টগ্রাম বিভাগীয় পুলিশ হাসপাতাল থেকে সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশকেও সেখানে হাজির করা হয়। পরে তাদের একসঙ্গে বিকাল সাড়ে ৫টায় আদালতে তোলা হয়। শুনানি শেষে আদালত তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

টেকনাফের সাবেক ওসি প্রদীপ দাশকে পুলিশ পাহারায় কক্সবাজার পাঠানোর বিষয়ে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন কমিশনার মাহাবুবুর রহমান বলেন, হত্যা মামলা দায়ের হওয়ার পর গতকাল প্রদীপ নিজেই আদালতে আত্মসমর্পণ করার জন্য কক্সবাজারের উদ্দেশে রওনা দেন। পথে তিনি যেন পালিয়ে যেতে না পারেন এ কারণে তাকে পুলিশি পাহারা দিয়ে পাঠানো হয়। পাশাপাশি তিনি নিজেও প্রটেকশন চেয়েছিলেন।

জানা গেছে, বিকাল সাড়ে ৫টায় কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. হেলালউদ্দিনের আদালতে সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, ইন্সপেক্টর লিয়াকত, এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আব্দুলস্নাহ আল মামুন ও এএসআই লিটন মিয়াকে হাজির হয়। সেখানে প্রায় এক ঘণ্টা শুনানি হয়। শুনানিতে আসামিদের পক্ষে অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ জাকারিয়া এবং বাদী পক্ষে অ্যাডভোকেট রাখাল চন্দ্র মিত্র অংশগ্রহণ করেন। রাষ্ট্র পক্ষে উপস্থিত ছিলেন কোর্ট ইন্সপেক্টর প্রদীপ কুমার দাশ। দীর্ঘ সময় শুনানি শেষে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর এ ঘটনায় দায়েরকৃত হত্যা মামলারর্ যাবের তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদনের প্রেক্ষিতে দ্বিতীয় দফার শুনানিতে রিমান্ড ও জেলগেটে জিজ্ঞাবাদের অনুমতি দেওয়া হয়।

এদিকে গতকাল দুপুরে টেকনাফ থানা পরিদর্শন করে এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যরা। তারা দীর্ঘ সময় অবস্থান করলেও সাংবাদিকদের সঙ্গে কোনো কথা বলেনি। তবে একটি সূত্রমতে গত কয়েক মাসে ওই এলাকায় কতগুলো ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটেছে সে বিষয়ে তারা তথ্য সংগ্রহ করেন। পাশাপাশি ওই দিন ওয়্যারলেস সেটে কোনো ধরনের বেতার বার্তা দেওয়া হয়েছিল কিনা তাও খতিয়ে দেখা হয়। টেকনাফ থানার ওসি এ বি এম দোহা তাদের থানা পরিদর্শনের বিষয়টি নিশ্চিত করলেও কোনো বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি।

এদিকে বিবিসি বাংলার এক খবরে বলা হয়েছে, কক্সবাজার জেলার মেরিন ড্রাইভে পুলিশের গুলিতে নিহত মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান নিহত হওয়ার ঘটনায় সংবাদমাধ্যম এবং ইন্টারনেট-ভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগের পস্নাটফর্মে যত আলোচনা হচ্ছে, এর বেশির ভাগই চলছে নিহত সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও টেকনাফ পুলিশকে কেন্দ্র করে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুলিশ এবং সামরিক বাহিনীর সম্পর্ক কোন দিকে গড়ায় সেদিকেও অনেকের নজর রয়েছে। যদিও দুই বাহিনীর প্রধান এরই মধ্যে পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান নিহত হওয়ার বিষয়টি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এসব আলোচনার ভিড়ে অনেকটাই চাপা পড়ে গেছে নিহত সিনহা রাশেদের সঙ্গে থাকা তিন শিক্ষার্থীর কথা। সিনহা মো. রাশেদ খানের সঙ্গে কক্সবাজারে ডকুমেন্টারি তৈরির সময় যে তিনজন সঙ্গে ছিলেন তাদের মুক্তির দাবিতে সহপাঠীরা নানা কর্মসূচি পালন করছেন।

তিন শিক্ষার্থীর কী অবস্থা?

এই তিনজন বেসরকারি স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের শিক্ষার্থী। তারা হলেন শিপ্রা দেবনাথ, সাহেদুল ইসলাম সিফাত এবং তাহসিন রিফাত নূর। এদের মধ্যে তাহসিন রিফাত নূরকে তাদের অভিভাবকের কাছে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বাকি দুইজন- শিপ্রা দেবনাথ এবং সাহেদুল ইসলাম সিফাত এখন কক্সবাজার কারাগারে রয়েছেন। এর মধ্যে সাহেদুল ইসলাম সিফাতের বিরুদ্ধে দুইটি মামলা এবং শিপ্রা দেবনাথের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। পুলিশের গুলিতে যখন সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ নিহত হন তখন সেখানে ছিলেন সাহেদুল ইসলাম সিফাত। সিফাতের বিরুদ্ধে একটি মামলা হচ্ছে, সরকারি কাজে বাধা দেওয়া ও হত্যার উদ্দেশ্যে অস্ত্র দিয়ে গুলি করার জন্য তাক করা। মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, সিনহা মোহাম্মদ রাশেদের সঙ্গে যোগসাজশে সিফাত এ কাজ করেছে। তার বিরুদ্ধে দায়ের করা আরেকটি মামলা মাদকদ্রব্য আইনে। সে মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে অবৈধ মাদক জাতীয় ইয়াবা ট্যাবলেট এবং গাঁজা যানবাহনে নিজ হেফাজতে রাখার অপরাধ। অন্যদিকে শিপ্রা দেবনাথের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, তিনি বিদেশি মদ, দেশীয় চোলাই মদ ও গাঁজা নিজ হেফাজতে রেখেছেন।

পুলিশের ভাষ্য মতে, আত্মরক্ষার জন্য মেজর রাশেদ খানকে গুলি করার পর তাদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, হিমছড়ি নীলিমা রিসোর্টে তাদের অস্ত্রের লাইসেন্স রয়েছে। এরপর সেটি খুঁজতে পুলিশ রিসোর্টে যায়। মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, সে রিসোর্টে গিয়ে একটি কক্ষে শিপ্রা দেবনাথ এবং আরেকটি কক্ষে তাহসিন রিফাত নূরকে পাওয়া যায়। এজাহারে পুলিশ উলেস্নখ করেছে, শিপ্রা দেবনাথের কক্ষ তলস্নাশি করে সেখানে বিদেশি মদ, দেশি চোলাই মদ এবং গাঁজা পাওয়া যায়।

পরিবার কী বলছে?

শিপ্রা দেবনাথের বাড়ি কুষ্টিয়ার মিরপুর থানায়। তার বাবা-মা সেখানেই বসবাস করেন। ঢাকার রামপুরা এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতেন শিপ্রা দেবনাথ। তার মা পূর্ণিমা দেবনাথ টেলিফোনে জানান, গ্রেপ্তারের পর থেকে মেয়ের সঙ্গে তাদের সরাসরি যোগাযোগ হয়নি। কক্সবাজারে অবস্থানরত তাদের পরিচিত এক ব্যক্তির মাধ্যমে সেখানে একজন আইনজীবী ঠিক করা হয়েছে। গ্রেপ্তারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে উপস্থাপনের বাধ্যবাধকতা থাকলেও সেটি করা হয়েছে কি না সে সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই শিপ্রা দেবনাথের মায়ের। শিপ্রা দেবনাথের একমাত্র ভাই প্রান্ত দেবনাথ বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন। সেখান থেকে টেলিফোনে তিনি জানান, বছর খানেক আগে কোনো এক বন্ধুর মাধ্যমে সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের সঙ্গে পরিচয় হয় শিপ্রা দেবনাথের। দুজনেরই আগ্রহের ক্ষেত্র ছিল ইউটিউব চ্যানেলের জন্য ডকুমেন্টারি তৈরি করা। অন্যদিকে সাহেদুল ইসলাম সিফাতের বাড়ি বরগুনার বামনা উপজেলায়।

ঢাকার মধুবাগ এলাকায় খালার বাসায় বসবাস করতেন তিনি। সাহেদুল ইসলাম সিফাতের মা লন্ডনে বসবাস করেন। বাংলাদেশে তার নিকটাত্মীয় বলতে খালা এবং মামা। তার খালু মাসুম বিলস্নাহ বিবিসি বাংলাকে বলেন, গ্রেপ্তারের পরে তাকে আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছিল। তবে মি. সিফাতের মানসিক অবস্থা নিয়ে উদ্বিগ্ন তার খালু। জেল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে গ্রেপ্তারের পর একবার টেলিফোনে কথা বলা সম্ভব হয়েছিল বলে উলেস্নখ করেন তার খালু মাসুম বিলস্নাহ। মাসুম বিলস্নাহ বলেন, 'দেখুন ওর সামনেই গুলির ঘটনা ঘটেছে। ও প্রচন্ড ট্রমার মধ্যে আছে।' শিপ্রা দেবনাথ এবং সাহেদুল ইসলাম সিফাত উভয়ের জন্য একজন আইনজীবী ঠিক করা হয়েছে কক্সবাজারে। আইনজীবী আবুল কালাম আজাদের অফিস থেকে জানানো হয়েছে, উভয়ের জামিনের জন্য আবেদন করা হয়েছে। রোববার জামিনের শুনানি হতে পারে।

উলেস্নখ্য, শুক্রবার (৩১ আগস্ট) রাত সাড়ে ১০টায় কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মেজর সিনহা রাশেদ খান। এ ঘটনায় চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে প্রধান করে একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জন ও নিরাপত্তা বিভাগ। একইভাবে তদন্তের স্বার্থে টেকনাফের বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রের ইনচার্জ লিয়াকত আলিসহ ১৬ পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়। এ ঘটনার পরে ৫ আগস্ট বুধবার কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৯ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন মেজর সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। মামলাটির শুনানিতে সন্তুষ্ট হয়ে তা 'ট্রিট ফর এফায়ার' হিসেবে আমলে নিতে টেকনাফ থানাকে আদেশ দেন আদালতের বিচারক। আদালতের নির্দেশে টেকনাফ থানায় মামলাটি রুজু হয়। দন্ডবিধি ৩০২, ২০১ ও ৩৪ জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা নং সিআর :৯৪/২০২০ইং/টেকনাফ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<107983 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1