এ মাসের শেষে ফের বন্যার আশঙ্কা

প্রকাশ | ০৭ আগস্ট ২০২০, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
ঢাকার নিম্নাঞ্চলে বন্যার পানি ধীরগতিতে নামতে শুরু করেছে -ফাইল ছবি
এ মাসের শেষার্ধে মৌসুমি ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে স্বল্পমেয়াদি বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। এখনো কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নাটোর, জামালপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, রাজবাড়ী, মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, নওগাঁ এই ১৭ জেলার ২৭টি পয়েন্টে নদনদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স কো-অর্ডিনেশন সেন্টার (এনডিআরসিসি) সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে। সূত্র জানায়, আগস্টে বাংলাদেশে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। এ মাসে বঙ্গোপসাগরে এক থেকে দুটি বর্ষাকালীন লঘুচাপ সৃষ্টি হতে পারে, যার মধ্যে একটি বর্ষাকালীন নিম্নচাপে পরিণত হতে পারে। দেশের উত্তরাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলের বিদ্যমান বন্যা পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে উন্নতি হয়ে মধ্যভাগ নাগাদ স্বাভাবিক হয়ে আসতে পারে। আবহাওয়া দপ্তর জানিয়েছে, তবে ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে এ মাসের শেষ নাগাদ ফের স্বল্পমেয়াদি বন্যার সৃষ্টি হতে পারে। আগস্ট মাসের দীর্ঘমেয়াদি আবহাওয়ার পূর্বাভাসে এ তথ্য জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এদিকে বর্তমানে দেশে ধীরগতিতে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। নদনদীর পানি কমতে শুরু করেছে। মানুষজন নিজের বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করেছেন। কেউ কেউ পানিতে ভেসে যাওয়া ঘরের চাল, বেড়া, মেঝে ঠিক করতে শুরু করেছেন। আমাদের মতলব (চাঁদপুর) সংবাদদাতা জানান, পূর্ণিমার প্রভাব কেটে গেলেও দক্ষিণা বাতাসে ফুলে-ফেঁপে উঠেছে পদ্মা-মেঘনা। যার ফলে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। জোয়ারে উত্তাল মেঘনা নদীর পানি তীব্র গতিতে বৃদ্ধি পাওয়ায় চাঁদপুরের মতলব উত্তরে বন্যা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটে রাস্তা ঘাট পস্নাবিত হয়েছে। হাঁটু সমান পানিতে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে উপজেলার বিভিন্ন এলাকা। বৃহস্পতিবার দুপুরের পর থেকেই জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পায়। বিকাল গড়াতেই উপজেলার ছেংগারচর পৌরসভাধীন মেঘনা তীরবর্তী শিকিরচর গ্রামে একটি জরাজীর্ণ ব্রিজসহ নদীঘেঁষা সড়ক রক্ষা দেয়ালটির নানান জায়গায় ফাটল দেখা দেয়। সড়ক ভাঙন রোধে তাৎক্ষণিকভাবে বাঁশ দিয়ে দেয়ালটি অস্থায়ীভাবে টানা দিয়ে রাখে স্থানীয়রা। বর্তমানে গ্রাম বিলীন হওয়ার আশঙ্কায় মারাত্মক আতঙ্কে রয়েছেন এলাকাবাসী। মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে নদী-তীরবর্তী গ্রামের ৪নং শিকিরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টিও। জনৈক অভিভাবক বলেন, 'এই স্কুলটা যদি ভাইঙ্গা যায়, তাইলে আমগো পোলাপাইনেগো কই পড়ামু। পোলাপাইন লইয়া কই যামু? ভয় লাগে, যদি ওয়াল ভাইঙ্গা যায় তয় স্কুলডাও ভাইঙ্গা যাইবো।' ঝুঁকিতে রয়েছে ব্রিজসংলগ্ন পার্শ্ববর্তী এলাকা বাহাদুরপুরের বিদু্যৎ সংযোগের খুঁটিগুলোও। স্থানীয়রা জানান, যেভাবে স্র্রোতের গতি বাড়ছে সেখানে ভয়টা থেকে যায়। এই খুঁটিগুলো যেকোনো সময়ে হেলে পানিতে পড়তে পারে, তখন বিদু্যৎস্পৃষ্ট হয়ে দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। সড়কের পাশে গড়ে ওঠা দোকানগুলো পানিতে ডুবে যাওয়ায় চরম দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন দোকানদাররাও। এ বিষয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আবদুলস্নাহ আল মাহমুদ জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন। পরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা আ'লীগের সাধারণ সম্পাদক, মেঘনা ধনাগোদা সেচ প্রকল্প পানি ব্যবস্থাপনা ফেডারেশনের সভাপতি এম এ কুদ্দুস। শিগগিরই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, বন্যার শঙ্কা থাকলেও মেঘনার পানি জোয়ারে বাড়ে এবং ভাটায় নেমে যায়। তাই এখানে বন্যার পানি স্থিতিশীল থাকছে না। ভাঙন মোকাবিলায় সার্বিক প্রস্তুতি নেওয়া আছে বলে জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ড। নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরী নদীর পানির বৃদ্ধি পাওয়ায় নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুলস্নার তিনটি ইউনিয়নের প্রায় এক হাজার ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে। বন্যার পানি বৃদ্ধির ফলে কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় জীবনযাপন করছে। এছাড়া পানির স্রোতে দুটি এলাকার নির্মাণাধীন ভবন ধসে পানির নিচে তলিয়ে যায়। এতে করে ভবনে থাকা আসবাবপত্র বের করতে না পারায় হতাশ হয়ে পড়েছে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ফতুলস্নার তিনটি ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে সরেজমিন গিয়ে পানির এমন দৃশ্য দেখা যায়। সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, বন্যায় বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরী নদীর পানি বৃদ্ধিতে মঙ্গলবার রাতে পানির স্রোতে ফতুলস্নার কাশিপুর ইউনিয়নের সামসুল আলম মোড় এলাকার রাস্তা ভেঙে গ্রামে পানি প্রবেশ করে ৫০০-৬০০ ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে যায়। এতে করে উত্তর নরসিংপুর এলাকার কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। পরিবার-পরিজন নিয়ে নারী-পুরুষ পানিতে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাস করছে। কেউ কেউ ঘরে মাচা বেঁধে বসবাস করছে আবার অনেকে নিজের বাড়িঘর ছেড়ে একটু নিরাপদ স্থানে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে। আবার অনেক পরিবার খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে। ঘটনার খবর পেয়ে স্থানীয় চেয়ারম্যান এম সাইফউলস্নাহ বাদল ও ইউনিয়ন সদস্য শামীম আহম্মেদ পানিবন্দি লোকদের খোঁজখবর নেন। এদিকে একই উপজেলার বক্তাবলী ইউনিয়নের পূর্ব গোপালনগর এলাকাসহ তিনটি গ্রামের দুই শতাধিক বাড়িঘর পানির নিচে তলিয়ে কয়েকশ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এলাকার মানুষ ঘরের ভিতর পানি থাকায় বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ায় অনেকে মাচা বেঁধে বসবাস করছে। এছাড়া বুধবার পানিবন্দিদের খোঁজখবর নেন নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) নাহিদা বারিক। তিনি পানি ভেঙে পানিবন্দি লোকদের খোঁজখবর নেন এবং সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দেন। কাশিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম সাইফউলস্নাহ বাদল বলেন, বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরী নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় পানির স্রোতে একটি রাস্তা ভেঙে পানি গ্রামে প্রবেশ করে কয়েকশ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তাদের খোঁজখবর নেওয়া হয়েছে এবং সরকারিভাবে সাহায্য-সহযোগিতার ব্যবস্থা করা হবে। নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) নাহিদা বারিক বলেন, বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরী নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নদীবেষ্টিত তিনটি ইউনিয়নের কয়েকশ বাড়িঘর পানির নিচে তলিয়ে গেছে। পানিবন্দি পরিবারের খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে এবং স্থানীয় চেয়ারম্যানদের সঙ্গে আলোচনা করে পানিবন্দি পরিবারদের সরকারিভাবে সাহায্য-সহযোগিতা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। দুর্গাপুর (নেত্রকোনা) প্রতিনিধি জানান, বেড়িবাঁধ না থাকায় ভাঙন আতঙ্কে দিন পার করছে নেত্রকোনার দুর্গাপুর পৌরসভার শিবগঞ্জ-ডাকুমারা এলাকার হাজারো বাসিন্দা। ইতোমধ্যে নদীর ভাঙনে বিলীন হতে চলেছে এই এলাকার নানা স্থাপনা। নতুন করে হুমকির মুখে রয়েছে মসজিদ, মন্দিরসহ ঐহিত্যবাহী শিবগঞ্জ বাজার। ভাঙন রোধে দ্রম্নত ওই এলাকায় স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা। এ নিয়ে বৃহস্পতিবার দুপুরে সরেজমিন গিয়ে জানা যায়, জেলার দুর্গাপুর উপজেলার পাহাড়ি নদী সোমেশ্বরী। শুকনো মৌসুমে নদীতে পানি না থাকলেও বর্ষায় এ নদী ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। প্রতি বছরই পাহাড়ি ঢলে নিম্ন এলাকা পস্নাবিত হয়। ১৯৯১ সালে থেকে এ অঞ্চলে শুরু হয় নদীভাঙনের তীব্রতা। আর তখন থেকেই নদীতে বিলীন হতে থাকে এই এলাকার বসতবাড়ি থেকে শুরু করে নানা স্থাপনা। এ ভাঙন রোধে ২০১০ সালে ডাকুমারা এলাকার কিছু অংশে স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় ছিল অনেক কম। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) নেত্রকোনা জেলার উপ-প্রকৌশলী মো. রহিদুল হোসেন খান জানান, অল্প দিনের ব্যবধানে অত্র এলাকায় পর পর বন্যা হওয়ায় পানির চাপে বেশ কিছু এলাকা ভেঙে গেছে। অত্র এলাকায় স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের জন্য প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারজানা খানম বলেন, ইতোমধ্যে বেড়িবাঁধ সংস্কারের জন্য কিছু বরাদ্দ এসেছে। এ দিয়ে দুর্গাপুর ও গাঁওকান্দিয়া ইউনিয়নে কাজ করা হচ্ছে। শিবগঞ্জ-ডাকুমারা এলাকার মসজিদ, মন্দিরসহ সব স্থাপনা রক্ষায় স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের জন্য প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। কমলনগর (লক্ষ্ণীপুর) প্রতিনিধি জানান, মেঘনা নদীর অস্বাভাবিক জোয়ারে লক্ষ্ণীপুরের কমলনগর ও রামগতির উপকূলীয় ৩০ গ্রাম পস্নাবিত হয়েছে। ফলে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে অন্তত ৪০ হাজার মানুষ। শতাধিক মাছের ঘের ও পুকুর পানিতে তলিয়ে গেছে। গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগির খামার পানিতে ডুবে গেছে, মারা গেছে ৫ হাজার মুরগি। ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে উপকূলীয় কাঁচা-পাকা রাস্তা, ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও চলতি মৌসুমের ধানসহ বিভিন্ন ফসল। এছাড়া শত শত বসতঘরে পানি ঢুকে ক্ষতি হয়েছে আসবাবপত্র ও বিভিন্ন মালামাল। মেঘনা নদীর জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ৬ থেকে ৮ ফুট বেড়ে যায়। এ সময় তীব্র বাতাস ও স্রোতে নদীর পানি ঢুকে পড়ে, মুহূর্তেই বিস্তীর্ণ জনপদ যেন 'সাগরে' রূপ নেয়। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে কমলনগর ও রামগতির উপকূলের লক্ষাধিক মানুষ। অস্বাভাবিক জোয়ারে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো হলো কমলনগর উপজেলার চর কালকিনি, মতিরহাট, চর সামচ্ছুদ্দিন, সাহেবেরহাট, চর মার্টিন, মুন্সিরহাট, চৌধুরী বাজার, কাদির পন্ডিতেরহাট, চর মার্টিন, বলিরপুল, চর লরেন্স, নাছিরগঞ্জ, নোয়াহাট, চর ফলকন, মাতাব্বরহাট এলাকা, পাটারিরহাট। রামগতি উপজেলার চর আবদুলস্নাহ, চর গজারিয়া, চরগাজী, চর আলগী, বড়খেরী, তেলীরচর, আলেকজান্ডার বালুর চর, সুজনগ্রাম, জনতা বাজার ও সেবাগ্রাম।