সিনহা হত্যা মামলা

গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে গায়েব হওয়া ল্যাপটপ-ক্যামেরা

প্রকাশ | ১০ আগস্ট ২০২০, ০০:০০

তানভীর হাসান, ঢাকা ও জাবেদ আবেদীন শাহীন, টেকনাফ
পুলিশের গুলিতে সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা মোহাম্মদ রাশেদের মৃতু্যর ঘটনায় পুলিশের দায়েরকৃত মামলায় গাড়িতে থাকা সিনহার ল্যাপটপ ও ক্যামেরার কথা উলেস্নখ করা হয়নি। ধারণা করা হচ্ছে সেখানে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিল। এ কারণে সিনহাকে হত্যার পর ক্যামেরা ও ল্যাপটপ গায়েব করা হয়। পাশাপাশি সিনহার মৃতু্যর ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় একমাত্র সাক্ষী করা হয়েছে সিফাতকে। যিনি পুলিশের দায়েরকৃত দুটি মামলার আসামি। এজন্য সিফাতও গুরুত্বপূর্ণর্ যাবের কাছে। এ কারণে পুলিশের দায়েরকৃত দুটি মামলারও তদন্ত চায়র্ যাব। আজ সোমবার শুনানি শেষে সিদ্ধান্ত পাওয়ার পর প্রদীপদের রিমান্ডে এনে আনুষ্ঠানিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। সেখানে মুখোমুখি করা হতে পারে সিফাত-লিয়াকত ও প্রদীপকে। এদিকে একের পর এক অভিযোগ আসছে টেকনাফের সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশের নামে। জমি দখল, মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আত্মসমর্পণ ও হুন্ডি ব্যবসার মতো চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এ বিষয় জানতে চাইলের্ যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিলস্নাহ যায়যায়দিনকে বলেন, তদন্তে সিফাতর্ যাবের কাছে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। এ কারণে আদালতে তার জামিন এবং পুলিশের দায়েরকৃত দুটি মামলার তদন্ত চাওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে (সোমবার) আজ শুনানি রয়েছে। আদালতের সিদ্ধান্ত পাওয়ার পর আজ প্রদীপদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তবে জেলগেটে কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আব্দুলস্নাহ আল মামুন ও এএসআই লিটন মিয়াকে জিজ্ঞসাবাদ করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে আসামিদের নাম ঠিকানা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। তিনি বলেন, পুলিশের দায়েরকৃত মামলার তদন্তভার পাওয়ার পর দেখা হবে সেখানে কোন ধরনের আলামতের কথা উলেস্নখ করা হয়েছে। পাশাপাশি সিফাতের কাছ থেকেও বিভিন্ন সূত্রে কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। জামিন পাওয়ার পর তার কাছে বিস্তারিত জেনে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সিহনা বিভিন্ন সময়ে বন্দুকযুদ্ধে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন বলে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে এ বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ কারণে তিনি প্রদীপের টার্গেটে পরিণত হয়েছিলেন কিনা তা তদন্ত শেষে বলা যাবে। তদন্ত তদারক একাধিক সূত্রে জানা গেছে, সিফাত এখনর্ যাবের কাছে গুরুত্বপূর্ণ কি পয়েন্টে। এ কারণে তাকে দ্রম্নতই জিজ্ঞাসাবাদ প্রয়োজন। এ জন্য তার জামিন আবেদন করা হয়েছে। একইসঙ্গে তার নামে দায়েরকৃত মামলার তদন্তভারওর্ যাবকে দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। কারণ ঘটনার পর সিফাত তার খালার কাছে ফোন করে দাবি করে, তাদের কাছে ক্যামেরা ছাড়া কিছুই পায়নি পুলিশ। ২ মিনিটের ওই কলে এসব তথ্য ওঠে এসেছে। কিন্তু পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে মদ, ইয়াবা ও গাঁজা উদ্ধারের কথা সিজার লিস্টে উলেস্নখ্য করেছে। তবে সেখানে সিনহার গাড়িতে থাকা ক্যামেরা, ল্যাপটপ ও ট্রাইপডের কথা উলেস্নখ করা হয়নি। সিনহার গাড়িতে মদ ও গাঁজা কিভাবে এলো তাও তদন্ত করা প্রয়োজন বলে মনে করছের্ যাব। এমনকি রামু থানায় সিনহার সহযোগী শিপ্রার নামে দায়ের করা মামলায় উলেস্নখ করা হয়েছে, আহত অবস্থায় সিনহাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। সেখানে সিনহা পুলিশের কাছে দাবি করেন, তার অস্ত্রের লাইসেন্স রিসোর্টে রয়েছে। এরপর রিসোর্টে অভিযান চালিয়েও মদ-গাঁজা উদ্ধার করা হয় এবং শিপ্রাকে গ্রেপ্তার করা এই। ওই মামলায় গতকাল শিপ্রার জামিন হয়েছে। সেখান থেকে ২ লাখ টাকা উদ্ধার করা হলেও প্রথমে তা সিজার লিস্টে উলেস্নখ করা হয়নি। গতকাল জামিনের পর একটি আলাদা স্স্নিপে টাকার কথা উলেস্নখ করা হয় এবং শিপ্রাকে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য আদালতের অনুমতি চাওয়া হয়েছে। জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর শিপ্রাকেও সাক্ষী হিসেবের্ যাবের সামনে হাজির করা হবে। কারণ হোটেল থেকে সিনহার একটি হার্ডডিস্কও উধাও হওয়ার তথ্য রয়েছে। পাশাপাশি আসলেই হোটেলে কি ঘটেছিল সেটা জানতেই এমন উদ্যোগ নেওয়া হবে বলের্ যাব সূত্রে জানা গেছে। সূত্রমতে, গত ৩ জুলাই থেকে টেকনাফে ট্রাভেল শো ডকুমেন্টারি তৈরির আড়ালে সিনহা আরও কোনো কাজ করছিল কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তা না হলে পুলিশ তার উপর এমন ক্ষিপ্ত ছিল কেন তা বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কারণ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে ওসি প্রদীপ তার শরীরের লাথি মারেন এবং চেহারা বিকৃতির চেষ্টা করেন। এতে ধারণা করা হচ্ছে, অনেক রাগ থেকেই এমনটা করা হয়েছে। এছাড়া তার ল্যাপটপ, ক্যামেরাও গায়েব রয়েছে। সেখানে কোন ধরনের ফুটেজ ছিল তাও জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ কারণে তদন্তের শুরুতে সিফাতের মতো এ দুটি মামলাও অধিক গুরুত্ব বলে ধারণা করা হচ্ছে। একটি অসমর্থিত সূত্রমতে, ট্রাভেল শো'র পাশাপাশি মাদকের রুট ও বন্দুকযুদ্ধে নিহতদের নিয়েও কাজ করছিলেন সিহনা। বিষয়টি টের পেয়ে যায় ওসি প্রদীপ। এ কারণে তার ওপর ক্ষিপ্ত ছিল বলে সূত্রটি দাবি করেছে। এদিকে ওসি প্রদীপ গ্রেপ্তারের পর একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। টেকনাফ থানায় যোগ দেওয়ার আগে তিনি কক্সবাজার জেলার মহেশখালী, উখিয়া, কক্সবাজার সদর মডেল থানা, চট্টগ্রামের পতেঙ্গা, পাঁচলাইশ ও বায়েজিদ বোস্তামী থানায় কর্মরত ছিলেন। ১৯৯৫ সালে চাকরিতে যোগদান করা এই পুলিশ কর্মকর্তা চাকরিজীবনে একাধিবার পুলিশ বিভাগের সর্বোচ্চ সম্মাননা পুরস্কার পিপিএম, বিপিএম পেয়েছেন। তার বাড়ি চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে। ঘুরে ফিরে কক্সবাজারে গড়ে তুলে শক্ত সিন্ডিকেট। তাদের দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হতো। মাদক নির্মূলের উসিলায় ক্রসফায়ারের নামে কন্ট্রাক্ট কিলিং, লোকজনকে জিম্মি করে টাকা আদায়, এমনকি ধর্ষণে সহায়তার অভিযোগও উঠছে তার বিরুদ্ধে। প্রদীপের দানবীয় কর্মকান্ড থেকে রক্ষা পায়নি বোনের জায়গাও! অভিযোগ উঠেছে, অনৈতিক কর্মকান্ডে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন দিয়ে প্রদীপ আয় করেছেন শত শত কোটি টাকা। দেশ-বিদেশে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজারের টেকনাফ থানা থেকে সদ্য প্রত্যাহার হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশের চাকরিজীবনের পুরোটাই সমালোচনা ও বিতর্কে ভরা। বিতর্কিত এই পুলিশ কর্মকর্তা নানা বিতর্কের জন্ম দিয়ে চাকরিজীবনে বরখাস্ত ও প্রত্যাহার হয়েছেন কমপক্ষে পাঁচবার। প্রতিবার অদৃশ্য ক্ষমতাবলে ফিরেছেন স্বপদে। পদে ফিরেই ধারণ করেছেন দানবীয় রূপ। প্রভাবশালী প্রদীপের বিরুদ্ধে যায় এমন কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তাও। ২০১৫ সালে চট্টগ্রামের এক শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে বায়েজিদ বোস্তামী থানায় মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানির অভিযোগ ওঠে ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে। অভিযোগ তদন্তে গঠিত কমিটি ঘটনার সত্যতা পাওয়ায় তিনি বরখাস্ত হন। তবে তাকে বহাল করার জন্য দেশের অনেক ক্ষমতাধর ব্যক্তি ফোন করেছেন পুলিশের নীতিনির্ধারকদের কাছে। অল্পদিনের মধ্যেই প্রদীপ চাকরি ফিরে পেয়ে পুনরায় বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। তবে এর আগে ২০১৩ সালে একটি মামলার বিরোধিতা করায় এক আইনজীবীকে তুলে নিয়ে নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে পাঁচলাইশ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় প্রদীপসহ আট পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা করেন ওই আইনজীবী। একই বছরের ২৪ মে পাঁচলাইশ থানার পাশের একটি কমিউনিটি সেন্টার থেকে শিবির আখ্যা দিয়ে ৪০ ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাকে আটক করেন প্রদীপ। ওই সময় তিনি ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাকর্মীদের হাতে লাঞ্ছিতও হন। পাঁচলাইশে ওসি থাকাকালে বাদুড়তলায় বোরকা পরা এক বৃদ্ধাকে রাজপথে পিটিয়ে রক্তাক্ত জখম করে ব্যাপক সমালোচিত হন প্রদীপ। এ ঘটনার পর সারা দেশে তোলপাড় হয়। এরপর পাঁচলাইশ থানা থেকে প্রত্যাহার করা হয় ওসি প্রদীপকে। ২০১২ সালে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) পতেঙ্গা থানার ওসির দায়িত্ব পালনকালে আদালতের অনুমতি ছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরে আসা বিদেশি জাহাজকে তেল সরবরাহে বাধা দেওয়া, বার্জ আটক এবং বার্জ মালিকসহ ১২ ব্যক্তিকে মামলা দিয়ে হয়রানির অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। এসব ঘটনা ফাঁস হলে প্রশাসনে ব্যাপক তোলপাড় হয়। পুলিশ সদর দপ্তর গঠিত তদন্ত কমিটি প্রদীপকে অভিযুক্ত করলে পতেঙ্গা থানা থেকে তাকে প্রত্যাহার করা হয়। সিএমপির কোতোয়ালির উপপরিদর্শক (এসআই) থাকাকালে নগরের পাথরঘাটার এক হিন্দু বিধবা মহিলার জমি দখলের অভিযোগ ওঠে প্রদীপের বিরুদ্ধে। একই সময়ে প্রদীপ কুমারের রোষানল থেকে রেহাই পাননি তার নিজের পরিবারের সদস্যও। নগরের পাঁচলাইশ থানা এলাকায় এক বোনের জমি দখলের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সর্বশেষ কক্সবাজারের টেকনাফ থানার ওসি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে কাউকে পাত্তাই দিতেন না প্রদীপ। গত তিন বছরে মাদকবিরোধী অভিযানে বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে চলতি মাস পর্যন্ত ১৪৪টি বন্দুকযুদ্ধে ২০৪ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে শুধু প্রদীপের নেতৃত্বেই ১৫০ জন প্রাণ হারিয়েছে। গত ১৩ জুলাই চট্টগ্রামের চন্দনাইশ থেকে টেকনাফে নিয়ে যাওয়া হয় ফারুক ও আজাদ নামে দুই ভাইকে। তাদের ধরে নিয়ে যাওয়ার তিন দিনের মাথায় দুই ভাইয়ের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়। নিহত দুই যুবকের বোন আইরিন আকতার বলেন, 'আমার দুই ভাইকে ধরে নিয়ে ওসি প্রদীপ ৮ লাখ টাকা দাবি করেন। উলেস্নখ্য, শুক্রবার (৩১ আগস্ট) রাত সাড়ে ১০টার দিকে কক্সবাজার- টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মেজর সিনহা রাশেদ খান। এ ঘটনায় চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে প্রধান করে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জন ও নিরাপত্তা বিভাগ। একইভাবে তদন্তের স্বার্থে টেকনাফের বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ লিয়াকত আলীসহ ১৬ পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়। এ ঘটনার পরে ৫ আগস্ট বুধবার কক্সবাজার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৯ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন মেজর সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। মামলাটির শুনানিতে সন্তুষ্ট হয়ে তা 'ট্রিট ফর এ ফায়ার' হিসেবে আমলে নিতে টেকনাফ থানাকে আদেশ দেন আদালতের বিচারক। আদালতের নির্দেশে টেকনাফ থানায় মামলাটি রুজু হয়। দন্ডবিধি ৩০২, ২০১ ও ৩৪ জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা নং সিআর: ৯৪/২০২০ইং/টেকনাফ। এই মামলায় ৭ জন আত্মসমর্পণ করেন। আদালত তিন দফা শুনানি শেষে তাদের সবাইকে ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। আসামিরা হচ্ছেন- টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, গুলিবর্ষণকারী ইন্সপেক্টর লিয়াকত, এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আব্দুলস্নাহ আল মামুন ও এএসআই লিটন মিয়া। মামলার অপর দুই আসামি এসআই টুটুল ও কনস্টেবল মোস্তফার নামে জেলায় কোনো পুলিশের সন্ধান পাওয়া যায়নি।