টেকনাফে বন্দুকযুদ্ধের পর মামলাবাণিজ্য

প্রকাশ | ১২ আগস্ট ২০২০, ০০:০০

তানভীর হাসান, ঢাকা ও আরাফাত সানী, টেকনাফ
বন্দুকযুদ্ধের পর একাধিক ব্যক্তির নাম উলেস্নখ করে মামলা দায়েরের পর ওই আসামিদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতেন টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও বর্তমান ইন্সপেক্টর তদন্ত এবিএম দোহা। অজ্ঞাত আসামির তকমা দিয়েও ধরে আনা হতো নিরীহদের। পরে তাদের কাছ থেকেও বাণিজ্য করার মতো গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ধরনের একাধিক অভিযোগের পর দ্রম্নতই টেকনাফ থানায় শুদ্ধ অভিযান চালানো হবে। পাশাপাশি জেলাপর্যায়েও ব্যাপক রদবদলের সম্ভাবনা রয়েছে। এদিকে, পুলিশের দায়েরকৃত মামলার তিন সাক্ষীকে গ্রেপ্তার করেছের্ যাব। মো. আয়াছ, মো. নুরুল আমীন ও মো. নাজিমুদ্দিন নামে ওই তিনজনের বিরুদ্ধে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ হত্যায় সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। ঘটনার দিন তারাই সিনহাকে ডাকাত বলে সন্দেহ করে। এমন পরিস্থিতিতে গতকাল দুপুরে গ্রেপ্তারের পর ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে তাদের আদালতে পাঠানো হয়েছে। এদিকে, সদ্য জামিনে মুক্তি পাওয়া শিপ্রা দেবনাথ ও সিফাতের জবানবন্দিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। তাদের কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার পর মামলার প্রধান আসামি লিয়াকত হোসেন, সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিতকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। যদিও এরই মধ্যে জেলগেটে মামলার অপর আসামি কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আব্দুলস্নাহ আল মামুন ও এএসআই লিটন মিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছের্ যাব। পাশাপাশি তাদেরও ১০ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়েছে। র্ যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিলস্নাহ যায়যায়দিনকে বলেন, অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যায় তাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়ায় গ্রেপ্তার করে রিমান্ড চাওয়া হয়েছে। এছাড়া রিমান্ডে থাকা অপর আসামিদেরও পরিকল্পনা অনুযায়ী জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে শিপ্রা দেবনাথ ও সিফাতের জবানবন্দিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জানা গেছে, কক্সবাজারের সীমান্ত উপজেলার টেকনাফের লামার বাজার এলাকার আলোচিত ইয়াবা কারবারি ইয়াছিন আরাফাত 'ক্রসফায়ারে' নিহত হওয়ার পর পুলিশের দায়ের করা মামলা নিয়েও বাণিজ্য করেছে টেকনাফ থানা পুলিশ। অভিযোগ উঠেছে, অস্বাভাবিক মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ওই মামলার চার্জশিট থেকে চারজন আলোচিত ইয়াবা কারবারি ও হুন্ডি ব্যবসায়ীর নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর দাবি, টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বর্তমান পরিদর্শক (তদন্ত) এবিএম দোহা ও পরিদর্শক (অপারেশন) রাকিবুল হাসানের নেতৃত্বে একটি পুলিশি সিন্ডিকেট পুরো মামলাটি নিয়ে বাণিজ্য করেছে। প্রদীপ কুমার দাশের বিদায়ের পরও ওই চক্রটিই এখন টেকনাফ থানার পুরো নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। থানা সূত্র জানিয়েছে, টেকনাফের লামার বাজার এলাকার ইয়াবা কারবারি ইয়াছিন আরাফাতকে আটক করা হয় ২০১৯ সালের ১৮ মার্চ। পরদিন ১৯ মার্চ ওই ইয়াবা কারবারি পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। ওই ঘটনায় পুলিশ ২২ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করে। ওই মামলার বাদী ছিলেন উপপরিদর্শক (এসআই) বোরহান। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলেন পুলিশ পরিদর্শক (অপারেশন) রাকিবুল হাসান। আর পুরো মামলাটি দেখভাল করেছেন পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) এবিএম দোহা। অভিযোগ রয়েছে, এই মামলা থেকে চারজন আলোচিত ইয়াবা কারবারি ও হুন্ডি ব্যবসায়ীকে বাদ দিয়ে ১৮ জনের নামে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। বিনিময়ে হাতিয়ে নেওয়া হয় মোটা অঙ্কের টাকা। চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়া আসামিরা হচ্ছেন- টেকনাফের কুলাল পাড়ার কাদেরের ছেলে সাইফুল, টেকনাফের শীলবুনিয়া পাড়ার সোলেমানের ছেলে শফিক, চট্টগ্রামের সাতকানিয়া এলাকার মো. ওসমান ও বার্মাইয়ার সৈয়দ করিম। এদের মধ্যে মো. ওসমান শীর্ষ হুন্ডি ব্যবসায়ী এবং অন্য তিনজন তালিকাভুক্ত আলোচিত ইয়াবা কারবারি। সূত্র মতে, শুধু ইয়াসিনের মামলায় নয়। এ ধরনের শতাধিক মামলা থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন প্রদীপের টিমের সদস্যরা। গত ১১ ফেব্রম্নয়ারি টেকনাফের মাছ ব্যবসায়ী আব্দুস সালামকে তুলে আনেন প্রদীপের সহযোগীরা। এরপর ২৩ ফেব্রম্নয়ারি তিনি বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। ওই মামলায় আসামি করা হয় সালামের ভাগ্নি নাসিমাকে। পরে নাসিমার কাছ থেকেও মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। এছাড়া অজ্ঞাত আসামির তকমা দিয়ে তুলে আনা হয় আরও অন্তত ১০ জনকে। পরে তাদের সবার কাছ থেকেই টাকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। ভুক্তভোগী অনেকেই নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, প্রদীপ কুমার দাশ অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে সাময়িক বহিষ্কার হওয়ার পরও পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) এবিএম দোহা, পুলিশ পরিদর্শক (অপারেশন) রাকিবুল হাসান, এসআই রাসেল, এসআই সাব্বির, এসআই মশিউর রহমান, এএসআই নাজিম উদ্দিন, কনস্টেবল আবদুলস্নাহ ও কনস্টেবল রুমান দাশ বহাল রয়েছেন। এ কারণে তাদের ভয়ে এখনো এলাকার অনেকে মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছে না। ইশারা-ইঙ্গিতে হুমকি দেওয়ারও অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে বলে অনেকে দাবি করেছেন। এ বিষয়ে টেকনাফ মডেল থানার সদ্য যোগদান করা ওসি মো. আবুল ফয়সল জানান, বিষয়টি আমি খতিয়ে দেখে ঊর্ধ্বতনদের অবহিত করব। টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল বশর বলেন, প্রদীপের হয়রানি থেকে সাধারণ মানুষ আপাতত মুক্তি পেলেও তার অপকর্মের সঙ্গীরা থানায় রয়েছেন। দ্রম্নত তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। সেটি না হলে এই চক্র আবারও মানুষকে ফাঁদে ফেলবে। সবার দোয়া চেয়েছেন শিপ্রা ও সিফাত এদিকে, জামিনে মুক্তি পাওয়া শাহেদুল ইসলাম সিফাত ও শিপ্রা দেবনাথ সুস্থ আছেন বলে জানিয়েছেন। গত সোমবার (১০ আগস্ট) রাতে কক্সবাজারের একটি আবাসিক হোটেলে গণমাধ্যমকে তারা একথা জানান। এ সময় সিফাত তার বিরুদ্ধে করা মামলায় ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করেন। কক্সবাজার জেলা কারাগার থেকে বের হওয়ার পর একটি নম্বরবিহীন গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে যেই গুঞ্জনটি গণমাধ্যমে ছড়িয়েছে সেটি ঠিক নয় উলেস্নখ করে সিফাত সাংবাদিকদের বলেন, ওই গাড়িটি তার পারিবারিক গাড়ি ছিল। সবার কাছে দোয়া চেয়ে শিপ্রা বলেন, 'আমি আপনাদের প্রতি অনেক কৃতজ্ঞ। আপনারা আমাদের পাশে ছিলেন, পাশে থাকবেন। আপাতত এতটুকুই বলার আছে। আমরা প্রত্যেকটা কথা বলব।' সিফাত সাংবাদিকদের বলেন, 'অনেক গণমাধ্যমে আমার পায়ে গুলি লেগেছে বলে সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে। এটা সঠিক নয়। মানসিকভাবে ও শারীরিকভাবে আমি সম্পূর্ণ সুস্থ আছি। আমার পায়ে গুলি লাগেনি। আশা করি সুষ্ঠু তদন্ত হবে। আমরা রাষ্ট্রের কাছে কৃতজ্ঞ। এতদিন জেলে ছিলাম, তাই কিছুই জানতে পারিনি। এখন জেল থেকে বের হয়ে দেখছি প্রায় সব মিডিয়া আমাদের জন্য লিখেছে।' তারা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আপাতত আরও কয়েকদিন কক্সবাজারে অবস্থান করবেন বলেও জানান শিপ্রা ও সিফাত। উলেস্নখ্য, শুক্রবার (৩১ জুলাই) রাত সাড়ে ১০টার দিকে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা রাশেদ খান। এ ঘটনায় চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে প্রধান করে একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জন ও নিরাপত্তা বিভাগ। একইভাবে তদন্তের স্বার্থে টেকনাফের বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ লিয়াকত আলিসহ ১৬ পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়। এ ঘটনার পরে ৫ আগস্ট বুধবার কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৯ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। মামলাটির শুনানিতে সন্তুষ্ট হয়ে তা 'ট্রিট ফর এফায়ার' হিসেবে আমলে নিতে টেকনাফ থানাকে আদেশ দেন আদালতের বিচারক। আদালতের নির্দেশে টেকনাফ থানায় মামলাটি রুজু হয়। দন্ডবিধি ৩০২, ২০১ ও ৩৪ জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা নং সিআর : ৯৪/২০২০ইং/টেকনাফ। এই মামলায় ৭ জন আত্মসমর্পণ করেন। আদালত তিন দফা শুনানি শেষে তাদের সবাইকে ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। আসামিরা হচ্ছেন- টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, গুলিবর্ষণকারী ইন্সপেক্টর লিয়াকত, এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আব্দুলস্নাহ আল মামুন ও এএসআই লিটন মিয়া। মামলার অপর দুই আসামি এসআই টুটুল ও কনস্টেবল মোস্তফার নামে জেলায় কোনো পুলিশের সন্ধান পাওয়া যায়নি।