দুদকের মামলায় এস কে সিনহার বিচার শুরু

সাবেক ফারমার্স ব্যাংক থেকে চার কোটি টাকা ঋণ স্থানান্তর ও আত্মসাতের অভিযোগ

প্রকাশ | ১৪ আগস্ট ২০২০, ০০:০০

বিশেষ সংবাদদাতা
এস কে সিনহা
জালিয়াতির মাধ্যমে বহুল আলোচিত সাবেক ফারমার্স ব্যাংক থেকে নেওয়া চার কোটি টাকা ঋণ স্থানান্তর ও আত্মসাতের অভিযোগে দুদকের করা মামলায় দেশে অনুপস্থিত সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাসহ (এস কে সিনহা) ১১ আসামির বিচারকাজ শুরু হয়েছে। বৃহস্পতিবার ঢাকার চতুর্থ বিশেষ জজ আদালতের বিচারক শেখ নাজমুল আলম অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচারকাজ শুরুর নির্দেশ দেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো সাবেক প্রধান বিচারপতি দুর্নীতিতে অভিযুক্ত হলেন। তাকে পলাতক দেখিয়েই এ মামলার বিচারকাজ চলবে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আগামী ১৮ আগস্ট দিন ধার্য করা হয়েছে। এস কে সিনহাসহ আট আসামি পলাতক থাকায় তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি রয়েছে। এর আগে দুদকের অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে গত ৫ জানুয়ারি এসকে সিনহাসহ অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিল ঢাকার জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ আদালত। মামলায় অভিযোগ গঠনের জন্য ২৩ এপ্রিল দিন ধার্য ছিল। তবে করোনা পরিস্থিতির কারণে আদালত বন্ধ থাকায় তা পিছিয়ে ১৩ আগস্ট ধার্য হয়। সে অনুযায়ী বৃহস্পতিবার আদালত বিচার শুরুর আদেশ দিলেন। গত ২০ ফেব্রম্নয়ারি মামলাটি বিচারের জন্য এ আদালতে বদলির আদেশ দেন ঢাকার মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ কে এম ইমরুল কায়েশ। মামলার ১১ আসামির মধ্যে দুইজন বর্তমানে জামিনে রয়েছেন। অন্য মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো একজনকে এ মামলায় গ্র্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। বাকি ৮ জনের বিরুদ্ধে গ্র্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। জামিনে থাকা দু'জন হলেন, ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমান পদ্মা ব্যাংক লিমিটেড) সাবেক এমডি এ কে এম শামীম ও এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সাবেক ক্রেডিট প্রধান গাজী সালাহউদ্দিন। তারা গত ২০ ফেব্রম্নয়ারি আইনজীবীর মাধ্যমে আত্মসমর্পণ করে জামিন নিয়েছেন। অন্য মামলায় গ্র্রেপ্তার থাকা মো. মাহবুবুল হক চিশতী (বাবুল চিশতী) বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। তদন্তকালে এজাহারে নাম থাকা আসামি ফারমার্স ব্যাংকের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সাবেক শাখা ব্যবস্থাপক (গুলশান) মো. জিয়া উদ্দিন আহমেদ মারা যাওয়ায় তাকে এ মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। পলাতক ৮ আসামি হলেন-সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা, ফারমার্স ব্যাংকের তৎকালীন ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট স্বপন কুমার রায়, ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট সফিউদ্দিন আসকারী আহমেদ, ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. লুৎফুল হক, এস কে সিনহার কথিত পিএস শ্রী রনজিৎ চন্দ্র সাহা, তার স্ত্রী শ্রীমতি সান্ত্রী রায় (সিমি), টাঙ্গাইলের মো. শাহজাহান, নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা। এদিন আদালতে উপস্থিত থেকে মামলার তিন আসামি নিজেদের নিরপরাধ দাবি করে আদালতের কাছে ন্যায়বিচার চান। জামিনে থাকা ফারমার্স ব্যাংকের সাবেক এমডি এ কে এম শামীম এবং সাবেক এসইভিপি গাজী সালাহউদ্দিন এবং অডিট কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান কারাগারে থাকা মাহবুবুল হক চিশতী ওরফে বাবুল চিশতী নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন। এ মামলায় দুদকের অন্যতম আইনজীবী রুহুল ইসলাম খান জানান, আদালতে হাজির তিন আসামিকে নিয়ম অনুযায়ী অভিযোগ শুনিয়ে জানতে চাওয়া হয় তারা দোষী না নির্দোষ। শামীম, সালাহউদ্দিন ও বাবুল চিশতী নিজেদের নির্দোষ দাবি করে সুবিচার চান। তাদের আইনজীবীরা মামলা থেকে অব্যাহতিরও আবেদন করেন। শুনানি শেষে বিচারক পলাতক আটজনসহ ১১ আসামির সবার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর সিদ্ধান্ত দেন। নানা নাটকীয় ঘটনা ও বিতর্কের সূত্র ধরে সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা তিন বছর আগে বিদেশে পাড়ি জমান। এরপর দুদক অভিযোগ পায়, তিনি ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে ব্যবসায়ী পরিচয়ে দুই ব্যক্তির নেওয়া ঋণের চার কোটি টাকা নিজের অ্যাকাউন্টে নিয়েছিলেন। অভিযোগ পেয়ে ওই বছরই তদন্তে নামে দুদক। দীর্ঘ তদন্তে পর গত বছরের ১০ জুলাই সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন। মামলায় তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ভুয়া ঋণের মাধ্যমে চার কোটি টাকা স্থানান্তর ও আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়। এরপর গত ৪ ডিসেম্বর এ মামলায় অভিযোগপত্র অনুমোদন দেয় সংস্থাটি। দুদক কর্মকর্তা বেনজির আহমেদ গত বছর ৯ ডিসেম্বর ১১ জনকে আসামি করে এ মামলার অভিযোগপত্র দেন। তদন্ত কর্মকর্তার আবেদনে এস কে সিনহার ব্যাংক হিসাবের চার কোটি টাকা জব্দ করা হয়। একই বছরের ৯ ডিসেম্বর সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় দুদক। পরে মামলাটি বিচারের জন্য ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪-এ পাঠানো হয়। দুদকের করা মামলায় ভুয়া তথ্য দিয়ে ফারমার্স ব্যাংক (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) থেকে অন্যের নামে চার কোটি টাকার ঋণ সৃষ্টি করে পরে তা এস কে সিনহার ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করার অভিযোগ আনা হয়। অভিযোগে বলা হয়, সেই ব্যাংক হিসাব থেকে পরবর্তী সময়ে টাকা স্থানান্তর ও রূপান্তরের মাধ্যমে পাচার করা হয়। মামলার তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় তদন্ত কর্মকর্তার সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমানে বিদেশে অবস্থানরত এস কে সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র অনুমোদন দেওয়া হয়। তদন্ত শেষে নতুন করে আসামি হয়েছেন ফারমার্স ব্যাংকের নিরীক্ষা কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী (বাবুল চিশতী)। অভিযোগপত্রে বলা হয়, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে অসৎ উদ্দেশ্যে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ফারমার্স ব্যাংকে ভুয়া ঋণ সৃষ্টি করে সেই টাকা বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর, উত্তোলন ও পাচার করেছেন। যা দন্ডবিধির ৪০৯/৪২০/১০৯ ধারা, ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা এবং ২০১২ সালের মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ৪(২)(৩) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। মামলার এজাহারে বলা হয়, আসামিরা অসৎ উদ্দেশে পরস্পর যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রতারণার মাধ্যমে ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে অত্যন্ত দ্রম্নততার সঙ্গে চার কোটি টাকা ভুয়া ঋণ নিয়ে একই দিনে পে-অর্ডারের মাধ্যমে ব্যক্তিগত হিসাবে স্থানান্তর করেন। পরে ওই টাকা ব্যক্তিগত হিসাব থেকে অস্বাভাবিক নগদে এবং চেক ও পে-অর্ডারের মাধ্যমে অন্য হিসাবে হস্তান্তর ও রূপান্তরের মাধ্যমে আত্মসাৎ করেছেন। একই সঙ্গে ওই টাকার উৎস ও অবস্থান গোপনের মাধ্যমে পাচার বা পাচারের চেষ্টায় সম্পৃক্ত ছিলেন। এজাহারে বলা হয়েছে, জনৈক মো. শাহজাহান ও নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখায় আলাদা দুটি চলতি হিসাব খোলেন। পরদিনই তারা দুই কোটি করে চার কোটি টাকা ঋণের আবেদন করেন। ব্যাংকে হিসাব খোলা এবং ঋণ আবেদনপত্রে দুজনই তাদের ঠিকানা বাড়ি নম্বর ৫১, সড়ক নম্বর ১২, সেক্টর ১০, উত্তরা আবাসিক এলাকা উলেস্নখ করেন। অনুসন্ধানে দেখা যায়, ওই বাড়ি সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার ব্যক্তিগত বাড়ি। এজাহারে অভিযোগ করা হয়েছে, ঋণের আবেদন দুটি কোনো রকম যাচাই-বাছাই, রেকর্ডপত্র বিশ্লেষণ এবং ব্যাংকের কোনো নিয়ম-নীতি মানা হয়নি। বলা হয়, ঋণপ্রাপ্তির পরদিনই অনুমোদিত চার কোটি টাকার পৃথক দুটি পে-অর্ডার সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নামে ইসু্য করা হয়। পরে ওই পে-অর্ডার সোনালী ব্যাংকের সুপ্রিম কোর্ট শাখায় এস কে সিনহার হিসাবে জমা হয়। তিনি বিভিন্ন সময়ে অস্বাভাবিক ক্যাশ ও চেক/পে-অর্ডারের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তিকে দিয়ে ওই অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তোলেন। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় এবং কিছু পর্যবেক্ষণের কারণে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা। ২০১৭ সালের অক্টোবরে ছুটিতে যান তিনি। পরে বিদেশ থেকেই তিনি পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন। দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করে আসা বিচারপতি সিনহা যুক্তরাষ্ট্রে বসেই ২০১৮ সালে প্রকাশিত বইতে দাবি করেন, তাকে 'পদত্যাগে বাধ্য করে নির্বাসনে' পাঠানো হয়েছে। একই বছর ফেব্রম্নয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে আবেদন করেছিলেন বহুল আলোচিত এস কে সিনহা। সে সময় তিনি নিউ জার্সিতে ছোট ভাই অনন্ত কুমার সিনহার নামে কেনা একটি বাড়িতে থাকতেন। পরে ২০১৯ সালের জুলাই মাসে জানা যায়, সিনহা যুক্তরাষ্ট্র থেকে কানাডায় গিয়ে সেখানে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন। বিচারপতি সিনহা ছুটি নিয়ে বিদেশ যাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থ পাচার, আর্থিক অনিয়ম ও নৈতিক স্খলনসহ সুনির্দিষ্ট ১১টি অভিযোগ পাওয়ার কথা জানানো হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে। \হ