শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সিনহার দেখা স্বপ্নটুকু বাঁচাতে চাই: শিপ্রা

বিডিনিউজ
  ১৪ আগস্ট ২০২০, ০০:০০
তথ্যচিত্র নির্মাণের সময় ক্যামেরাবন্দি শিপ্রা দেবনাথ

ঢাকার স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজের ছাত্রী শিপ্রা দেবনাথের ছিল ফিল্ম বানানোর নেশা আর দুই বছর আগে সেনাবাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের স্বপ্ন ছিল বিশ্বভ্রমণ। সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে বেড়াতে গিয়ে তাদের পরিচয়, বন্ধুত্ব; সেখান থেকেই 'জাস্ট গো'র শুরু।

এর ধারাবাহিকতায় গড়ে ওঠে চারজনের একটি দল, উদ্দেশ্য ছিল ট্র্যাভেল ডকুমেন্টারি তৈরি করা। সিনহা আর শিপ্রার সঙ্গে এই দলে ছিলেন সাহেদুল ইসলাম সিফাত আর তাহসিন রিফাত নূর।

চারজনের এই দলটি জুলাইয়ের শুরুতে কক্সবাজারে গিয়ে ডকুমেন্টারির জন্য কাজ শুরু করে। কিন্তু ৩১ জুলাই রাতে বাহারছড়া চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার মৃতু্য বদলে দেয় সব।

শিপ্রা বলছেন, তারা শুধু 'জাস্ট গো'র জন্য শুটিং করতেই কক্সবাজারে গিয়েছিলেন, এর বাইরে আর কোনো উদ্দেশ্য তাদের ছিল না।

বুধবার এক সাক্ষাৎকারে সিনহার সঙ্গে পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব, ডকুমেন্টারি নির্মাণের পরিকল্পনা, নওগাঁর আলতাদীঘিতে প্রথম ভিডিও শুটিং এবং এরপর কক্সবাজারে গিয়ে সিনহার

\হমৃতু্যর আগ পর্যন্ত ঘটনাবলির বিস্তারিত তুলে ধরেছেন শিপ্রা।

সিনহা টেকনাফে 'ইয়াবার কারবার ও ক্রসফায়ার নিয়ে' ওসি প্রদীপ কুমার দাশের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন এবং সেটাই তার 'কাল হয়েছিল' দাবি করে প্রচারিত খবরের সত্যতা নাকচ করেন শিপ্রা দেবনাথ।

তিনি বলেন, 'এটা সম্পূর্ণ গুজব। কক্সবাজারে ভিডিও ধারণ করার জন্য জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়া হয়েছিল। ওখানে একদম নির্দিষ্ট করে উলেস্নখ ছিল, কোনো রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা আমাদের নাই, শুধুমাত্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ধারণ ব্যতীত দ্বিতীয় কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। ইসু্যকৃত এই কাগজটি সবসময় নিজেদের কাছে রেখেছি। কাগজটি সিনহার গাড়িতে সবসময় থাকত।'

তবে সিনহা হত্যাকান্ড বা মামলা সম্পর্কে বেশি কিছু বলতে চাননি শিপ্রা। তার ভাষায়, কোনো কথার কারণে এ মামলার ক্ষতি হোক, তা তিনি চান না।

শিপ্রা বলেন, 'আমি আগেও বলেছি, আমি জাস্টিস চাই। সিনহাকে কেন মারা হলো, আমাদের কেন ধরা হলো, আমরা কেন অনিশ্চিত একটা সময় কাটাচ্ছি, যে স্বপ্নের জন্য আমরা এত কিছু হারালাম, এত ঝড়-ঝাপটা পেরুলাম, সেই স্বপ্নটাও আসলে সাম হাউ কেউ কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। এই স্বপ্নটুকু বাঁচাতে চাই, জাস্টিস চাই। আর যেহেতু আমি বিচার চাই, সেহেতু আমি চুপ থাকতে চাই। আপাতত তদন্তের স্বার্থে আমি চুপ করে থাকতে চাই।... আমি কোনো ভুল পদক্ষেপ নিতে চাই না এখন।'

শিপ্রা আরও বলেন, প্রতিটি সত্য, কী ঘটেছিল, কেন বা কাহারা বা কীভাবে এত কিছু- এর প্রতিটি সত্য আমি বলতে চাই। আমার বুকের ভেতরে খুব কষ্ট নিয়ে এইগুলো জমা করে রেখেছি। এর প্রত্যেকটি কথা আমি সবাইকে বলতে চাই। কিন্তু এর জন্য আসলেই আমার সময় লাগবে। আমি যদি এখনই সব কিছু বলে ফেলি, তাহলে এটা খারাপ হতে পারে। আমি চাই না, এই মামলার নূ্যনতম কোনো ক্ষতি হোক। এ কারণে আইনি কোনো কথা আমি বলতে চাই না। আমার স্বপ্নটাকে বাঁচানো জরুরি।

এ কারণে আপাতত শুধু 'জাস্ট গো' নিয়েই কথা বলে যাচ্ছেন মন্তব্য করে তিনি বলেন, সিনহা যে স্বপ্নটি দেখতে দেখতে মারা গেছে, যে স্বপ্নের জন্য মারা গেছে, আমি তো শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত সেই স্বপ্নটা মেরে ফেলতে দেব না। আমি সেই স্বপ্নটা বহন করতে চাই, শেষ পর্যন্ত।

শিপ্রা জানান, বেড়ানোর আগ্রহ তার সব সময়ই ছিল। বছর দেড়েক আগে সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে ঘুরতে গিয়েই সিনহার সঙ্গে তার পরিচয় এবং পরে বন্ধুত্ব হয়।

সিনহার পাগলামির জায়গা ছিল ট্রাভেলিং আর আমার ফিল্মিং। সিনহা সৃজনশীল ছিলেন, জ্ঞানী ছিল, প্রচুর পড়াশুনা করত। বন্ধু হিসেবে কখন মানুষ কাছে আসে, যখন তাদের চিন্তাভাবনার মিল থাকে। আমাদেরও তা-ই হয়েছিল।

ঘোরাঘুরির এই আগ্রহ থেকেই তারা ভ্রমণ বিষয়ক প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ এবং তা ফেসবুক, ইউটিউবে প্রকাশ করার পরিকল্পনা করেন বলে জানান ফিল্মের ছাত্রী শিপ্রা। এই পরিকল্পনা থেকেই 'জাস্ট গো' নামের ফেসবুক পেইজ ও ইউটিউব চ্যানেল খোলার সিদ্ধান্ত হয়।

সিনহার মূল পরিকল্পনা ছিল বিশ্ব ভ্রমণ। যখন আমার পস্ন্যান শুনল, বলল, এটা অনেক সহজ, এটা যদি করি, তাহলে ওয়ার্ল্ড টু্যরটা করতে পারব এক সঙ্গে।

ডকুমেন্টারির নাম কীভাবে ঠিক হলো, সে কথা জানিয়ে শিপ্রা বলেন, নাম ঠিক করা নিয়ে আলোচনা চলছিল। এক সময় আমি মজা করে বলেছিলাম 'জাস্ট গো'। সিনহা অনেকক্ষণ চিন্তা করল, তারপর বলল, 'জাস্ট গো ইজ বেটার'। আর এভাবেই 'জাস্ট গো' নাম হয়।

তাদের প্রথম কাজটি হয় গত মার্চ-এপ্রিলে নওগাঁর আলতাদীঘিতে। কিন্তু শুটিংয়ের ইকুইপমেন্ট সেখানে ছিল না বলে ভিডিও ধারণ করা হয়েছিল একটি আইফোন দিয়ে। সেই ভিডিওটাই এখন অনলাইনে ভাইরাল হয়েছে, যেখানে ভয়েসওভারের কণ্ঠটি সিনহার বলে জানান শিপ্রা।

তবে এখন জাস্ট গোর অফিসিয়াল পেইজে আলতাদীঘির যে ভিডিওটি আছে, সেটি আরও পরিমার্জিত সংস্করণ। সেখানে অন্য একজন পেশাদার আর্টিস্টের কণ্ঠ রয়েছে।

শিপ্রা বলেন, জাস্ট গো-এর মাধ্যমে আমরা জ্ঞান চর্চার গুরুত্ব তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। বই পড়ার অভ্যাস মানুষের কমে যাচ্ছে। সেই বিষয়টিকে নজরে আনা। দেশের ভেতরই আমরা কিছু জায়গাকে তুলে ধরার চেষ্টা করছি, যে জায়গায় মানুষ সাধারণত যায় না। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল, কফি, বই আর বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়া পস্নাস্টিক পণ্যকে সংগ্রহ করে সচেতনতা তৈরি করা।

আলতাদীঘিতে কাজ শেষে পরবর্তী শুটিংয়ের জন্য কক্সবাজারকে বেছে নেন সিনহা, শিপ্র-সিফাতরা।

শিপ্রা বলেন, ওই সময় খবর আসছিল, লকডাউনের কারণে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত অনেক পরিষ্কার ছিল, বিভিন্ন ধরনের কচ্ছপ আসছিল, সৈকতে ডলফিন আসছিল। এছাড়া কক্সবাজার থেকে বান্দরবান কাছে, খাগড়াছড়ি কাছে, চট্টগ্রাম কাছে। আমরা এক সঙ্গে নদী, সমুদ্র, পাহাড় সবগুলো এক সঙ্গে একই জায়গায় পাব, জনসমাগম থাকবে না। আর সেজন্য আমরা কক্সবাজারকে বেছে নিয়েছিলাম।

গত ৩ জুলাই চারজন মিলে কক্সবাজারে পৌঁছানোর পর প্রথমে তারা কলাতলিতে 'ওয়ার্ল্ড বিচ' নামের একটি হোটেলে ছিলেন। পরে ওঠেন নীলিমা রিসোর্টে। ১৩ জুলাই কক্সবাজারের দৃশ্য ধারণ শুরু হয়। সে সময় রেজু খাল, পাহাড় ও সমুদ্রের পাশের দৃশ্য ধারণ করা হয় বলে জানান শিপ্রা।

আমরা টেকনাফে যাইনি। আমরা মাত্র ১০ দিন দৃশ্য ধারণ করেছি, যার সবগুলো দৃশ্য মেরিন ড্রাইভের পাশের ছিল।

এই কাজের খরচ কীভাবে মেটানো হচ্ছিল জানতে চাইলে শিপ্রা বলেন, আমরা আসলে গরিব মানুষ। সিনহা খুব বেশি টাকা পয়সার মালিক ছিল না। আমিও খুব বেশি ছিলাম না। আমাদের বাজেটে খুব বেশি খরচও ছিল না। আমরা চারজনের টিম এসেছি। ক্যামেরা সিফাতের নিজের ছিল। থাকা ও খাওয়া নিয়ে যে খরচ হতো, তা খুব বেশি ছিল না। তবে এই দায়িত্বটা সিনহাকে দিয়েছিলাম। সিনহা খরচ করত। শেষের দিকে সিনহা তার অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলতে পারছিল না। এটিএমে ঝামেলা হচ্ছিল। তখন আমার অ্যাকাউন্ট থেকে কিছু টাকা তাকে তুলে দিয়েছিলাম।

সিনহা খুব দ্রম্নতই ডকুমেন্টারি তৈরি কাজের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলেন জানিয়ে শিপ্রা বলেন, সে মিডিয়ার লোক ছিল না, তবে সে অত্যন্ত বুদ্ধিমান ছিল। পেশাদার লোক না হয়েও সে বিষয়গুলো দ্রম্নত খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছিল। সিনহা আর্মির চাকরি করায় সেইফটির বিষয়টি খুব খেয়াল রাখত। যে কোনো কিছু করতে গেলেই আগে সেইফটি ও সিকিউরিটির বিষয়গুলো সে ঠিক রাখত। কক্সবাজারে পাহাড়ে চড়া, সাগরে নামা, সবগুলো কাজের জন্য সেইফটি গিয়ার আমাদের সঙ্গে ছিল।

সিনহার সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে শিপ্রা বলেন, তার সঙ্গে আমার সম্পূর্ণ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। 'জাস্ট গো'-এর স্বপ্ন আমরা দুইজন এক সঙ্গে দেখেছি। হয়তো বা এটার পরিকল্পনা আমি আগে থেকে করেছিলাম, যেটা সিনহার পস্ন্যানে ছিল না। এই স্বপ্নটা যখন আমি শেয়ার করি তখন ও আমার সঙ্গে এটা নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে। সিনহার সঙ্গে অবশ্যই আমার পারস্পরিক বোঝাপড়া ছিল, একটা বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পর্ক ছিল, সেটা অবশ্যই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। এখানে অন্য কিছু জুড়ে দিয়ে বিষয়টা নোংরা করা হোক তা চাই না।

সিনহার সঙ্গে সর্বশেষ কী কথা হয়েছিল জানতে চাইলে শিপ্রা দেবনাথ বলেন, ঘটনার দিন বিকালে সিনহা আমার কাছে ছবি পাঠিয়েছিল। আমাদের ফেসবুক পেইজের কাভার ফটো হিসেবে দেওয়ার জন্য আমার কাছে মতামত জানতে চেয়েছিল। আমি আর সেই সময় রিপস্নাই দিতে পারিনি। তারপর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে ও আমাকে ফোন দেয়। তখন আমি তাকে জিজ্ঞাসা করি, কী অবস্থা তোমাদের আর কত সময় লাগবে? সে বলে, সন্ধ্যার পরে আকাশে যে তারা উঠে, সেই বিষয়ে টাইম ল্যাপস (সময়ক্রম) ছবি নিচ্ছিল। সিনহা বলেছিল, সাড়ে ৮টার মধ্যে আমাদের ছবি নেওয়া হয়ে যাবে। সাড়ে ৯টার মধ্যে আমরা ফিরে আসব। আমি বলেছিলাম, ওকে ফাইন, টেক কেয়ার।'

এরপর আর রিসোর্টে ফেরা হয়নি সিনহার, পথেই তলস্নাশি চৌকিতে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান তিনি।

এক প্রশ্নের জবাবে শিপ্রা জানান, তাদের দলের আরেক সদস্য সাইফুল সাইফ 'টেকনিক্যাল' বিষয়গুলো দেখভাল করতেন। চ্যানেলের পেইজ তৈরি করার দায়িত্ব তার ওপরই ছিল।

জুলাইয়ের ১৩ তারিখে আমাদের ফেসবুক পেইজ খোলা হয়েছিল। মনিটাইজেশনের জন্য সময় লাগে বলে সাইফুল আমাদের বলেছিল, আগস্টের ১৩ তারিখের পরে এখানে ভিডিও আপলোড করা যাবে। আমাদের পরিকল্পনা ছিল, ১৫ আগস্টের পর আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের পেইজে ভিডিও আপলোড করা শুরু করব। ফেসবুকে পোস্টগুলো বুস্ট করার জন্য ৩০-৪০ হাজার টাকা বরাদ্দ করে রেখেছিলাম আমরা।

শিপ্রা বলেন, আমরা জানতাম যে, সঙ্গে সঙ্গে কোনো টাকা-পয়সা ফেসবুক, ইউটিউব থেকে পাব না। তবে আমাদের জায়গা থেকে আমরা সেরা কনটেন্টগুলো তৈরি করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। আমরা ইতোমধ্যে সিনহার স্বপ্নের ইউটিউব চ্যানেল জাস্ট গো ওপেন করেছি। আমি চেষ্টা করব, এই চ্যানেলের মাধ্যমে সিনহার স্বপ্নগুলো তুলে ধরার।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<108770 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1