ট্রিটমেন্ট প্রটোকলের ওপর গুরুত্বারোপ বিশেষজ্ঞদের

করোনামুক্তির পরও পিছু ছাড়ছে না আতঙ্ক

প্রকাশ | ১৮ আগস্ট ২০২০, ০০:০০

সোহেল হায়দার চৌধুরী
কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসের ভয়ানক আতঙ্কের মধ্যে দেশের অধিকাংশ মানুষকে সক্রিয় দেখা গেলেও আক্রান্তদের অনেকের শারীরিক ও মানসিক জটিলতা তৈরি হচ্ছে। আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়া অনেকের শরীর এবং মনের ওপর নেতিবাচক নানা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হওয়ার কথা জানা গেছে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় জানা গেছে, করোনা সংক্রমণ থেকে মুক্তির পরে সুস্থ হওয়া ২৩ শতাংশ মানুষ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। ৪৬ শতাংশ বিষণ্নতায় ভোগেন। আর ৬৯ শতাংশের মাঝে মানসিক চাপ তৈরি হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষকের উদ্যোগে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তত্ত্বাবধানে এ গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ যায়যায়দিনকে গবেষণার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির সুস্থ হওয়ার পরে শারীরিক ও মানসিক যে প্রভাব পড়ে তা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ সময়ের দাবি। একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে, অনেকে সুস্থ হলেও ভয়মুক্ত হতে পারছেন না। যাদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগ বা এ কারণে তৈরি শারীরিক জটিলতা রয়েছে, তারা একদিকে ঝুঁকিতে রয়েছেন, অন্যদিকে নতুন নতুন শারীরিক ও মানসিক জটিলতার মুখোমুখি হচ্ছেন। করোনা আক্রান্ত তরুণ-যুবকদের অনেকের শরীর-মনে দীর্ঘমেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে জানা গেছে। করোনা চিকিৎসায় সম্পৃক্ত স্বাস্থ্যবিদগণ মনে করছেন, সংক্রমণের চিকিৎসা এবং প্রতিরোধী সচেতনতার পাশাপাশি কারোনাবিষয়ক ফলোআপ চিকিৎসাও জরুরি। এ বিষয়ে মানুষকে সচেতন করা প্রয়োজন। নতুবা আক্রান্ত ব্যক্তির মানসিক ট্রমা মুক্ত হতে সময় লাগবে। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ সময়ে 'ট্রিটমেন্ট প্রটোকল' পরিপূর্ণভাবে পালন করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এ বিষয়ে যত দ্রম্নত সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে করোনার কারণে সৃষ্ট দীর্ঘমেয়াদি প্রতিক্রিয়া মোকাবিলায় ততই শক্তিশালী অবস্থানে যেতে পারবে বাংলাদেশ। এছাড়া সংক্রমণমুক্ত হয়ে সুস্থ জীবনে ফিরে আসাদের দীর্ঘমেয়াদে নানা প্রতিক্রিয়া ও প্রভাবের বিষয়ে গবেষণার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা। জানা গেছে, এ নিয়ে আইইডিসিআর একটি জরিপ শুরু করেছে। দেশে করোনাভাইরাসের প্রথম রোগী ধরা পড়ে চলতি বছরের ৮ মার্চ। এরপর থেকে প্রায় ৫ মাস কেটে গেছে। আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ঘনবসতির কারণে করোনা সংক্রমণের মারাত্মক প্রভাবের আশঙ্কা করলেও সেটি পুরোপুরি মিলেনি। ইউরোপ-আমেরিকার তুলনায় বাংলাদেশে মৃতু্যহার অনেক কম। সরকারি হিসাব মতে, বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্তের সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ। সুস্থতার হার প্রায় ৬০ শতাংশ। তবে ঢাকা বিভাগে আক্রান্তের হার বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে মোট শনাক্ত রোগীর প্রায় ৭০ শতাংশই এই বিভাগে। বিভিন্ন কেস স্টাডি বলছে, করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পরে অনেকের পুরানো রোগ ডায়াবেটিস এখন অনিয়ন্ত্রিত হয়ে গেছে। কারো কারো উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এ সমস্যার কারণে দুই কান গরম হয়ে যাচ্ছে। শরীর ঘেমে যাচ্ছে। পাশাপাশি শারীরিক দুর্বলতা সৃষ্টি হচ্ছে আগের চেয়ে বেশি। অবসাদ এবং মানসিক চাপ থেকেই যাচ্ছে। গণমাধ্যমকর্মী এস এম মন্ডল করোনা আক্রান্ত হয়ে প্রায় দেড় মাস বাসায় থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন। ৭০ বছর বয়েসি মন্ডল কাজে যোগদান করলেও এখনো বিষণ্নতা ও ক্লান্তিতে ভোগেন। আগের তুলনায় খাওয়া-দাওয়ার পরিমাণ বাড়ালেও শারীরিক দুর্বলতা কাটাতে পারছেন না। তিনি জানান, করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পরে তিনি ফলমুল কিছুটা খেতে পারলেও ভাত বা অন্য কোনো খাবার মুখে তুলতে পারতেন না। কোভিড-১৯ এর জন্য নির্ধারিত একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছিলেন ৩০ বছর বয়েসি আবদুল হান্নান। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত হান্নান কাজে যোগ দিলেও প্রায়ই মাথাব্যথায় ভুগছেন বলে জানিয়েছেন। তিনি যায়যায়দিনকে বলেন, বিভিন্ন সময় মাথা ঘুরছে বলে মনে হয়। এছাড়া বুকে চাপ অনুভব করি হঠাৎ হঠাৎ। বুক ধড়ফড় করে মাঝেমধ্যে। খাওয়া-দাওয়ার পরিমাণ বাড়িয়েও সংকটমুক্ত হতে পারছি না। ২৯ বছর বয়স্ক আজিজা বেগম শ্বাসকষ্ট নিয়ে গুরুতর অবস্থায় গত এপ্রিল মাসে চিকিৎসা নিয়েছিলেন ঢাকায় কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নার্সিং বিভাগে কর্মরত আজিজা মে মাসের মাঝামাঝি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে কাজে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রভাবে তার শরীরে জটিলতা বেড়েছে এবং মনে তৈরি হয়েছে ভয়। সম্প্রতি একটি গণমাধ্যমকে তিনি জানিয়েছেন, আগে থেকে তার ডায়াবেটিস ছিল। এখন ডায়াবেটিস আপডাউন করছে। করোনামুক্ত হওয়ার পর বস্নাড প্রেশার ধরা পড়েছে। আবহাওয়া বা অন্য কোনো কারণে একটু গলাব্যথা হলেই এখন তিনি ভয় পাচ্ছেন। তিনি বলেন, মনে একটা শঙ্কা চলে এসেছে। স্বাভাবিক জীবনযাপন অনুভব করতে পারি না। ঢাকায় একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সাংবাদিক সাহাদাত হোসেন এবং তার স্ত্রী গুরুতর অসুস্থ হয়ে নয় দিন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছিলেন তিন মাস আগে। সম্প্রতি একটি গণমাধ্যমকে তিনি জানান, কোভিড-১৯ থেকে সুস্থ হওয়ার পর ভুলে যাওয়া বা স্মৃতিভ্রমের মতো সমস্যা অনুভব করছেন। সাহাদাত বলেন, শারীরিক দুর্বলতা অনুভব করছি আগের চেয়ে বেশি। হঠাৎ হঠাৎ স্মৃতি রিকল করতে সমস্যায় পড়ছি। হয়তো কাউকে ফোন করব, যখন ফোন করতে যাই, তখন আমি কাকে ফোন করব, সেটা ভুলে যাই। আগে এ ধরনের কোনো সমস্যা ছিল না। জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান যায়যায়দিনকে বলেন, করোনা চিকিৎসা ব্যবস্থায় আমাদের ব্যবস্থাপনা ত্রম্নটি রয়েছে। আমাদের পরীক্ষার ত্রম্নটি পরিমাণ কমে যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডবিস্নউএইচও) প্রটোকল বা নির্দেশনা সঠিকভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে না। করোনা সংক্রমণ থেকে সুস্থ হওয়ার পর শারীরিক দুর্বলতা ও অবসাদ কাটছে না কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, যে কোনো ভাইরাস শরীরে ঢুকলে নানা জটিলতা তৈরি হয়। ভাইরাস আক্রান্ত শরীরে ডিহাইড্রেশন তৈরি হয়, নিউট্রেশন কমে যায়। সেজন্য দুর্বলতা তৈরি হয়। আর শরীরে ইলেকট্রোলাইটস কমে যাওয়ার কারণে অবসন্নতা আসে। এ অবস্থা থেকে রেহাই পেতে নির্দিষ্ট সময়ে পুষ্টিকর খাবার, প্রচার পানি পান ও নিয়মিত ঘুমানোর পরামর্শ দেন তিনি। অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান বলেন, যারা আক্রান্ত হওয়ার পরেও করোনা উপসর্গ প্রকাশ পায় না, তারা হয়তো শক্তিশালী অ্যান্টিবডির কারণে নিজ থেকেই সুস্থ হয়ে ওঠেন। তাদের ক্ষেত্রে সমস্যা খুব বেশি না হলেও সংস্পর্শে থাকা লোকজন আক্রান্ত হতে পারে। সেজন্য সামগ্রিকভাবে সচেতনতার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সাইফ উলস্নাহ মুন্সী যায়যায়দিনকে বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে শুধু স্বাস্থ্যব্যবস্থা বা অর্থনীতির ওপর প্রভাবই নয়, মানবদেহেও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়তে পারে। মানবদেহের ক্ষতিকারক প্রভাব মোকাবিলায় অ্যান্টিবডি টেস্টের ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি। করোনা সংক্রমণ থেকে মুক্ত হওার পরে কী ধরনের শারীরিক প্রভাব পড়তে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সুস্থ হওয়ার পরেও ফুসফুস-ব্রেনসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ওপর করোনাভাইরাসের প্রভাব পড়তে পারে। মানসিক প্রভাবও পড়তে পারে। তিনি বলেন, করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির মনে মৃতু্যচিন্তা আসে। এ থেকে একধরনের গভীর মানসিক ট্রমা তৈরি হতে পারে। অধ্যাপক ডা. সাইফ উলস্নাহ মুন্সীর মতে, করোনাভাইরাসকে সামগ্রিকভাবে মোকাবিলায় 'ট্রিটমেন্ট প্রটোকল' অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সংক্রমিত হওয়ার পরে একরকম চিকিৎসা, মুক্ত হওয়ার পরে কী করণীয় তারও একটি সর্বসম্মত ও সময়োপযোগী স্বাস্থ্যবিষয়ক নির্দেশনা থাকা জরুরি। তার মতে, করোনা নিয়ে বাংলাদেশীদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এখন পর্যন্ত যারা সংক্রমিত হননি, তাদের সংক্রমণের শঙ্কা রয়েছে ঠিকই, তবে সেটা নিউজিল্যান্ডের মতো হবে না। করোনা আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হওয়ার পরে সীমিত পরিসরে ফলোআপ চিকিৎসা ব্যক্তিগতভাবে কেউ কেউ করলেও আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক নাসরিন সুলতানা সম্প্রতি একটি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তিনি দীর্ঘমেয়াদের নেতিবাচক প্রভাবের মুখোমুখি হয়েছেন। এখন নিজে থেকেই ডাক্তারের কাছে ফলোআপ চিকিৎসা নিচ্ছেন। তার মতে, ফলোআপ চিকিৎসার ব্যাপারেও মানুষকে সচেতন করা প্রয়োজন। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী যায়যায়দিনকে বলেন, করোনা উপসর্গযুক্তরা বা সংক্রমণ থেকে মুক্ত হবার পর অবসাদ-বিষণ্নতা লক্ষ করা যায় আক্রান্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে। অনেকের ঘুম হয় না, ক্লান্তি বেড়ে যায়, হার্টবিট বেড়ে যায়। এই অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য তাজা ফলমুল, তাজা শাকসবজি বেশি করে খেতে হবে। পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে। সেইসঙ্গে প্রয়োজন হালকা ব্যায়াম। তাহলে ধীরে ধীরে সংক্রমিত ব্যক্তির পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরে যাওয়া সম্ভব হবে। ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীর উপসর্গ কম, মাঝারি বা বেশি যাই থাকুক না কেন, তাদের সুস্থ হওয়ার পর কয়েক সপ্তাহ চিকিৎসকের পরামর্শে থাকা উচিত। তাহলে প্রভাব সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। বাংলাদেশে এই কাজটি করা হচ্ছে না। তার মতে, করোনা হলে বা হওয়ার আগে কী করণীয় সেটা নিয়ে নানা কর্মকান্ড চলমান থাকলেও পুনর্বাসনমূলক চিকিৎসায় এখনো নজর দেওয়া হয়নি। যে কারণে করোনা সংক্রমণ থেকে মুক্ত হওয়া রোগীরা শারীরিক ও মানসিক সংকটমুক্ত হতে পারছেন না।