তালগোলে অনলাইন ক্লাস

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে সংসদ টিভি ও বেতার মাধ্যমে রেকর্ডিং ক্লাস প্রচার হলেও উপস্থিতি খুবই নগণ্য। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে জুমসহ অন্যান্য অনলাইন পস্নাটফর্ম ব্যবহার করে ক্লাস নেওয়া হলেও ৯০ ভাগ শিক্ষার্থী ক্লাসের বাইরে থাকছেন

প্রকাশ | ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০০

নূর মোহাম্মদ
করোনায় স্থবির প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত প্রায় ৫ কোটি শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে সংসদ টিভি ও বেতার মাধ্যমে রেকর্ডিং ক্লাস প্রচার হলেও উপস্থিতি খুবই নগণ্য। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে জুমসহ অন্যান্য অনলাইন পস্নাটফর্ম ব্যবহার করে ক্লাস নেওয়া হলেও ৯০ ভাগ শিক্ষার্থী ক্লাসের বাইরে থাকছেন। ইন্টারনেট ডাটার চড়া মূল্য আর মফস্বলে নেটওয়ার্কের দুর্বলতার কারণে অনলাইন ক্লাসগুলোর বেহাল দশা তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে, ইংরেজি মাধ্যম ও দেশের নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো স্ব-স্ব উদ্যোগে অনলাইনে ক্লাস, পরীক্ষা, এমনকি ভাইভা পর্যন্ত নিচ্ছে। এতে পিছিয়ে পড়ছে মফস্বলের শিক্ষার্থীরা। ফলে শহর-গ্রামের শিক্ষার যে বৈষম্য, করোনাকালীন পরিস্থিতি তা আরও বাড়িয়ে দিবে বলে মনে করছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা। সংশ্লিষ্টরা জানান, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব রুখতে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গত ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ রেখেছে সরকার। সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগামী ৩ অক্টোবর পর্যন্ত ছুটি বাড়ানো হয়েছে। চলতি বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হচ্ছে না- এমন আভাস পাওয়া গেছে। এই পরিস্থিতিতে সেশনজট তৈরি হওয়ার ঝুঁকি বাড়বে এমন শঙ্কায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অনলাইন ক্লাস কার্যক্রম শুরুর অনুমতি দেয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। কিন্তু এ উদ্যোগে ভাটা পড়েছে ইন্টারনেটের দাম, মফস্বল অঞ্চলে ধীরগতি এবং প্রয়োজনীয় ডিভাইস না থাকায়। কারণ ছুটি থাকায় বেশির ভাগ শিক্ষার্থী গ্রামে অবস্থান করছেন। ফলে জুম বা অনলাইন পস্নাটফর্মে ক্লাস করার জন্য যে পরিমাণ গতি থাকার দরকার মফস্বলে সেটি পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়াও বর্তমানে ইন্টারনেট প্যাকেজের যে দাম তা অনেক মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীর সামর্থ্যের বাইরে। শুধু তাই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া অসংখ্য শিক্ষার্থী রয়েছেন যারা দরিদ্রতার কারণে স্মার্টফোন সেবার বাইরে। অনলাইন ক্লাসে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে ভিসিরা বিনামূল্যে ইন্টারনেট প্যাকেজ সরবরাহ করার প্রস্তাব দেন। দুই মাস কেটে গেলেও সেই বিষয়টির কোনো সুরাহা হয়নি। গতকাল ইউজিসি জানিয়েছে, সরকারি মোবাইল কোম্পানি টেলিটকের সঙ্গে সংস্থাটির চুক্তি হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী একজন শিক্ষার্থী ১০০ টাকা রিচার্জ করে জুমসহ অন্যান্য অনলাইন পস্নাটফর্মে ক্লাসে অংশ নিতে পারবে। তবে শিক্ষার্থীদের অবশ্যই টেলিটক নেটওয়ার্কের আওতায় থাকতে হবে। অন্যান্য কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির বিষয়ে কোনো কিছু জানানো হয়নি ইউজিসির তরফ থেকে। শিক্ষার্থীরা জানান, টেলিটক কোম্পানির নেট রাজধানীর অনেক জায়গায় পাওয়া যায় না। পেলেও গতি খুবই কম। মফস্বলে টেলিটকের নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না। তাই এ চুক্তি করা না করা সমান কথা। অতিরিক্ত খরচের বোঝা : করোনা মহামারিতে লেখাপড়ার যাতে ক্ষতি না হয় সেজন্য বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো স্ব-স্ব উদ্যোগে চালু করেছে অনলাইন ক্লাস। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও দেশের নামিদামি স্কুল-কলেজ অনলাইনে ক্লাস করাচ্ছে। অন্যদিকে মফস্বল অঞ্চলে ইন্টারনেট সংযোগের ধীরগতি, শহরাঞ্চলে গতি থাকলেও মাসিক ফি ছাড়াও সংযোগ ও মাসিক বিল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা। রাজধানীর মুন্সি আব্দুল রউফ কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী আইরিন আক্তার সানজিদার অভিভাবক বীনা আক্তার বলেন, শুধু মেয়ের অনলাইন ক্লাসের বিভিন্ন ডিভাইস কেনা এবং সংযোগে তার বিশ হাজার টাকা অতিরিক্ত খরচ হয়েছে। আর প্রতি মাসে তাকে গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত ৭০০ টাকার বিল। তিনি বলেন, নানা কারণে যখন সংসার চালাতেই হিমশিম খাচ্ছি, তখন এটা বোঝা হিসেবে আমাদের কাঁধে চেপেছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ড্যাফোডিলের সিএসই চতুর্থ সেমিস্টারের শিক্ষার্থী নাওমীর বাবা সিরাজুল ইসলাম বলেন, তার দুই মেয়ে নেটের মাধ্যমে ক্লাস করছে। এতে তাদের দুটি দামি মোবাইলসহ অন্যান্য খরচ হয়েছে ৫০ হাজার টাকার বেশি। প্রতি মাসে নেট বিল দিতে হচ্ছে ১১শ টাকা। সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটির স্নাতকের এক শিক্ষার্থীও একই সমস্যার কথা বলেন। তার বাবা তার খরচ যোগাতে হিমশিম খাচ্ছেন। সাধারণত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমনিতেই টিউশন ফি বেশি। এখন অনলাইন ক্লাস করতে গিয়ে পড়াশোনার খরচ বেড়ে শিক্ষার্থীদের ওপর আর্থিক চাপ আরও বেড়ে গেছে। উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের একজন শিক্ষককে বাসায় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ নিতে হয়েছে ক্লাস নেওয়ার জন্য। সেইসঙ্গে তাকে কিনতে হয়েছে হোয়াইট বোর্ডও। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই শিক্ষক বলেন, শুধু অনলাইন ক্লাসের জন্য উচ্চমূল্যে ইন্টারনেট ডাটা কিনতে হচ্ছে। এটা অভিভাবকদের পাশাপাশি আমাদের ওপরও অতিরিক্ত আর্থিক বোঝা। তারা বলেন, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সুলভমূল্যে সরকার ইন্টারনেট দেওয়ার কথা ভাবছে। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য এ ধরনের কোনো উদ্যোগ নেই। এতে করোনাকালীন শিক্ষা বৈষম্য আরও বাড়বে। এ ব্যাপারে ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক কাজী শহীদুলস্নাহ বলেন, অনলাইন ক্লাসে অংশ নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় স্মার্টফোন কিনতে শিক্ষার্থীদের জন্য অনুদান বা সহজ শর্তে ঋণও চেয়েছি। চিঠিটির একটি অনুলিপি ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ এবং আইসিটি বিভাগেও পাঠানো হয়েছে। আমরা এখন সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি। পিছিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় : প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে এপ্রিল মাস থেকে টেলিভিশনে ক্লাস শুরু হলেও উচ্চশিক্ষার বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দীর্ঘদিন অনলাইন ক্লাসের বাইরে ছিল। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির তাগিদ দেওয়ার পরও বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে ক্লাস শুরু করতে পারেনি। বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় চালু করলেও শিক্ষার্থীদের সাড়া মিলছে না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই এক্ষেত্রে সবচেয়ে পিছিয়ে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যখন অনলাইন পস্নাটফর্মকে ব্যবহার করে ক্লাস, পরীক্ষা, ভর্তি এমনকি সাক্ষাৎকারও নিচ্ছে তখন হতাশাজনক অবস্থা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর। শিক্ষকরা জানান, প্রযুক্তি ব্যবহার করার ক্ষেত্রে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অনেক পিছিয়ে। যদিও এখন এবং আগামী দিন হচ্ছে প্রযুক্তির। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. ফরিদ উদ্দীন আহমেদ বলেন, করোনা আমাদের প্রযুক্তি নির্ভরতার ব্যাপারে আরও ভাবতে শেখাল। কারণ এখন গোটা বিশ্ব, শিক্ষা ব্যবস্থা- সবকিছুই অনলাইনের দিকেই ঝুঁকছে, সেখানে আমাদের পিছিয়ে থাকার সুযোগ নেই। তিনি বলেন, শাবিপ্রবিতে অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। প্রযুক্তিবিদরা বলছেন, অনলাইন ক্লাস পরিচালনার জন্য জুম, স্কাইপ ছাড়াও আরও কিছু অ্যাপস আছে, এতে দীর্ঘক্ষণ ধরে ক্লাস বা কনফারেন্স করা সম্ভব। এই অ্যাপগুলোর সুবিধা হলো অনুষ্ঠিত ক্লাস রেকর্ড করে রাখা যায়, যা পরবর্তীতে কোনো শিক্ষার্থী ক্লাস না করতে পারলে তার রেকর্ডকৃত ক্লাসটি দেখেও শেখার সুযোগ থাকে যা অফলাইন ক্লাসে সম্ভব নয়। অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্রে গুগল ফর্ম, গুগল ক্লাসরুমসহ আরও বেশকিছু থার্ডপার্টি অ্যাপস আছে যা দিয়ে আগে থেকে সময় নির্ধারণ করে পরীক্ষা নেওয়া যায়। এক্ষেত্রে পরীক্ষার্থী ওই অ্যাপসটি বন্ধ করলে বা একই সময়ে অন্য কোনো অ্যাপস চালু করলে বা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে উত্তর না করতে পারলে তাদের পরীক্ষাটি বাতিল বলে গণ্য হয়।