বুয়েটের আবরার হত্যা মামলার বিচার শুরু

প্রকাশ | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় আটক কারাবন্দি আসামিদের মঙ্গলবার ঢাকার ১ নম্বর দ্রম্নত বিচার ট্রাইবু্যনালের বিচারক আদালতে হাজির করা হয় -যাযাদি
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার বিচার শুরু হয়েছে। মঙ্গলবার আসামিদের অব্যাহতির আবেদন নামঞ্জুর করে ঢাকার এক নম্বর দ্রম্নত বিচার ট্রাইবু্যনালের বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর এ আদেশ দেন। অভিযোগ গঠনের আগে মামলার ২৫ আসামির মধ্যে ২২ জনকে কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয়। আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ পড়ে শোনান। আদালত আসামিদের কাছে জানতে চান, 'আপনারা দোষী না নির্দোষ?' তখন আসামিরা নিজেদের নিরপরাধ দাবি করে আদালতের কাছে ন্যায়বিচার চান। গত বছরের ৬ অক্টোবর দিবাগত রাতে বুয়েটে শেরেবাংলা হল থেকে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের লাশ উদ্ধার করা হয়। এ মামলায় গত বছরের ১৩ নভেম্বর বুয়েটের ২৫ ছাত্রের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। পুলিশের দেওয়া অভিযোগপত্র গত ২১ জানুয়ারি আমলে নেয় ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালত। মামলার ২৫ আসামির মধ্যে কারাগারে আছেন ২২ জন, পলাতক আছেন তিন আসামি। তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। অভিযোগপত্রে যা বলা হয়েছে :আবরার থাকতেন বুয়েটের শেরেবাংলা হলে ১০১১ নম্বর কক্ষে। এটি হলের নিচতলায় অবস্থিত। একই কক্ষে থাকতেন ১৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মিজানুর রহমান। মিজানুর রহমানের নাম মামলার এজাহারে ছিল না। তদন্তে জানা যায়, আবরার হত্যাকান্ডের মূল হোতা ও সূচনাকারী হিসেবে চিহ্নিত মিজানুর রহমান। গত ৪ অক্টোবরের আগে যেকোনো সময় মিজানুর বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান ওরফে রবিনকে বলেন, 'আবরারকে তার শিবির বলে সন্দেহ হয়।' মিজানুরের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মেহেদি হাসান ওরফে রবিন এ বিষয়টি শেরেবাংলা হল ছাত্রলীগের নিজস্ব ফেসবুক মেসেঞ্জারে জানান। ৪ অক্টোবর শেরেবাংলা হলের ক্যানটিনে মেহেদি হাসান ওরফে রবিন এবং ইশতিয়াক আহমেদ ওরফে মুন্নার নেতৃত্বে অমিত সাহা, ইফতি মোশাররফ সকাল, আকাশ হোসেন, খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম, মনিরুজ্জামান মনির, মিফতাহুল ইসলাম জীয়নসহ অন্য আসামিরা মিটিং করেন। এ সময় আবরার তার কক্ষে আছেন কিনা তা জানতে একাধিক সহযোগীকে পাঠিয়ে খোঁজ নেন। কিন্তু আবরার সেদিন তার কক্ষে ছিলেন না। ছিলেন কুষ্টিয়ায়, নিজ বাড়িতে। পরদিন ৫ অক্টোবর মনিরুজ্জামান মনিরের নেতৃত্বে আসামি হোসেন মোহাম্মাদ তোহা, আকাশ হোসেন, মাজেদুর রহমান মাজেদ, মোয়াজ আবু হুরায়রাসহ সবাই গেস্টরুমে একত্রিত হয়ে মিটিং করেন। সেই মিটিংয়ে আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করার সিদ্ধান্ত হয়। গত ৬ অক্টোবর সন্ধ্যায় মুজতবা রাফিদ তার সহযোগী ইফতি মোশাররফ ও মেহেদী হাসান ওরফে রবিনকে জানান, 'তিনি বাড়ি যাবেন। আবরারকে ধরলে আজই ধরতে হবে।' তাদের মধ্যে যখন এ কথোপকথন চলছিল, এর কিছুক্ষণ পর হোসেন মোহাম্মদ তোহা ও শামসুল আরেফীন ইফতি মোশাররফসহ সবাইকে জানান, আবরার গ্রামের বাড়ি থেকে হলে এসেছে। এ খবর পাওয়ার পর সবাই ২০১১ নম্বর কক্ষে আবার একত্রিত হন। রাত ৮টার দিকে মেহেদী হাসান ওরফে রবিন ও ইফতি মোশাররফের নির্দেশে এহতেশামুল রাব্বি ওরফে তানিম, মুনতাসির আল জেমি, এ এস এম নাজমুস সাদাত আবুজার মিলে আবরারের কক্ষে যান। আবরার তখন ঘুমাচ্ছিলেন। তানিম ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলেন আবরারকে। তিনি আবরারকে বলেন, 'বড় ভাইয়েরা তোকে ডাকছে। ২০১১ নম্বর রুমে যেতে হবে।' কখন যেতে হবে, কেন যেতে হবে, জানতে চান আবরার। তানিম জানিয়ে দেন, 'গেলেই দেখতে পাবি।' তখন আবরারের ল্যাপটপ, মোবাইলসহ তাকে ২০১১ নম্বর কক্ষে নিয়ে যান তারা। ওই কক্ষে যাওয়ার পর তাবাখখারুল, ইফতি মোশাররফ ও মুজতবা রাফিদ চেক করতে থাকেন আবরারের মোবাইল-ল্যাপটপ। একজন বলেন, আবরারের মোবাইলের শিবিরের তথ্য পাওয়া গেছে, তখনই মেহেদী হাসান ওরফে রবিন ক্ষিপ্ত হন। আবরারকে তার চোখ থেকে চশমা খুলে ফেলতে নির্দেশ দেন। আবরার চশমা খোলার পর মেহেদী হাসান ওরফে রবিন প্রচন্ড জোরে তার মুখে কয়েকটি থাপ্পড় মারেন। এরই মধ্যে মোরশেদ অমর্ত্য ইসলাম কাঠের তৈরি শক্ত ক্রিকেট স্ট্যাম্প নিয়ে আসেন। এরপর ইফতি মোশাররফ প্রথমে জোরে থাপ্পড় মারেন আবরারকে। হাতে তুলে নেন ক্রিকেট স্ট্যাম্প। এরপর আবরারের পিঠে, পায়ে, হাতেসহ বিভিন্ন স্থানে নির্মমভাবে আঘাত করতে থাকেন। প্রচন্ড মারধরের কারণে ক্রিকেট স্ট্যাম্প দুই টুকরা হয়ে যায়। তখন এহতেসামুল রাব্বি ও তানিম আরও একটি ক্রিকেট স্ট্যাম্প নিয়ে আসেন। এরপর অনিক সরকার একটি স্ট্যাম্প হাতে তুলে নেন। অনিক একাধারে আবরারের সারা শরীরে ৫০ থেকে ৬০টি আঘাত করেন। এতে আবরার মেঝেতে পড়ে যান। সঙ্গে সঙ্গে মুজাহিদুল ইসলাম ও শামিম বিলস্না স্কিপিং রোপ (মোটা দড়ি) দিয়ে আবরারকে দুই থেকে তিনটি আঘাত করেন। আবরার ফাহাদ তখন বাঁচার জন্য আকুতি-মিনতি করেন। কিন্তু তাতেও তার রক্ষা হয়নি। বরং মিফতাহুল ইসলাম ওরফে জীয়ন ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে আবরারের শরীরের বিভিন্ন স্থানে সর্বশক্তি দিয়ে আঘাত করতে থাকেন। বারবার জানতে চান, আবরার শিবির করে কিনা? অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, রাত তখন ১১টা। তখন ওই কক্ষে এসে হাজির হন এস এম মাহমুদ ওরফে সেতু। আবরারের ব্যাপারে উপস্থিত অন্যদের কাছ থেকে তিনি জানতে চান। তখন অনিক সরকার, ইফতি মোশাররফ ও মুজাহিদুল ইসলাম জানান, 'আবরার কোনো তথ্য দিচ্ছে না।' তখন মাহমুদ ওরফে সেতু অন্যদের বলে যান, 'মারতে থাক।' এমন নির্দেশনার পর আবরারকে আবার ক্রিকেট স্ট্যাম্প, স্কিপিং রোপ দিয়ে মারা হয়। আবার ইফতি মোশাররফ ও অনিক সরকার আবরারকে ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে পেটাতে থাকেন। হাতের কনুই দিয়ে আবরারের পিঠে প্রচন্ড আঘাত করেন। তখন সবাই মিলে প্রচন্ড শক্তিতে আবরারকে এলোপাতাড়ি কিল-ঘুষি চড়-থাপ্পড় লাথি মারতে থাকেন। এরপর ওই কক্ষ থেকে বের হওয়ার আগে অনিক সরকার ও মেহেদী হাসান ওরফে রবিন অন্যদের বলে যান, 'তোরা আবরারের কাছ থেকে তথ্য বের কর।' তখন মনিরুজ্জামান মনির বলেন, তিনি আবরারের মোবাইল চেক করে শিবিরের তথ্য পেয়েছেন। এরপর মনিরুজ্জামান ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে আবরারকে পেটাতে থাকেন। তাবাখখারুল, নাজমুস সাদাত, এহতেশামুল রাব্বী ওরফে তানিম, মুনতাসির আল জেমি আবরারকে চড়-থাপ্পড় মারেন। বাইরে থেকে আবার ওই কক্ষে ঢোকেন অনিক সরকার। হাতে তুলে নেন ক্রিকেট স্ট্যাম্প। তখন অনিক সরকার আবার আবরার ফাহাদকে প্রচন্ড জোরে আরও ৪০ থেকে ৫০টি আঘাত করেন। তখন আবরার বমি ও প্রস্রাব করে ফেলেন। বাঁচার জন্য ইশারা-ইঙ্গিতে আকুতি-মিনতি করেন। এমন অবস্থায় আবরারকে হলের বাথরুমে নিয়ে যাওয়া হয়। ধুয়ে মুছে আবরার ফাহাদের জামা-কাপড় বদলানো হয়। এরপর ইফতি মোশাররফ ও মেহেদী হাসানের নির্দেশে নাজমুস সাদাত, শামীম বিলস্নাহ, শামসুল আরেফিন, আকাশ, মোয়াজ আবু হোরায়রা, মুনতাসির আল জেমি ও এহতেশামুল রাব্বি আবরারকে ধরাধরি করে ২০০৫ নম্বর কক্ষে নিয়ে যান। ইফতি মোশাররফ হলের মেস বয় জাহিদ হাসানকে ডেকে আনেন। ২০১১ নম্বর কক্ষটি তাকে দিয়ে পরিষ্কার করানো হয়। তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির পরিদর্শক ওয়াহিদুজ্জামান অভিযোগপত্রে উলেস্নখ করেছেন, আবরার ফাহাদকে ২০০৫ নম্বর কক্ষে নেওয়ার পর ইফতি মোশাররফ অন্যদের বলেন, 'তোরা এবার আবরারের কাছ থেকে তথ্য বের কর। বুয়েটে কে কে শিবির করে।' তখন মোয়াজ আবু হোরায়রা ও অমর্ত্য ইসলাম আবরারের মুমূর্ষু অবস্থা দেখে মেহেদি হাসান ওরফে রবিনকে জানান, 'আবরারকে হাসপাতালে নিতে হবে।' এই কথা শোনার পর মেহেদি হাসান ওরফে রবিন বলেন, 'ও নাটক করছে। শিবির চেনস না। শিবির চেনা কষ্ট।' রাত আড়াইটার সময় ইফতি মোশাররফ, মুজাহিদ, তাবাখখারুল ও তোহা মিলে আবরারকে তোষকে করে হলের দোতালার সিঁড়িতে রাখেন। এরপর আসামিরা বুয়েটের চিকিৎসক ও অ্যাম্বুলেন্স ডেকে আনেন। চিকিৎসক আবরারের দেহ পরীক্ষা করে ঘোষণা দেন তিনি মারা গেছেন। আবরারকে হত্যার পর ক্রিকেট স্ট্যাম্প, তোষক, বালিশ, আবরারের ল্যাপটপ, চাপাতি হলের ২০১১ নম্বর কক্ষ থেকে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মুহতাসিম ফুয়াদের কক্ষে নিয়ে রেখে দেওয়া হয়। বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মেহেদী হাসান ওরফে রাসেল ও সহ-সভাপতি মুহতাসিম ফুয়াদ ওই হত্যাকান্ডের বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিয়ে অপরাধ ঘটাতে সার্বিক সহায়তা করেন। আবরারের মৃতদেহ হলের নিচে নামানোর পর তড়িঘড়ি করে সেখান থেকে সরিয়ে ফেলার জন্য মেহেদী হাসান ওরফে রাসেল বুয়েটের চিকিৎসকের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়েছে, পরস্পর যোগসাজশে পরস্পরের সহায়তায় শিবির সন্দেহে আবরারের বিরুদ্ধে মিথ্যা, বানোয়াট, ভিত্তিহীন অভিযোগ এনে নির্মমভাবে পিটিয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছে।