শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
দুবাইতে নারী পাচার মামলার তিন আসামির জবানবন্দি

হাতবদলের ভয়াবহ চিত্র!

তানভীর হাসান
  ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০০

আর্টিস্ট ভিসার আড়ালে দেশের বাইরে নারীদের পাচারের ভয়াবহ চিত্র ওঠে এসেছে তিন আসামির জবানবন্দিতে। পুলিশ ও আদালতে দেওয়া ওই বক্তব্যে দেশের ভেতরেও নারীদের দিয়ে কীভাবে অসামাজিক কাজে বাধ্যে করা হয়, এর চিত্রও ফুটে ওঠেছে। এতে তিন ধাপে এসব নারীদের হাতবদল করা হতো। বিনিময় সবাই লাভবান হলেও এসব নারীদের কপালে নির্যাতন ও সামান্য কিছু টাকা ছাড়া কিছুই জুটত না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

এমন পরিস্থিতিতে নারী পাচারকারী এসব চক্রের বাকি সদস্যদের গ্রেপ্তারে সিআইডির অভিযান অব্যাহত রয়েছে। জবানবন্দিতে দেশের নারী পাচার চক্রের পুরো চিত্র ফুটে উঠেছে। আদালত ও পুলিশের কাছে দেওয়া আসামি আজম, নির্মল ও ইয়াসিনের জবানবন্দির কপি রয়েছে যায়যায়দিনের হাতে।

জানতে চাইলে সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ মোহাম্মদ রেজাউল হায়দার বলেন, আসামির জবানবন্দিতে দুবাইয়ে নারী পাচারের সঙ্গে জড়িত অনেকের নাম উঠে এসেছে। যাচাই-বাছাই শেষে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

জানা গেছে, দুবাইয়ের চারটি হোটেলে বাংলাদেশ থেকে নেওয়া নারীদের আটকে রেখে নিপিড়ন ও নির্যাতন করার অপরাধে এ বছরের শুরুতে সংযুক্ত আরব আমিরাত সরকার আজম খানকে দেশে পাঠিয়ে দেয়। এরপর পালিয়ে বেড়ানো আজম খানকে গ্রেপ্তার করে তার মোবাইল থেকে বিভিন্ন আলামত উদ্ধার করে সিআইডি। উদ্ধার হওয়া অডিও ক্লিপে ভুক্তভোগী তরুণীদের নির্যাতন থেকে বাঁচতে ও প্রতিশ্রম্নত বেতন দিতে আকুতি জানাতে শোনা যায়। এরপর দুবাইয়ে চার তারকাযুক্ত তিনটি ও তিন তারকাবিশিষ্ট একটি হোটেলের মালিক অভিযুক্ত আজম খানকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। তার মালিকানাধীন হোটেলগুলো হলো ফরচুন পার্ল হোটেল অ্যান্ড ড্যান্স ক্লাব, হোটেল রয়েল ফরচুন, হোটেল ফরচুন গ্র্যান্ড ও হোটেল সিটি টাওয়ার। এসব তরুণীদের মাধ্যমে দুবাইয়ের চারটি হোটেল থেকে বছরে ১৯২ কোটি টাকা উপার্জন হতো আজম খানের। ওই ঘটনায় গত ১৩ জুলাই শহিদুল ইসলামের আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় আজম খান। পরের মাসের ২০ তারিখে মো. মাইনুল ইসলামের আদালতে জবানবন্দি দেন মো. ইয়াসিন। সেখানে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসে।

ইয়াসিন তার জবানবন্দিতে জানান, তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠান যেমন-গায়ে হলুদ, বিয়ে, জন্মদিনসহ বিভিন্ন প্রোগামে আর্টিস্ট নিয়ে যেতেন। কারও প্রোগ্রামের প্রয়োজন হলে তিনি অনিক ও রাসেলের ক্লাবের মাধ্যমে প্রোগাম করাতেন। এসব প্রোগামে অনেক মেয়ে আর্টিস্ট প্রয়োজন হতো। সেই সুবাদে মেয়েদের সঙ্গে পরিচয় হতো এবং অনেকে বিদেশে পাঠানোর জন্য বলত। এরপর ২০১৫ সাল থেকে নারী আর্টিস্টদের বিদেশে পাঠানোর কাজ শুরু করেন তিনি। ২০১৬ সালে হৃদয়ের মাধ্যমে আজমের সঙ্গে পরিচয় হয়। এ সময় হৃদয় ১০ টাকা কমিশনের মাধ্যমে দুবাইতে নারী আর্টিস্ট পাঠানোর প্রস্তাব দেয়। হৃদয়ের মাধ্যমে তিনি নাহিদা, আফসানা ও মিম নামের তিনজনকে আজমের দুবাই ক্লাবে পাঠান। তিনি নিজে হালিমা, মৌসুমি ও তৌহিদাকে পাঠান।

ইয়াসিন বলেন, মেয়েদের বিদেশে পাঠানো মিডিয়া হিসেবে কাজ করতেন তিনি। চট্টগ্রামের নাজিম আমার কাজের বন্ধু। নাজিমের দুবাইতে ড্যান্স ক্লাব আছে। সেখানে মেয়েদের ভালো বেতনে কাজের ব্যবস্থা করা হতো। তিনি নাজিমের ভাই আজমকে নারী আর্টিস্ট দিলে তারা দুবাইতে গিয়ে এরশাদের ড্যান্স ক্লাবে কাজ করাতে থাকে। এরশাদ দুবাইতে তাদের ড্যান্স ক্লাবে মেয়েদের স্টেজ প্রোগ্রাম করাত। স্টেজে কোনো নারীকে গেস্টদের পছন্দ হলে মোটা অংকের টাকার বিনিময় রুমে যেতে বাধ্য করত এরশাদ। ওই নারীদের থাকা-খাওয়া নিশ্চিতসহ ক্লাবে নাচ-গান করার জন্য মাসে ৫০ হাজার টাকা বেতন দেওয়ার মৌখিক চুক্তি হলেও দেশে ফিরে আসা অনেকে টাকা না পাওয়ার অভিযোগ করেন। দুবাইতে মেয়েদের নেওয়ার কাজে সহায়তা করে আজমের ভাই এরশাদ, আলমগীর, স্বপন ও অনিক।

ইয়াসিন তার জবানবন্দিতে বলেন, দেশ থেকে এরশাদ আজমদের নারায়ণগঞ্জ থেকে আর্টিস্ট দেওয়ার কাজ করতেন নায়িকা অপু বিশ্বাসের ম্যানেজার গৌতম, আক্তার সোহাগ, রাসেল ও অপূর্ব। নোয়াখালীর জিয়ার মাধ্যমে ফাহিমা, হ্যাপি, জুই ও রিতু নামের চারজনকে পাঠানো হয়। এ জন্য জনপ্রতি তাকে ১০ হাজার করে টাকা দেওয়া হতো। ২০১৮ সালের প্রথমদিকে ঢাকা থেকে মাইন উদ্দিন ওরফে মহি উদ্দিন নামের একজন মোবাইলে ফোন দিয়ে দেখতে সুন্দরী কম বয়সি মেয়ে চায়। তাকে দুইজন নারী আর্টিস্ট দিলে তিনি আমাকে দুই হাজার টাকা ভাড়া দেন। এরপর সজিব নামে একজন আর্টিস্ট চাইলে আমি তাকে ঢাকায় নিয়ে একজনকে দেখালে তিনি আমাকে এক হাজার টাকা ভাড়া দেন। ২০১৮ সালের এপ্রিল অথবা মে মাসের দিকে ইভান শাহরিয়ার সোহাগ নামে একজন ফোন করে দুইজন কম বয়সি আর্টিস্ট নিয়ে ঢাকায় দেখা করতে বলেন। এরপর দুইজনকে নিয়ে বসুন্ধরায় তার সঙ্গে দেখা করলে সে আমাকে দুই হাজার ৫০০ টাকা দেয়। কিছুদিন পর লুবনা মরিয়ম নামে এক ম্যাডাম আমাকে ফোনে বলেন, দেখতে সুন্দরী, কম বয়সি ও ভালো নাচতে পারে- এমন দুইজন আর্টিস্টকে গুলশানে দেখা করতে বলে। কথা অনুযায়ী দুইজনকে নিয়ে গেলে তিনি আমাকে দুই হাজার টাকা দেন। বগুড়ার রাকিব মিজান একদিন আমাকে ফোন করে আর্টিস্ট চাইলে আমি তাকে আর্টিস্ট দেই। এরপর সে আমাকে এক হাজার টাকা দেয়। পরে শুনি, মিজান মেয়েদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করে বিদেশে পাঠায়। এভাবে ওয়াসিম-জসিম দুই ভাই, সোহেল রহমান, ওয়াসেক মোস্তাকিনুর রহমান, আনিছুর ইসলাম হিরু বিভিন্ন সময় আমাকে গুলশান-বনানীসহ বিভিন্ন জায়গায় ফোনে ডেকে নিয়ে যেত। মেয়েরা ফোন করে কেউ ভালো আছে, আবার কেউ কষ্টে আছে বলে জানাত। মেয়েদের যৌন সম্পর্ক করতে বাধ্য করত। আমি অনুমান ৬-৭ জন মেয়ে আর্টিস্টকে অনিক, হৃদয়ের মাধ্য দুবাইতে আজম ও এরশাদের কাছে পাঠায়। আমি অনুতপ্ত।

নির্মল সরকার আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেন, তিনি আগে ড্যান্সের প্রশিক্ষণ দিতেন। নির্মল ড্যান্স একাডেমি নামে তার একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। একদিন নাজিম নামে একজন তাকে ফোন করে একাডেমিতে আসতে চায়। এরপর নাজিম ও রাসেল নামে নামে দুইজন একাডেমিতে এসে শিল্পীদের প্রশংসা করেন এবং দুবাইয়ে তাদের চারটি ড্যান্স ক্লাব আছে বলে জানায়। এ সময় তাকে বলা হয়, নায়িকা অপু বিশ্বাসের ম্যানেজার গৌতম ছাড়াও আক্তার, সোহাগ, অপূর্ব তাদের আর্টিস্ট সরবরাহ করেন। একপর্যায়ে আর্টিস্টরা যেতে চাইলে তার আপত্তি নেই বলে জানান। এরপর তারা কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে চলে যায়। কিছুদিন পর ফোন করে আর্টিস্ট আলেয়া ও সীমা নামে দুইজনকে নিয়ে যায়। মাসে ৫০ হাজার টাকা বেতনের চুক্তিতে নাজিমের কথায় দুইজন মেয়েকে দুবাইয়ে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। এ জন্য ৩০ হাজার টাকা পান। কয়েকদিন পর আলেয়া ও সীমা জানায়, চুক্তি অনুযায়ী নাজিম টাকা দিচ্ছে না। তিন মাস পর তারা দেশে ফিরে আসে। দেশে ফেরার পর জানতে পারেন, এসব মেয়েদের দিয়ে অনৈতিক কাজে বাধ্য করা হতো। এরপর তিনি বুঝতে পারেন, এই জগৎ খারাপ। তখন তিনি নিজের ড্যান্স একাডেমি বন্ধ করে দেড় বছর ধরে রিকশা চালিয়ে সংসারের খরচ চালাচ্ছেন। এসব ব্যক্তিদের আইনের আওতায়ও আনা দরকার বলে জবানবন্দিতে নির্মল উলেস্নখ করেন।

পাচারের মূল হোতা আজম খান জবানবন্দিতে বলেছেন, তিনি দুবাইতে থাকেন। সেখানে তার রেস্টুরেন্ট ও হোটেলের ব্যবসা রয়েছে। গত বছর রমজানে ময়না, আলেয়া ও মনি আক্তারকে দুবাইতে তার হোটেলে কাজ দেওয়ার কথা বলে নেওয়া হয়। এরপর তাদের গুলশান লাইফ ইন্ডিপেন্ডেন্ট রেস্টুরেন্টে চাকরি দেওয়া হয়। ছয় মাস আগে তিনি বাংলাদেশে এলেও করোনার কারণে ফিরে যেতে পারেননি। যার কারণে ময়না, আলেয়া ও মনি আক্তারকে সময়মত বেতন দেওয়া সম্ভব হয়নি। মেয়ে তিনটিকে নেওয়ার ক্ষেত্রে, লালবাগের স্বপন, বংশালের আনোয়ার হোসেন ওরফে ময়না, আলামিন ওরফে ডায়মন্ড, চট্টগ্রামের মাহফুজ ও ময়মনসিংহের অনিক সহযোগিতা করে। তার ভাই এরশাদ ও নাজিমও বিভিন্ন মাধ্যমে মেয়ে সংগ্রহ করত। বাড্ডার সজীব ও ময়মনসিংহের অনিকেরও দুবাইয়ে ড্যান্স বার রয়েছে।

নায়িকা অপু বিশ্বাসের ম্যানেজার দাবি করে, গৌতম বিশ্বাসের নাম দুইজনের জবানবন্দিতে উঠে আসার সূত্র ধরে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে ফোনে তিনি দাবি করেন, কাজের ক্ষেত্রে ইভান শাহরিয়ার সোহাগসহ অনেককে চিনলেও দুবাইয়ে কোনো নৃত্যশিল্পীকে তিনি পাঠাননি। এ ছাড়া তিনি যতবার বিদেশ গেছেন, সেটা রেকর্ড রয়েছে। অপু বিশ্বাসকে তিনি বোন দাবি করে বলেন, তাকে ফাঁসানোর জন্য কেন এই জবানবন্দি দেওয়া হয়েছে, সেটা তিনি বুঝে ওঠতে পারছেন না।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<112341 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1