বিতর্কিত হচ্ছে মহৎ উদ্যোগ

টিসিবির পেঁয়াজেও দুষ্টচক্রের থাবা

বিশেজ্ঞরা বলেন, টিসিবির পেঁয়াজ খোলাবাজারে বিক্রি শুরুর পর থেকেই যেভাবে নানা অনিয়ম শুরু হয়েছে, তাতে সরকারের পক্ষে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা বেশ খানিকটা কঠিন হবে

প্রকাশ | ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
পেঁয়াজের সরবরাহ ও মূল্য স্বাভাবিক রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) রোববার থেকে খোলাবাজারে ৩০ টাকা দরে পেঁয়াজ বিক্রি শুরুর পর সংঘবদ্ধ দুষ্টচক্র সেখানেও কালো থাবা বসিয়েছে। তারা নানা ফন্দিতে টিসিবির ভ্রাম্যমাণ ট্রাক থেকে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজ হাতিয়ে নিচ্ছে। পরে তা খুচরা বাজারে বিক্রি করছে। এতে সরকারের 'ট্রাকসেল' কার্যক্রমের মূল লক্ষ্য ভেস্তে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিতর্কিত হচ্ছে সরকারের জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট মহৎ পদক্ষেপ। অভিযোগ রয়েছে, টিসিবি এবং এর ডিলারদের সঙ্গে গোপন আঁতাত করেই এ সিন্ডিকেট অপতৎপরতা চালাচ্ছে। ফলে সাধারণ মানুষ তাদের প্রতিহত করতে ব্যর্থ হচ্ছে। বরং এতে বাধা দিতে গিয়ে অনেকেই এ চক্রের হেনস্তার শিকার হয়েছে। এসব বিষয় 'ওপেন সিক্রেট' হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তা না জানার ভান করছে। গণমাধ্যমে এ সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশিত হলে তারা তাদের লোকবল সংকটের দোহাই দিয়েছেন। এদিকে সংঘবদ্ধ দুষ্টচক্রের অপতৎপরতা বাড়ায় সাধারণ ক্রেতারা রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও ঠিকমত পেঁয়াজ কিনতে পারছে না। ফলে বিপুল অর্থ গচ্চা দিয়ে টিসিবি কম দামে পেঁয়াজ বিক্রি করলেও বাজারে তার নূ্যনতম প্রভাব পড়েনি। বরং গত কয়েকদিনে পেঁয়াজের দাম উচ্চ লাফে বেড়ে শতকের ঘর পার করেছে। বাজার পর্যবেক্ষকরা জানান, গত বছরের শেষভাগে পেঁয়াজের দর আকস্মিক আকাশচুম্বি হয়ে ওঠার পর টিসিবি খোলা বাজারে তা বিক্রি শুরু করে। তবে এর বড় একটি অংশ কালোবাজারে চলে যাওয়ায় পেঁয়াজের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়নি। এমনকি তা থেকে নিম্নবিত্তের মানুষ আশানুরূপভাবে উপকৃত হয়নি। ফলে টানা দীর্ঘ সময় পেঁয়াজের বাজার অস্থিতিশীল থাকে। তাদের ধারণা, এবারও টিসিবির পেঁয়াজ খোলাবাজারে বিক্রি শুরুর পর থেকেই যেভাবে নানা অনিয়ম শুরু হয়েছে, তাতে সরকারের পক্ষে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা বেশ খানিকটা কঠিন হবে। টিসিবির গুদাম থেকে ডিলারদের পেঁয়াজ সংগ্রহ এবং তা বিক্রির ডজনখানেক নির্ধারিত স্পট সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট দুই ফন্দিতে ট্রাক সেলের পেঁয়াজ নিজেদের কব্জায় নিচ্ছে। এর উভয় ক্ষেত্রেই টিসিবি এবং ডিলারদের গোপন সম্পৃক্ততা রয়েছে। সাধারণ ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলেও এসব অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। বুধবার সকালে তেজগাঁও শিল্প এলাকায় টিসিবির গুদামের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে দেখা গেছে, কয়েকজন শ্রমিক মিলে একটি ট্রাকে তিনশ' কেজি পেঁয়াজ তুলছে। কাছেই ডিলারের লোকজন দাঁড়িয়ে আছেন। তারা ট্রাক চালকের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলছেন। অথচ পেঁয়াজ কোন স্পটে বিক্রি করা হবে এবং ডিলারের নাম কি তা জিজ্ঞাসা করতেই তারা কোনো জবাব না দিয়ে অন্যদিকে সরে যান। মিনিট বিশেক পর ট্রাকটি টিসিবির গুদামের সামনে থেকে বের হয়ে হাতিরঝিলের রাস্তায় ঢুকে পড়ে। ডিলারের লোকজন একটি সিএনজি অটোরিকশায় ট্রাকটির পিছন পিছন যেতে থাকেন। মোটরসাইকেল নিয়ে ট্রাকের পিছু নিয়ে দেখা যায়, ট্রাকটি কুনিপাড়া হ্যাপী হোমসের গলিতে ঢুকে বৌবাজারের গলির মুখে তাড়াহুড়ো করে দুটি বস্তা নামিয়ে দেয়। সেখানে আগে থেকে দাঁড়িয়ে থাকা একজন ব্যক্তি তা একটি রিকশায় তুলে গলির ভেতরের দিকে চলে যান। এসময় ট্রাকটি দ্রম্নতগতিতে তেজগাঁও সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের সামনে থেকে ঘুরে ফের হাতিরঝিলে উঠে বাড্ডার দিকে ছুটে যায়। কুনিপাড়ার স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যে ব্যক্তি রিকশায় পেঁয়াজের বস্তা তুলে গলির দিকে চলে যান, তিনি পেশায় রং মিস্ত্রি হলেও কয়েকদিন ধরে ভ্যানে পেঁয়াজ নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে বিক্রি করছেন। রাজধানীর কোনো টিসিবির ডিলারের সঙ্গে আঁতাত করে তিনি এ ব্যবসা শুরু করছেন বলে জানান স্থানীয় অনেকেই। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেশিরভাগ ডিলারই টিসিবির গুদাম থেকে পেঁয়াজ তুলে তা নির্ধারিত স্পটে বিক্রি করতে যাওয়ার আগে একই কায়দায় পথে দুই-তিন বস্তা বিক্রি করে দেন। কোনো কোনো আড়াতদার তা কিনে খুচরা দোকানে বিক্রি করেন। এছাড়া হকাররাও এসব পেঁয়াজ কিনে ফেরি করে বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করছেন। এসব পেঁয়াজ তারা টিসিবির ডিলারদের কাছ থেকে গত সোমবার ৬০ থেকে ৬৫ টাকায় কিনলেও বুধবার তাদের ৭৫ থেকে ৮০ টাকা দরে কিনতে হয়েছে। এদিকে রামপুরা, মতিঝিল ও সবুজবাগসহ রাজধানীর প্রায় এক ডজন ট্রাক সেল স্পট ঘুরে দেখা গেছে, সব জায়গাতেই পেঁয়াজ কেনার জন্য ক্রেতাদের দীর্ঘ লাইন পড়েছে। তবে স্বল্প সময়ের মধ্যেই মজুদ ফুরিয়ে যাওয়ায় বেশিরভাগ ক্রেতাকেই পেঁয়াজ না কিনেই ঘরে ফিরতে হয়েছে। দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও পেঁয়াজ কিনতে না পারা মানুষের অভিযোগ, খোলাবাজারে বিক্রির জন্য টিসিবি থেকে ট্রাক প্রতি ৩শ' কেজি পেঁয়াজ দেওয়া হলেও অধিকাংশ ডিলার দেড় থেকে দুইশ' কেজি তা লাইনে দাঁড়ানোর মানুষের কাছে বিক্রি করছে। বাকি পেঁয়াজ তারা কালোবাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারি না থাকায় এ অপতৎপরতা ঠেকানো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও টিসিবি কর্তৃপক্ষের দাবি, তাদের দুই সদস্যের মনিটরিং টিম রয়েছে। কালোবাজারি যাতে না হতে পারে সেজন্য তারা তদারকি করছেন। ইতোমধ্যে তারাও এ ধরনের একাধিক অভিযোগ পেয়েছেন। যা তারা খতিয়ে দেখছেন। অভিযোগ প্রমাণিত হলে এসব ডিলারের পেঁয়াজ বিক্রি বন্ধ করে দেওয়া হবে। অভিযোগের ভিত্তিতে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হবে। তাদের জবাব সন্তোষজনক না হলে টিসিবি কর্তৃপক্ষ তাদের ডিলারশিপ লাইসেন্স বাতিলসহ জামানত বাজেয়াপ্ত করবে। টিসিবির ঢাকা বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এ প্রসঙ্গে বলেন, এই ডিলাররা চালাক ও ধুরন্ধর প্রকৃতির মানুষ। তাদের সবাইকে মনিটর করা সম্ভব হয় না। তদারকির ব্যাপারে তাদের লোকবল সংকট রয়েছে জানিয়ে টিসিবির এই কর্মকর্তা এ ব্যাপারে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপর হওয়া জরুরি বলে মন্তব্য করেন। বুধবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে যাত্রাবাড়ীতে টিসিবির ট্রাক সেলের নির্ধারিত স্পটে গিয়ে দেখা গেছে, পেঁয়াজ কিনতে লাইনে অর্ধ শতাধিক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। টিসিবির লোকজন পরিচয় দিয়ে ৪/৫ জন যুবক লাইন সারিবদ্ধ রাখার কাজ করছেন। তবে ট্রাক সেখানে আসামাত্র তারা নিজেরাই লাইনের সামনের দিকে দাঁড়িয়ে যান। এ সময় তাদের সঙ্গে আরও অন্তত দশজন একই লাইনে ঢুকে পড়েন। এ নিয়ে লাইনে আগে থেকে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন আপত্তি তুললে তারা মারমুখি হয়ে ওঠেন। এর এক পর্যায়ে ডিলারের লোকজন তাদের থামিয়ে দিয়ে পেঁয়াজ বিক্রি শুরু করেন। জোর করে লাইনের প্রথমভাগে দাঁড়ানো টিসিবির কর্মচারী পরিচয় দেওয়া অন্তত ১৫ জন দুই কেজি করে পেঁয়াজ নিয়ে চলে গেলেও অল্প সময় পর তারা আবার ফিরে আসেন এবং একই কৌশলে তারা এবার লাইনের মাঝামাঝিতে ঢুকে পড়েন। এ সময় সেখানে টিসিবির একজন নিরাপত্তা পরিদর্শক ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকলেও তিনি কোনো পদক্ষেপ নেননি। বাইরের লোকজন নিজেদেরকে টিসিবির লোক পরিচয় দিয়ে পরে এসে আগে পেঁয়াজ নিয়ে যাচ্ছেন জানতে চাইলে টিসিবির ওই কর্মকর্তা বলেন, এটা আমার দেখার বিষয় না। আমার দায়িত্ব হলো ট্রাকে ঠিকমত পেঁয়াজ এলো কিনা সেটি দেখা। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, টিসিবির কর্মচারী পরিচয় দেওয়া ওই ব্যক্তিরা কেউই কোনো চাকরি করেন না। তারা বেশিরভাগই হকার ও বেকার পরিবহণ শ্রমিক। স্থানীয় এক শ্রমিক লীগ নেতা তাদের ভাড়া করে লাইনে দাঁড় করাচ্ছেন। তাদের মাধ্যমে তিনি ট্রাক থেকে দুই-তিন দফায় ৭০/৮০ কেজি পেঁয়াজ কিনে নিচ্ছেন। যা যাত্রাবাড়ীর একজন আড়াতদারের কাছে বিক্রি করছেন। এ থেকে তার দৈনিক ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা আয় হচ্ছে। এর অর্ধেক তিনি তার জন্য লাইনে দাঁড়ানো লোকজনকে দিয়ে দিচ্ছেন। এদিকে মতিঝিলের ট্রাক সেল ঘিরেও এই একই ধরনের চিত্র দেখা গেছে। সেখানে লাইনে দাঁড়ানো লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্থানীয় এক নেতা ১০/১২ জন যুবককে জোর করে কখনও লাইনের অগ্রভাগে আবার কখন মাঝখানে ঢুকিয়ে দিয়ে ৩/৪ দফায় শতাধিক কেজি পেঁয়াজ কিনে নিয়েছেন। ফলে দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও অনেকে পেঁয়াজ কিনতে পারেননি। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, এ ব্যাপারে ডিলার ও টিসিবির লোকজনের কাছে অভিযোগ করে কোনো লাভ হয়নি। বরং তারা পাল্টা ধমক দিয়ে তাদের থামিয়ে দিয়েছেন। মতিঝিলের বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনের এক সবজি বিক্রেতা বলেন, ওরা প্রতিদিনই ট্রাক থেকে পেঁয়াজ কিনে সেগুলো বাজার দামের কিছুটা কমে অন্যদের কাছে বিক্রি করে। টিসিবির পেঁয়াজ কিনে বিক্রিতে বেশি লাভ হওয়ায় অনেক হকার নিজ ব্যবসা বন্ধ করে টিসিবির পেঁয়াজ সিন্ডিকেটে জড়িয়ে পড়েছেন। ওদের ৮/১০ জনের একাধিক গ্রম্নপ আছে। টিসিবির লোকদের সহযোগিতায় তারা এমন কাজ করছে বলেও অভিযোগ করেন ওই সবজি বিক্রেতা। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে টিসিবির মুখপাত্র হুমায়ুন কবির বলেন, এসব নিয়ন্ত্রণ করতে হলে জনবলের দরকার। কিন্তু আমাদের পর্যাপ্ত জনবল সংকট রয়েছে। আবার যারা এসব সিন্ডিকেটের কাজ করে তাদের ধরাও কঠিন। তারা সব সময় আশপাশেই ঘোরাফেরা করে। এক সময় তারা লাইনে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। এমনকি তাদের ছেলেমেয়েদেরও দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। তাদের কীভাবে ধরব? অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এসব নিয়ন্ত্রণের মূল দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। মন্ত্রণালয় থেকে সে ধরনের নির্দেশনা রয়েছে। তাদেরকে বলা হয়েছে, পণ্য বিক্রির সময় তারা আশপাশে থেকে শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য কাজ করবে। ভারতকে পেঁয়াজ রপ্তানির অনুরোধ ঢাকার