বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

রিজার্ভ থেকে সরকারের ঋণ মিশ্র প্রতিক্রিয়া অর্থনীতিবিদদের

হাসান আরিফ
  ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০০

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের একটি অংশ লাভজনক প্রকল্পে ঋণ হিসেবে ব্যবহার করার জন্য ভাবছে সরকার। এ নিয়ে কাজও শুরু করেছে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক। সরকার উন্নয়ন প্রকল্পে রিজার্ভ ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিলেও আমলারা তাতে অসন্তুষ্ট আর অর্থনীতিবিদদের মধ্যে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।

অর্থনীতিবিদরা বলেন, সার্বভৌম সম্পদ তহবিল গঠন করে রিজার্ভ থেকে ঋণ দেওয়া যেতে পারে। তবে রিজার্ভ খরচ এবং ঋণের প্রকল্প নির্ধারণ দুই ক্ষেত্রেই সতর্ক থাকা, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার পরামর্শ তাদের।

এরই মধ্যে রিজার্ভ ব্যবহার নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে একটি নীতিমালা তৈরির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর এ ধরনের নির্দেশনার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে চিঠি লিখে এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে বলেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।

দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে (আইএমএফ) কাজ করে আসা অর্থনীতিবিদ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান মনসুর বলেন, করোনা মহামারিকালে এখন আমদানি ব্যয় কম মেটাতে হলেও কিছু দিন পর পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে। ৩৮-৩৯ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ কিন্তু খুব বেশি নয়। এখন আমদানি খাতে কম খরচ হচ্ছে ঠিক; কিন্তু পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আমদানি ব্যয় বাড়বে, তখন এই রিজার্ভ খুবই মূল্যবান হয়ে উঠবে। তাই সরকারকে রাজস্ব আয় বাড়াতে মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

দেশের রিজার্ভ থেকে ঋণ নিয়ে প্রকল্পে বিনিয়োগ করাকে দেশের জন্য ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন আমলারা। তবে অর্থনীতিবিদের মধ্যে কেউ বলেন, এত রিজার্ভ দিয়ে কী হবে যদি তা কাজে না লাগানো হয়। আর কেউ বলেন, একান্ত প্রয়োজন না হলে এখানে হাত দেওয়া ঠিক হবে না। তবে রিজার্ভ ব্যবহার করার পক্ষে কেউ কেউ অবস্থান নিয়েছেন। তাদের মতে, এ সম্পদ উন্নয়ন কাজে লাগালে দেশের উন্নয়ন হবে। বাড়বে কর্মসংস্থান। আর আমলারা বলেন, ডলার জাতীয় সম্পদ, অভ্যন্তরীণ প্রকল্পের জন্য ঋণ নিয়ে এ সম্পদ ব্যবহার করলে আন্তর্জাতিকভাবে দেশের সক্ষমতা কমে যাবে। মূলত আইন দিয়ে সুরক্ষিত ডলারে হাত না দেওয়ার পক্ষে আমলারা।

উলেস্নখ্য, নানা টানাপড়েনে পদ্মা সেতুতে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন না আসার পর এর বিশাল নির্মাণ ব্যয় মেটাতে ২০১৫ সালে রিজার্ভ থেকে ঋণ নেওয়ার কথা ভেবেছিল সরকার। তখন কিছু প্রক্রিয়া শুরু হলেও ২০১৬ সালের মার্চে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ১০ কোটি ডলার চুরি হওয়ার পর রিজার্ভ থেকে আর ঋণ নেওয়া হয়নি। ওই সময় বাংলাদেশে সার্বভৌম সম্পদ তহবিল গঠনের সম্ভাব্যতা যাচাই, তহবিলের কার্যপদ্ধতি এবং আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী এর সর্বোত্তম ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার দিকগুলো পর্যালোচনার জন্য একটি কমিটি করা হয়েছিল। তখন পাঁচ বিলিয়ন ডলারের সভরেন ওয়েলথ ফান্ড (সার্বভৌম সম্পদ তহবিল) গঠনের সুপারিশ করা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তা আর হয়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, বৈদেশিক মুদ্রার যে রিজার্ভ থাকে সেটা সাধারণত তিন মাসের দায় মেটানোর জন্য মজুত থাকতে হয়। করোনার প্রভাবে আপাতত আমদানি-রপ্তানি উভয়ই কম। এজন্য রিজার্ভের পরিমাণটা বেশ বড় দেখা যাচ্ছে। করোনার কারণে অনেক প্রবাসী দেশে চলে এসেছেন। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার ক্ষেত্রে কী ধরনের প্রভাব পড়বে, সেসব বিষয় যাচাই-বাছাই করে দেখছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কারণ বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ (আইএমএফ) অন্যান্য প্রতিষ্ঠান রিজার্ভকে সামনে রেখেই বিভিন্ন ধরনের ঋণ দিয়ে থাকে। এজন্য হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যাবে না।

এ বিষয়ে ড. কাজী খলীকুজ্জমান বলেন, ৩৯ বিলিয়ন ডলার রেখে লাভ কী? এত ডলার দিয়ে কী হবে? তাই এই ডলার থেকে ঋণ নিয়ে দেশের উন্নয়ন করা দরকার। এজন্য আইনের কিছু জটিলতা রয়েছে। এটা দূর করতে হবে। এখন আমাদের রিজার্ভ অত্যন্ত ভালো। এটা ব্যবহার করা যায়। আগে আমাদের রিজার্ভ অনেক কম ছিল। এখন রিজার্ভ যেহেতু ভালো, তাই বাইরে থেকে ঋণ না নিয়ে নিজেদের অর্থ ব্যবহার করা হলে সুদও বেশি আসবে। আর রিজার্ভ এখন বাইরে বিনিয়োগ আছে, যা থেকে সামান্য সুদ পাওয়া যায়।

তার এই কথার সঙ্গে ভিন্ন মত প্রকাশ করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আমলা বলেন, রিজার্ভ বাইরে বিনিয়োগ করে সুদ সামান্য পেলেও তা ডলারেই পাওয়া যাচ্ছে। আর মূল ডলার হিসেবেই থেকে যাচ্ছে। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে বিনিয়োগ করলে তা থেকে দেশীয় মুদ্রায় সুদ পাওয়া যাবে। আর জমানো ডলারও খরচ হয়ে যাবে।

সংশ্লিষ্টরা বলেন, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের মাধ্যম প্রবাসী আয় এবং রপ্তানি আয়। আর এই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যত বেশি হবে বিদেশি বিনিয়োগের ভিত ততই মজবুত হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন। বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতেও সরকার আলাদা শক্তি পাবে। মূলত রিজার্ভ যত বাড়বে সব ক্ষেত্রেই এর ইতিবাচক প্রভাব তত দেখা দেবে। আর রিজার্ভ যত কমবে এসব ক্ষেত্রে ততই নেতিবাচক প্রবণতা দেখা দেবে।

দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান খাত প্রবাসী আয়। এরপরই আছে রপ্তানি আয়, বিদেশি ঋণ আর অনুদান। মূলত প্রবাসী আয় দিয়েই দেশের রিজার্ভ এখন ৩৯ বিলিয়ন ডলারের ওপরে পৌঁছেছে। পর্যাপ্ত ডলার মজুত থাকায় বিদেশিরা এখন এ দেশে নিরাপদ বিনিয়োগের আশায় বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছে। বিদেশিদের জন্য বিভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চলে তাদের বরাদ্দ দেওয়ার পেছনেও এই রিজার্ভ বিশেষ ভূমিকা পালন করছে বলে সংশ্লিষ্টরা বলেন।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনা করে যে ধারণা পাওয়া গেছে তা হচ্ছে- ডলার বিনিয়োগ করে বাংলাদেশ ডলার আয় করে। এখন এই ডলার যদি দেশীয় প্রকল্পের জন্য ঋণ দেওয়া হয় তাহলে এ আয়ের পথ বন্ধ হবে। ডলারের মজুতও কমতে থাকবে। এতে বিদেশিদের কাছে আস্থার সংকট হবে। বিনিয়োগ করা থেকে তারা মুখ ফিরিয়ে নেবে।

সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এখনই রিজার্ভে হাত না দিয়ে পাইপলাইনে যে ঋণ আছে তা যথাসময়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করা দরকার। আর করোনার কারণে অনেক খাত থেকেই সহজ শর্তে এবং অল্প সুদে ঋণ পাওয়া যাচ্ছে। এসব ঋণ সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে দেশের রিজার্ভে এখনই হাত দিতে হবে না। তারপরও যদি এমন কোনো জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প সরকারের বাস্তবায়ন করা দরকার হয় আর সেই প্রকল্পের জন্য যদি বাইরে থেকে ঋণ না পাওয়া যায় তবেই রিজার্ভের বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে আলাদা একটা ফান্ড তৈরি করতে হবে। নজরদারির জন্য আলাদা কমিটি করা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে সরকার যদি কিছু অর্থ ঋণ হিসেবে ব্যবহার করে তাহলে ক্ষতির কিছু নেই। তবে সুদের হার ও পরিশোধের মেয়াদ কী হবে, কোন ধরনের প্রকল্পে ব্যবহার করা হবে তা আগে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে হবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ বলেন, দেশে বর্তমানে যে প্রকল্প আছে তা ব্যয়সর্বস্ব। বারবার এসব প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানো হচ্ছে। তাই এসব প্রকল্পের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কিছু প্রকল্প অপ্রয়োজনেই করা হচ্ছে। এসব প্রকল্প দিয়ে সরকার দলীয়দের সুযোগ করে দেওয়া হয়। আর রিজার্ভ থেকে যদি ঋণ নিয়ে তা করা হয় তাহলে দেশের জন্য দুদিক দিয়ে ক্ষতি হবে। এক হচ্ছে- রিজার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত করা। আর দুই হচ্ছে- দেশের উন্নয়নের নামে অর্থের অপচয় করা।

উদাহরণ হিসেবে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, পদ্মা সেতুতে কত বার ব্যয় বৃদ্ধি করা হয়েছে সে দিকে লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারা যায়। এখানে কোনো জবাবদিহিতা নেই। তাই কোনো কিছু করার জন্য প্রয়োজন জবাবদিহিতা। আর জবাবদিহিতা না থাকলে সেখানে দুর্নীতি হবেই। মূলত স্বচ্ছতা আর জবাবদিহিতার অভাবেই প্রকল্পের ব্যয় বাড়ে। এখন রিজার্ভের ক্ষেত্রেও তাই হতে পারে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<112541 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1