শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাড়তি দামেই স্থির পেঁয়াজ

বিপাকে পড়েছে ভারতের ব্যবসায়ীরাও আটকে থাকা ট্রাকে 'পচছে' পেঁয়াজ আজ আসতে পারে আটকেপড়া পেঁয়াজ মিয়ানমার থেকে এসেছে ২৭ মেট্রিক টন
আহমেদ তোফায়েল
  ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০০
পেঁয়াজ

ভারত রপ্তানি বন্ধ করায় হঠাৎ বেড়ে যাওয়া পেঁয়াজের দাম এখনো সহনশীল পর্যায়ে আসেনি। কম দামে খোলাবাজারে পেঁয়াজ বিক্রি করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করা হলেও কোনো লাভ হয়নি। বাজারে পেঁয়াজের বাড়তি দামই দেখা যাচ্ছে।

যদিও বৃহস্পতিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করা হয়েছে, সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের কারণে বাজারে পেঁয়াজের দাম কমতে শুরু করেছে। তবে মন্ত্রণালয়ের এ তথ্যের কিছুটা সত্যতা মিলেছে কেবল পাইকারি বাজারের ক্ষেত্রে।

পাইকারি বাজারে গত দুই দিনে দাম কমেছে কেজিপ্রতি ১০ টাকা পর্যন্ত। কিন্তু খুচরা বাজারে এর প্রভাব পড়েনি। বাড়তি দামেই খুচরা বিক্রেতাদের কাছ থেকে পেঁয়াজ কিনতে হচ্ছে ভোক্তাদের। অনেক খুচরা বিক্রেতা বলছেন, পাইকারি বাজারে দাম কমার যে কথা চাউর হয়েছে তা সঠিক নয়।

শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খুচরা বাজারে গত তিন দিনের মতো দেশি পেঁয়াজের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ১০০ টাকা। আমদানি করা পেঁয়াজের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকা। অপরদিকে পাইকারিতে দেশি পেঁয়াজের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৭৭ টাকা। ভালো মানের আমদানি করা ভারতীয় পেঁয়াজের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা।

শ্যামবাজারের বিসমিলস্নাহ ট্রেডার্সের মো. কাজল বলেন, প্রতিদিনই পেঁয়াজের দাম উঠা-নামা করে। দাম বাড়ার কারণে এখন তার বিক্রি কমে গেছে। তার ধারণা, এবার পেঁয়াজের দাম গত বছরের মতো অস্বাভাবিক হারে বাড়ার আশঙ্কা নেই। শেষ পর্যন্ত ভারত পেঁয়াজ না দিলে বর্তমান দাম আরও কিছুদিন স্থির থাকবে।

পাইকারিতে দাম কমার পরও খুচরায় না কমার কারণ হিসেবে মালিবাগ হাজীপাড়ার ব্যবসায়ী মো. সেলিম জানান, দাম বাড়ায় গত মঙ্গলবার বেশি করে পেঁয়াজ কিনেছিলেন তিনি। পাইকারিতে দাম কমেছে কিনা বলতে পারছেন না। তার যেহেতু বাড়তি দামে কেনা, তাই তিনি বাড়তি দামেই বিক্রি করছেন।

খিলগাঁওয়ের ব্যবসায়ী আল-আমিন বলেন, পাইকারিতে দাম কমেছে তা ঠিক নয়। শ্যামবাজার থেকে ৮০ টাকার নিচে পেঁয়াজ কেনা যায়নি। গত মঙ্গলবার ৮০ টাকা করে দেশি পেঁয়াজ কিনেছেন। গতকালও (শুক্রবার) ৮০ টাকা করে কেনা পড়েছে। তার পেছনে অন্যান্য খরচ যোগ করে ১০০ টাকার নিচে বিক্রি করা সম্ভব নয়।

মিয়ানমার থেকে আমদানি : আমাদের টেকনাফ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, কক্সবাজারের টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে মিয়ানমার থেকে ২৭ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে। শুক্রবার মিয়ানমার থেকে স্থলবন্দরে ২৭ মেট্রিক টন পেঁয়াজ বোঝাই একটি ট্রলার বন্দরে ভিড়েছে। আমদানিকারক মো. আরাফাত বলেন, দেশে পেঁয়াজের সংকট মোকাবেলায় মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে। এখন দ্রম্নত সময়ে খালাসের চেষ্টা চলছে।

আটকে থাকা ট্রাকে 'পচছে' পেঁয়াজ : ভারত সরকার রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দেওয়ার আগে খোলা এলসির পেঁয়াজ নিয়ে সীমান্তের ওপারে আটকে আছে বহু ট্রাক; পেঁয়াজে পচন ধরলেও সেগুলো বাংলাদেশে পাঠানো হচ্ছে না।

বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট স্টাফ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাজেদুর রহমান জানান, সোমবার যখন পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা এলো, তখন পেট্রাপোল বন্দরে পেঁয়াজ বোঝাই পাঁচটি ট্রাক আটকা পড়ে। এসব ট্রাকের গেটপাস থাকলেও এখন আর এপারে আসার অনুমতি দিচ্ছে না ভারতীয় কর্তৃপক্ষ।

এছাড়া বনগাঁয় আরও ৩৯টি ট্রাক এবং রানাঘাট রেলস্টেশনে তিনটি রেল ওয়াগন পেঁয়াজ নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। অন্তত এক সপ্তাহ আগে রেলের এই পেঁয়াজগুলো ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে রানাঘাট স্টেশনে আনা হয়। তিনি জানান, আটকে থাকা এসব পেঁয়াজে পচন ধরেছে। দুর্গন্ধ ছড়াতে শুরু করেছে বলে রপ্তানিকারকরা তাকে জানিয়েছেন।

এদিকে, দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দরের ওপারেও এরকম প্রায় ২০০ ট্রাক পেঁয়াজ নিয়ে আটকে আছে বলে খবর দিয়েছে ভারতীয় বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার।

হিলি এক্সপোর্টার্স অ্যান্ড কাস্টমস ক্লিয়ারিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক অশোক মন্ডলের বরাতে আনন্দবাজারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেসব ট্রাকে প্রায় দশ কোটি রুপির পেঁয়াজে পচন ধরার অবস্থা হয়েছে।

বাংলাদেশের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট রয়েল এন্টারপ্রাইজের মালিক রফিকুল ইসলাম রয়েল বলেন, প্রতি মেট্রিক টন ২৫০ ডলার মূল্যে ৭৪০ মেট্রিক টন পেঁয়াজের ঋণপত্র (এলসি) দেওয়া আছে তাদের। কিন্তু গত সোমবার মাত্র এক ট্রাক পেঁয়াজ বেনাপোলে ঢোকার পর বন্ধ হয়ে যায়।

ওপারের ব্যবসায়ীদের বরাতে বেনাপোল আমদানি-রপ্তানিকারক সমিতির সহ-সভাপতি আমিনুল হক বলেন, বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানি করতে তাদের আপত্তি নেই। বাজার দরে এলসি পেলে তারা আবার রপ্তানি শুরু করবেন। তারা বলছেন, প্রতি মেট্রিক টন ২৫০ ডলার দরে আগে যেসব এলসি খোলা হয়েছিল, তা সংশোধিত মূল্যে এবং নতুন এলসি ৭৫০ ডলার দরে করা হলে পেঁয়াজের আমদানি প্রক্রিয়া স্বভাবিক হতে পারে।

বিপাকে ভারতের ব্যবসায়ীরাও :গত ১৪ সেপ্টেম্বর হঠাৎ করে বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণায় বিপাকে পড়েছেন ভারতের ব্যবসায়ীরাও। পশ্চিমবঙ্গের ভারত-বাংলাদেশের ৪টি স্থলসীমান্তে পেঁয়াজ বোঝাই প্রায় এক হাজার ট্রাক আটকা পড়েছে। এ অবস্থায় ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানিকারকরা অবিলম্বে এই পচনশীল পণ্য বাংলাদেশে রপ্তানির দাবি জানিয়েছেন। তারা বলছেন, ঋণপত্র খোলা এসব পেঁয়াজের ট্রাক অবিলম্বে বাংলাদেশে পাঠানোর অনুমতি দিক ভারত সরকার। পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বেনাপোল-পেট্রাপোল, ঘোজাডাঙ্গা, মালদহের মহদিপুর এবং দক্ষিণ দিনাজপুরের হিলি সীমান্তে এসব পেঁয়াজ বোঝাই ট্রাক আটকে আছে। ইতিমধ্যে ওইসব ট্রাকের পেঁয়াজ নষ্ট হতে শুরু করেছে। বর্তমানে মহদিপুর সীমান্তে ৩০০টি, ঘোজাডাঙ্গ সীমান্তে ১৫০টি এবং বেনাপোল-পেট্রাপোল ও হিলি সীমান্তে ৫০০টি পেঁয়াজ বোঝাই ট্রাক আটকে রয়েছে। এতে পেঁয়াজ রয়েছে ১৬ হাজার মেট্রিক টন। এই আটকে থাকার কারণে, এ দেশে পেঁয়াজ রপ্তানিকারকরা প্রচন্ড আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।

রপ্তানিকারকরা চাইছেন অবিলম্বে সীমান্তে আসা পণ্যবাহী পেঁয়াজের ট্রাককে বাংলাদেশে প্রেরণ করে পেঁয়াজ খালাস করার অনুমতি দেওয়া হোক। নেপাল ও ভুটান সীমান্তেও সে দেশে যাওয়ার জন্য আটকে পড়েছে অন্তত ২০০ পেঁয়াজ বোঝাই ট্রাক। এসব পেঁয়াজ এসেছে ভারতের মহারাষ্ট্রের নাসিক থেকে।

নাসিক ছাড়া ভারতের পাঞ্জাব, কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট, রাজস্থান, তামিলনাড়ুতেও প্রচুর উৎপাদন হয়। তবে বাংলাদেশে রপ্তানিমুখী এসব ট্রাকের পেঁয়াজ মহারাষ্ট্রের নাসিক থেকে মালবাহী ট্রেনে করে পশ্চিমবঙ্গের ডানকুনি ও কলকাতার চিৎপুর রেল ইয়ার্ডে আসে। সেখান থেকে ট্রাকে করে পাঠানো হয় বাংলাদেশে।

ওয়েস্ট বেঙ্গল এক্সপোর্টার্স কো-অর্ডিনেশন কমিটির সাধারণ সম্পাদক উজ্জ্বল সাহা বলেন, 'দেশের বাজারে মূল্য নিয়ন্ত্রণে রপ্তানিতে রাশ টানার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাচ্ছি। তবে যেভাবে আচমকা নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে তাতে বহুমুখী সংকট তৈরি হয়েছে। লোকসানের সঙ্গে বিদেশি আমদানিকারকদের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি খেলাপের মতো ঘটনা ঘটেছে।'

তিনি আরও বলেন, '১৪ সেপ্টেম্বর নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার আগে বিভিন্ন ব্যাংকে যাদের এলসি খোলা হয়ে গেছে এবং যেসব পেঁয়াজ বোঝাই ট্রাক সীমান্তে পৌঁছে গেছে অন্তত তাদের ওই পেঁয়াজ রপ্তানি করার সুযোগ দেওয়া হোক।

আজ আসতে পারে আটকেপড়া পেঁয়াজ :এদিকে আজ শনিবার হিলি স্থলবন্দর দিয়ে প্রবেশ করতে পারে সীমান্তের ওপারে অপেক্ষমাণ পেঁয়াজবাহী ট্রাক। পাঁচদিন আটকে থাকার পর অনুমতিসাপেক্ষে ট্রাকগুলো বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে। অভ্যন্তরীণ বাজারে পেঁয়াজের সংকট ও মূল্যবৃদ্ধির অজুহাত দেখিয়ে ভারত সরকার গত সোমবার থেকে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করায় এসব ট্রাক বাংলাদেশে ঢুকতে পারেনি।

হিলি স্থলবন্দর আমদানি-রপ্তানিকারক গ্রম্নপের সভাপতি হারুন উর রশীদ হারুন বলেন, তাদের ২৫০টির মতো পেঁয়াজ বোঝাই ট্রাক ভারতের অভ্যন্তরে বিভিন্ন সড়কে অবস্থান করছে। অতিরিক্ত গরম ও বৃষ্টির কারণে এসব ট্রাকের মধ্যে কিছু ট্রাকের পেঁয়াজে ইতোমধ্যে পচন ধরতে শুরু করেছে। এই পেঁয়াজগুলো যদি তারা রপ্তানি না করে তাহলে আমদানিকারকরা ব্যাপকভাবে ক্ষতির মুখে পড়বেন। তবে ভারতীয় রপ্তানিকারকরা তাদের জানিয়েছেন, আটকে পড়া পেঁয়াজগুলো তারা রপ্তানি করবে। এসব পেঁয়াজ দেশে প্রবেশ করলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তা চলে যাবে। তাতে বর্তমানে যে পেঁয়াজের দাম রয়েছে তা আরও কমবে।'

হারুন উর রশীদ বলেন, শুধু ভারতের দিকে মুখাপেক্ষী হয়ে না থেকে তারা ইতোমধ্যে পাকিস্তান, মিসর, তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশে পেঁয়াজের এলসি খুলেছেন। যা আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে চলে আসবে। তাতে পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<112543 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1