কোন পথে হাঁটবে হেফাজত

প্রকাশ | ২০ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০০

হেলাল উদ্দিন চৌধুরী, চট্টগ্রাম
হেফাজতে ইসলাম, বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড (বেফাক), আল-হাইআতুল উলইয়া লিল-জামিয়াতিল কওমিয়া, খতমে নবুয়ত মুভমেন্টসহ গত দুই যুগ ধরে কওমিপন্থিদের প্রায় সব ফোরামে শীর্ষ নেতা ছিলেন আলস্নামা শাহ আহমদ শফী। হেফাজতের প্রধান কেন্দ্র হাটহাজারী বড় মাদ্রাসা হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রামের আল জামেয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম মাদ্রাসারও মহাপরিচালক ছিলেন তিনি। কওমি অনুসারীদের অভিভাবক এই শীর্ষ আলেমের মৃতু্যতে এখন হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্ব নিয়ে চলছে নানা গুঞ্জন। অপরদিকে তার মৃতু্যর আগে হাটহাজারী মাদ্রাসায় ছাত্র বিক্ষোভ, দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া, হাসপাতালে যাওয়ার সময় অ্যাম্বুলেন্স আটকে রাখা, আলস্নামা আহমদ শফীর ছেলের সঙ্গে হেফাজত মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীর বিরোধের পর স্পষ্টত দুইভাগে ভাগ হয়ে গেছে কওমিপন্থি সংগঠনটি। অবশ্য কওমি সনদের স্বীকৃতি, কওমি আলেমদের মর্যাদা রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শাহ আহমদ শফী নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন অনন্য উচ্চতায়। হেফাজতের সব নেতাই মনে করেন আহমদ শফীর শূন্যতা কিছুতেই পূরণ হওয়ার নয়। গতকাল শনিবার বাদ জোহর হাটহাজারী মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে স্মরণকালের বৃহত্তম জানাজার মাধ্যমে কওমি অনুসারীরা চোখের জলে বিদায় জানান তাদের এত দিনের মাথার উপরের ছায়াটিকে। মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে কবরস্থানে তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সারাদেশের মানুষের কাছে ব্যাপক পরিচিতি পান শাহ আহমদ শফী। কওমিপন্থি রাজনীতি বহুধাবিভক্ত হলেও আহমদ শফী ইসু্যতে সবাই ছিলেন এক। সেই আহমদ শফীই মৃতু্যর এক দিন আগে ছাত্র আন্দোলনের মুখে তার চিরচেনা মাদ্রাসায় কর্তৃত্ব হারিয়ে মহাপরিচালকের পদ ছাড়তে বাধ্য হন। অভিযোগ উঠেছে, এই ছাত্র আন্দোলনের পেছনে হেফাজতের নেতৃত্বও একটি বড় কারণ। হাটহাজারী মাদ্রাসার বিভিন্ন ইসু্যতে আহমদ শফির ছেলে আনাস মাদানীর সঙ্গে হেফাজতের মহাসচিব ও মাদ্রাসার সহকারী পরিচালক মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরীর বিরোধ চরম আকার ধারণ করে। এক পর্যায়ে বাবুনগরীকে মাদ্রাসা থেকে অব্যাহতিও দেওয়া হয়। মাওলানা শফীর ছেলে আনাস মাদানী হেফাজতের প্রচার সম্পাদক। তিনি একই সঙ্গে হাটহাজারী মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন। দুদিন আগে তাকেও মাদ্রাসা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ আছে, তার পিতা অসুস্থ হওয়ায় তিনি মাদ্রাসা এবং হেফাজতের মধ্যে তার প্রভাব বাড়াতে থাকেন। বাবুনগরীকে মাদ্রাসা থেকে বাদ দেওয়ার পর তিনি কয়েকজন শিক্ষককে মাদ্রাসা থেকে বাদ দেন এবং তার বিরোধী ছাত্রদের নানাভাবে কোণঠাসা করেন। হাটহাজারী মাদ্রাসায় প্রায় ২০ হাজার ছাত্র রয়েছে, তারাও শিক্ষকদের অনুসারী হিসেবে নানা ভাগে বিভক্ত। গত ৯ জুলাই অবশ্য মাওলানা আহমদ শফী তার ছেলে এবং বাবুনগরীকে নিয়ে এক টেবিলে বসে তাদের মিলিয়ে দেন। কিন্তু বাবুনগরী মাদ্রাসায় তার পদ ফিরে পাননি। ছাত্র বিস্ফোরণে মহাপরিচালকের পদ ছাড়ার পর বৃহস্পতিবার রাতে অসুস্থ হয়ে পড়া আহমদ শফীকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার শারীরিক অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় বিকালে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে তাকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আজগর আলী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে স্পষ্টত দুই শিবিরে ভাগ হয়ে গেছে হেফাজত শিবির। তাই নতুন করে এই সংগঠনের নেতৃত্বে কে আসবেন তা নিয়ে শুরু হয়ে গেছে আলোচনা। হেফাজত নেতারা বলেন, ২০১৩ সালে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন চলাকালে শাহবাগবিরোধী কওমি আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে হেফাজতের জন্ম। একই বছরের ৫ মে শাপলা চত্বরে সমাবেশ করে সেখানেই অবস্থান নেন সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। তখনই সারাদেশের মানুষের কাছে পরিচিতি পায় সংগঠনটি। সারাদেশে কওমিদের শীর্ষ সংগঠন হিসেবে একজন গ্রহণযোগ্য আলেম এই সংগঠনের দায়িত্বে আসুক সেটা চাইছেন সবাই। হেফাজতের প্রভাবশালী একাধিক নেতা মনে করেন, সিনিয়র নায়েবে আমির মাওলানা মুহিব্বুলস্নাহ বাবুনগরী, বর্তমান মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী, ঢাকা মহানগর আমির মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমীর মধ্য থেকে একজন আমির হিসেবে সামনে থাকতে পারেন। তবে এক্ষেত্রে সরকারের কোনো একটি মহলের ভূমিকা থাকতে পারে বলে জানান কেউ কেউ। ঢাকার একটি ইসলামি দলের একজন সিনিয়র নেতা বলেন, 'হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্ব হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে নির্ধারণ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।' হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী অবশ্য বলেছেন, 'হেফাজতের আমির কে হবেন- সে সিদ্ধান্ত হবে কাউন্সিলে। আমার দায়িত্ব হলো এখন কাউন্সিল ডাকা। কাউন্সিল যে সিদ্ধান্ত নেবে সেটাই চূড়ান্ত।' শাহ আহমদ শফী চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া থানার পাখিয়ারটিলা গ্রামে এক আলেম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। হাটহাজারী মাদ্রাসা ও ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসা থেকে শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করে ১৯৪৬ সালে হাটহাজারী মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার পর ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠানের মজলিসে শুরার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মহাপরিচালক পদে দায়িত্ব্ব পান। মৃতু্যর কিছু সময় আগ পর্যন্ত টানা ৩৪ বছর ধরে মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করে গেছেন। দেশের সর্ববৃহৎ ইসলামি শিক্ষাকেন্দ্রের সঙ্গে দীর্ঘদিন যুক্ত থাকার কারণে সারাদেশে তার রয়েছে অসংখ্য ছাত্র, মুরিদ, ভক্ত ও খলিফা। কওমি ধারার ৪০ হাজার মাদ্রাসার প্রায় প্রতিটির শিক্ষক ও পরিচালকের পদে রয়েছে তার অগণিত ছাত্র।