১৩ পদক্ষেপ গ্রহণের প্রস্তুতি

শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধে সরকারের নতুন ছক

প্রকাশ | ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
সরকার শিক্ষা খাতে নানা উদ্যোগ নিলেও শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার গত ৫ বছর থেকে একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। এর ওপর করোনা মহামারিতে অভিভাবকদের আয় কমে যাওয়া এবং কর্মহীন হয়ে শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য হওয়াসহ নানা সংকটে এ সংখ্যা লাফিয়ে বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। উদ্বেগজনক এ পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার ১৩টি বড় কারণ সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করেছে সরকার। এ বিষয়ে শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণের নতুন ছক কষছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সরকারের নীতিনির্ধারক মহলের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানায়, এসব বিষয় পর্যালোচনা করে সরকার ৭টি স্বল্পমেয়াদি ও ৬টি দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছে। স্বল্পমেয়াদি কার্যক্রমের অংশ হিসেবে যে ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে, তাদের একটা ডাটাবেস তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এ তালিকা তৈরিতে শিক্ষকদের পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাজে লাগানো হতে পারে। এসব শিক্ষার্থীকে মাসে মাথাপিছু ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা বৃত্তি দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা চলছে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের একবেলা করে খাবারের ব্যবস্থা করারও সিদ্ধান্ত রয়েছে। এদিকে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধে সরকার দীর্ঘমেয়াদি যেসব পরিকল্পনা গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছে, এর মধ্যে শিক্ষকদের দক্ষতা ও মানোন্নয়নের বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তুকে সহজবোধ্য করার চিন্তাভাবনা রয়েছে। কেননা পাঠ্যসূচিতে এমন একাধিক বিষয় ও অধ্যায় রয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের কখনোই কাজে লাগে না। তারপর শিক্ষার্থীদের আবার দুর্বোধ্য সৃজনশীলের চাপে পড়তে হয়। এই আনন্দহীন শিক্ষায় স্কুলে শুধু পড়া দেওয়া-নেওয়া হয়। এমন পরিস্থিতিতে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত এমনকি নিম্ন মধ্যবিত্তরাও প্রাইভেট-টিউশনি, কোচিং, সহায়ক বইয়ের মাধ্যমে স্কুলের বাইরে থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হচ্ছে। কিন্তু স্কুলে খুব বেশি টাকা খরচ না হলেও বাইরে থেকে শিক্ষা কেনার মতো নিম্নবিত্তদের টাকা থাকে না। ফলে তারা কিছুদিন মাধ্যমিক স্তরে স্কুলে যাওয়া-আসার মধ্যে থাকে। একসময় আনন্দহীন এই শিক্ষা থেকে তারা ঝরে পড়ে। করোনা পরিস্থিতিতে নিম্ন মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্ত থেকে হতদরিদ্রের কাতারে দাঁড়ানো পরিবারের শিক্ষার্থীদের খাতা-কলমসহ সব ধরনের শিক্ষা উপকরণ বিনামূল্যে সরবরাহ করা হবে। এ সময় যাদের টিউশন ফি বকেয়া পড়েছে তা মওকুফ করানো যায় কি না, সে বিষয়টিও বিবেচনায় রাখা হচ্ছে। স্মার্টফোন, নেট সংযোগ এবং টিভি-রেডিও না থাকার কারণে অতিদরিদ্র যেসব শিক্ষার্থী অনলাইন শিক্ষা থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত, করোনা বিদায় নেওয়ার পর ওইসব শিক্ষার্থীকে স্কুল শিক্ষকদের মাধ্যমে অতিরিক্ত ক্লাস করানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। যাতে তারা তাদের লেখাপড়ার ঘাটতি কিছুটা হলেও পূরণ করতে পারে। শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার আগেই এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হবে। যাতে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে যোগ দেওয়ার পরপরই এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন সহজ হয়। এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় অর্থ ছাড় করাতে দীর্ঘসূত্রতার ফাঁদে পড়তে না হয় সে বিষয়েও সরকার আগাম প্রস্তুতি নিচ্ছে। করোনা সংকটে যেসব শিক্ষার্থীর ঝরে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে তাদের নাম-ঠিকানা ও আনুষঙ্গিক তথ্যাদি সংগ্রহসহ বেশকিছু কার্যক্রম ইতোমধ্যেই শুরু করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে মাধ্যমিক স্তরের মেয়েদের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেখা গেছে প্রতি বছর প্রাথমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের চেয়ে মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থী বেশি ঝরছে। তিন স্তরেই ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের ঝরে পড়ার হার অনেক বেশি। শিক্ষা ব্যবস্থায় কোভিড-১৯ এর প্রভাব পর্যালোচনাকারী শিক্ষাবিদদের আশঙ্কা, এ মহামারির পর ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী হয়তো স্কুলে আর নাও ফিরতে পারে। কেননা চলমান মহামারির কারণে দরিদ্র অনেক পরিবার অতি দরিদ্রের কাতারে গিয়ে দাঁড়াবে। সেক্ষেত্রে তারা তাদের সন্তানদের স্কুলে না পাঠিয়ে কাজে পাঠাতে চাইবে। এমনকি মহামারি-উত্তর পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক অবস্থার জন্য অনেক শিক্ষার্থীর পক্ষেই শিক্ষা উপকরণ ক্রয় করা কঠিন হবে। অন্যদিকে করোনা মহামারির ফলে শিক্ষায় বৈষম্য আরও প্রকট হয়েছে। সংক্রমণ বৃদ্ধির আশঙ্কায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চললেও দরিদ্র ও গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা এ সুযোগ গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে, অর্ধেক শিক্ষার্থীও এসবের আওতায় নেই। এক্ষেত্রে শহরের শিক্ষার্থীরা এগিয়ে রয়েছে। গ্রামে অনেকে এ সুযোগ পেলেও উলেস্নখযোগ্য অংশই পিছিয়ে থাকছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই বৈষম্যও ঝরে পড়ার ক্ষেত্রে প্রভাবক ভূমিকা পালন করতে পারে। করোনার কারণে শিক্ষার্থীরা টিউশন ফি না দেওয়ায় অধিকাংশ বেসরকারি ও প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষকদের বেতন ঠিকমতো দিতে পারছে না। এতে তারাও চরম দুরবস্থার মধ্যে রয়েছে। তাদের আর্থিক অসঙ্গতি দূর করার বিষয়টিতেও সরকার গুরুত্ব দিতে চাচ্ছে। অন্যদিকে উচ্চ মাধ্যমিকে ঝরে যাওয়ার পেছনের কারণ অনেকটা মাধ্যমিকের মতোই। তবে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হয়েও অনেক শিক্ষার্থী পরিবারকে সহায়তার জন্য নানা কাজে যুক্ত হয়। অনেকে কারিগরি শিক্ষায় চলে যায়। আবার অনেকে শ্রমিক হিসেবে দেশের বাইরে চলে যায়। ফলে ঝরে পড়ার হার কমানোর ক্ষেত্রে এসব বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে। প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালে প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ছিল ১৭.৯ শতাংশ, ২০১৮ সালে ১৮.৬ শতাংশ, ২০১৭ সালে ১৮.৮৫ শতাংশ, ২০১৬ সালে ১৯.২ শতাংশ, ২০১৫ সালে ২০.৪ শতাংশ এবং ২০১৪ সালে ২০.৯ শতাংশ। অথচ ২০০৯ সালে এই ঝরে পড়ার হার ছিল ৪৫.১ শতাংশ। তারপর থেকে ৫ বছর নানা উদ্যোগের ফলে ব্যাপকভাবে ঝরে পড়া কমেছে। কিন্তু গত ৫ বছর ধরে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর হার একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। মাধ্যমিকে ২০১৮ সালে ঝরে পড়ার হার ছিল ৩৭.৬২ শতাংশ, ২০১৭ সালে ৩৭.৮১ শতাংশ, ২০১৬ সালে ৩৮.৩০ শতাংশ, ২০১৫ সালে ৪০.২৯ শতাংশ এবং ২০১৪ সালে ৪১.৫৯ শতাংশ। অথচ ২০০৯ সালে মাধ্যমিকের ঝরে পড়ার হার ছিল ৫৫.৩১। তার পরের ৫ বছর দ্রম্নতগতিতে ঝরে পড়ার হার কমলেও গত ৫ বছরে তা ঝিমিয়ে পড়েছে। আর উচ্চ মাধ্যমিকে ২০১৮ সালে ঝরে পড়ার হার ছিল ১৯.৬৩ শতাংশ, ২০১৭ সালে ১৯.৮৯ শতাংশ, ২০১৬ সালে ২০.০৮ শতাংশ, ২০১৫ সালে ২০.৭ শতাংশ এবং ২০১৪ সালে ২১.৩৭ শতাংশ। ২০০৯ সালে ওই স্তরেও ঝরে পড়ার হার ছিল ৪২.১১ শতাংশ। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের মতোই পরবর্তী ৫ বছর ব্যাপকভাবে ঝরে পড়ার হার কমলেও গত ৫ বছরে প্রায় একই রয়েছে।