করোনার অ্যান্টিবডি টেস্ট নিয়ে দোটানায় স্বাস্থ্য বিভাগ

প্রকাশ | ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০০

জাহিদ হাসান
দেশে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রকৃত চিত্র জানা ছাড়াও প্রয়োজন অনুপাতে নমুনা পরীক্ষা এবং ভ্যাকসিনের সুষম বণ্টনে এই মুহূর্তে সবার অ্যান্টিবডি টেস্ট জরুরি হয়ে পড়ছে। কিন্তু সংক্রমণের সাত মাসেও এ টেস্ট চালুর ব্যাপারে দোটানায় রয়েছে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ। এমন পরিস্থিতিতে এখনই পরীক্ষটি চালু করা না গেলে ভবিষ্যতে করোনাভাইরাস মোকাবিলা আরও কঠিন হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেছেন। সংক্রমণ শুরুর পর থেকেই জনস্বাস্থ্যবিদরা অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডি পরীক্ষার জন্য একাধিকবার পরামর্শ দিয়েছেন। এরই ধারাবহিকতায় সর্বশেষ গত ১৭ সেপ্টেম্বর কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভায় অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডি টেস্ট নিয়ে আলোচনা হয়। যেখানে পিসিআর টেস্টের মাধ্যমে তুলনামূলক কম করোনা পরীক্ষা হচ্ছে বলে পরামর্শক কমিটি মন্তব্য করেছেন। নমুনা পরীক্ষার পরিমাণ বৃদ্ধি করতে পারলে আরও বেশি রোগী শনাক্ত করার সম্ভব উলেস্নখ করে অ্যান্টিবডি টেস্টের ওপর গুরুত্বারোপ করে এই কমিটি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা ডা. মোজাহেরুল হক যায়যায়দিনকে বলেন, খুবই অল্প সময়ে (১৫ মিনিট) নামমাত্র খরচে অ্যান্টিবডি টেস্ট করা যায়। এই পদ্ধতিতে কার দেহে ভাইরাসটি আছে, কার মধ্যে নেই, শরীরে কতটুকু প্রতিষেধক ক্ষমতা রয়েছে, আক্রান্তদের কী চিকিৎসা দিতে হবে তা সহজেই জানা সম্ভব। ফলে আক্রান্তদের পৃথক করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া ছাড়াও যার অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে তার থেকে পস্নাজমা নিয়ে ৬ শনাক্তকৃত ব্যক্তিকে দেওয়া যাবে। এভাবে উপসর্গহীনদের ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চিত হতে আরটিপিসিআর টেস্টের পরামর্শ ছাড়াও অঞ্চলভেদে আক্রান্তদের সঠিক সংখ্যা নিশ্চিত হওয়া যায়। এ জন্য দেশে ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের শুরুতে যখন মাত্র ৫টি এলাকায় সংক্রমণ দেখা দেয়, তখনই তিনি এন্টিজেন ও এন্টিবডি টেস্ট চালু করার পরমর্শ দিয়েছিলেন। যা বাস্তবায়িত হলে এত সংখ্যক লোক আক্রান্ত হতো না। এতে শনাক্তদের চিকিৎসার জন্য পৃথকীকরণ, তাদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের কনট্রাক্ট ট্রেসিং সহজ হতো। কিন্তু দীর্ঘ সাত মাসের মাথায় এসেও এন্টিবডি টেস্ট নিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগ অন্ধকারে আছে। তারা বলছেন, দেশে এখন পর্যন্ত (বৃহস্পতিবার) ৩ লাখ ৫৫ হাজার ৩৮৪ জন করোনা শনাক্ত হয়েছেন। যাদের মধ্যে ৫ হাজার ৭২ জনের মৃতু্য হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে ভাইরাসটির সেকেন্ড ওয়েভ তথা দ্বিতীয় ঢেউয়ের ব্যাপারে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও একাধিক রাষ্ট্রীয় দায়িত্বশীল ব্যক্তি পুণঃসংক্রমণ বৃদ্ধির আশঙ্কা করছেন। তারা মূলত জনস্বাস্থ্যবিদদের সঙ্গে বিশদ আলোচনার প্রেক্ষিতেই এই ইঙ্গিত দিয়েছেন। ফলে দেশে করোনার নমুনা পরীক্ষা, মহামারির প্রকৃত চিত্র জানা ছাড়াও ভবিষ্যতে ভ্যাকসিন কার্যক্রমের প্রয়োজনে হলেও অ্যান্টিবডি পরীক্ষা চালু জরুরি। জানতে চাইলে বিশিষ্ট চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী যায়যায়দিনকে বলেন, অ্যান্টিবডি টেস্ট বা সেরো সার্ভিলেন্সের (অতীতে কতজন ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিল তার সঠিক পরিসংখ্যান) মাধ্যমে অতীতে সংক্রমণ সংখ্যা, ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল, সমাজ, পরিবার, বস্তি বা শিল্প-কারখানার মানুষজন কীভাবে সংক্রমিত হয়েছে তা বোঝা যাবে। পরীক্ষাটির আরেকটা টাইপ বা ধরন হলো প্রতিরোধ ক্ষমতা, কিন্তু এটি আদৌ হয় কিনা, করোনা থেকে সুস্থ ব্যক্তি পুনরায় আক্রান্ত হতে পারে কিনা, দেহে কতদিন পর্যন্ত এ ভাইরাস কার্যকর থাকে দেশে তা নিয়ে গবেষণা নেই। এখনই তা করতে না পারলে ভবিষ্যতে সংক্রমণ আরও বাড়তে পারে। সুতরাং সরকারের উচিত যথাযথ নীতিমালার মাধ্যমে এটির অনুমতি দেওয়া। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বিশিষ্ট ভাইরারোলজিস্ট ডা. মোশতাক হোসেন যায়যায়দিনকে বলেন, যাদের শরীরে অ্যান্টিবডি নেই তাদের ভ্যাকসিন প্রয়োজন। যাদের শরীরে ইতোমধ্যেই অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে গেছে তারা প্রতিমাসে অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করিয়ে যখন শরীরে অ্যান্টিবডি থাকবে না তখন ভ্যাকসিন দেবে। ফলে ভ্যাকসিন নীতিমালাতে অ্যান্টিবডি টেস্ট বাধ্যতামূলক করা দরকার। না হলে অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করা ছাড়া গণহারে ভ্যাকসিন দিলে ভ্যাকসিনের অপচয় হবে। তাছাড়া দেশে ১৭ কোটি মানুষের জন্য ভ্যাকসিনের প্রয়োজন হলেও কয়েক লাখ পাওয়া যাবে। ফলে অ্যান্টিবডি টেস্ট জরুরি। প্রসঙ্গত, দ্রম্নত সময়ের মধ্যে করেনোভাইরাস শানাক্তের্ যাপিড টেস্টের যৌক্তিকতা তুলে ধরে এই টেস্ট কী ধরনের হতে পারে সে বিষয়ে গত ৭ জুন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা পাঠায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গত ৯ জুলাই এ বিষয়ে একটি খসড়া নীতিমালা করে সেটি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। তার ১০ দিন পর অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলীকে প্রধান করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কোভিড-১৯ ল্যাবরেটরি পরীক্ষা সম্প্রসারণ নীতিমালাবিষয়ক বিশেষজ্ঞ কমিটি করে। এরপর সেটি কমিটির মতামতের জন্য পাঠায় এবং তাদের মতামতের জন্য ১০ কার্যদিবস ঠিক করে দেয়। এরপর বিশেষজ্ঞ কমিটি গত ৪ আগস্ট তাদের মতামত মন্ত্রণালয়ে পাঠায় এবং ১৮ আগস্ট এ বিষয়ক প্রেজেন্টেশন দেয়। এরপর মন্ত্রণালয় থেকে আরও সুবিন্যস্ত ও পরিমার্জিত করে দিতে বলা হলে সেটি গত ২৩ আগস্ট জমা দেওয়ার পর ৩১ আগস্ট মন্ত্রণালয় আবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠায়। আর এই ধীর গতির কারণে এন্টিবডি টেস্টের ব্যাপারে অন্ধকার থেকে বেড় হতে পারছেনা সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ।