করোনা-পরবর্তী অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথে দেশ

প্রকাশ | ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০০

আলতাব হোসেন
মহামারি করোনাভাইরাস শুধু মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বা প্রাণহানিতে থেমে নেই। বিশ্বের পুরো অর্থনৈতিক কাঠামোতে কাঁপন ধরিয়েছে। করোনাভাইরাসের ছোবল অর্থনীতি, বাণিজ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা ও জীবনযাপন বিপর্যন্ত করে তুলেছে। বিশ্বে অর্থনৈতিক মহামন্দার আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে সঠিক সময়ে সরকারের আর্থিক প্রণোদনা ও সামাজিক সুরক্ষায় নেওয়া পদক্ষেপে বাংলাদেশের অবস্থা ততটা সংকটময় নয়। রেকর্ড রেমিট্যান্স, টেকসই কৃষি উন্নয়ন ও রপ্তানি আয়ের উপর ভর করে করোনা পরবর্তী অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। করোনা মোকাবিলায় সরকার ঘোষিত এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা ঋণে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে গতি ফিরতে শুরু করেছে। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ছে। জুলাই মাসে বেসরকারি খাতে এক বছর আগের তুলনায় ঋণ বেড়েছে ৯ দশমিক ২০ শতাংশ; বলছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, দ্বিতীয় দফায় করোনার ছোবলে না পড়লে বাংলাদেশ টেকসই অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করতে পারবে। তবে বাংলাদেশে যেসব দেশ থেকে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয় আসে সেসব দেশ নতুন করে বিপর্যয়ের মুখে না পড়লে বাংলাদেশের অর্থনীতির গতি সামনের দিকে থাকবে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক-২০২০ আপডেট নামে এক প্রতিবেদনে এমন আশা প্রকাশ করেছে। এডিবির বাংলাদেশ প্রতিনিধি মনমোহন প্রকাশ গণমাধ্যমকে বলেন, বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বেড়েছে। রেকর্ড রেমিট্যান্স আসছে। রপ্তানি স্বাভাবিক ধারায় ফিরছে। ফেরত আসা প্রবাসী শ্রমিকরা আবার ফিরে যেতে শুরু করেছেন। পোশাক খাতে বাতিল হওয়া রপ্তানি আদেশ তুলে নেওয়া হচ্ছে। আগস্ট মাস থেকে অর্থনীতি সচল রাখার চাকা আবার ঘুরতে শুরু করেছে। আর্থিক চাপ থাকার পরও সরকারের প্রণোদনার প্যাকেজে সামাজিক সুরক্ষা কার্যকর হয়। আশা করা হচ্ছে আগামীতে বাংলাদেশের অর্থনীতি টেকসই হবে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র গবেষক ড. এম আসাদুজ্জামান বলেন, \হকরোনার প্রভাব কেটে গেলে বাংলাদেশের অর্থনীতি সামনের দিকে এগিয়ে যাবে- এমন দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার খসড়ায়। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধারা হলেও আগামী অর্থবছরে এই লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৮ দশমিক ২৯ শতাংশ। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এডিবির এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক-২০২০ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। সদ্য বিদায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরে করোনা মহামারির মধ্যেও বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ যা বাংলাদেশের অর্থনীতির শক্তিমত্তা প্রকাশ করেছে। এর আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ যা ছিল এশিয়ার সব দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। বাংলাদেশে বাড়তে শুরু করেছে রেমিট্যান্স আয়। চলতি সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দশ দিনে ১০০ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স আয় দেশে এসেছে। জুনে ১৮৩ কোটি ডলার, জুলাই মাসে ২৬০ কোটি ডলার আসে। আগস্ট মাসে আগের মাসের চেয়ে ৩৬ শতাংশ বেশি অর্থ আসে। এপ্রিল মাত্র ১০৯ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স আসে। তিন মাস ধরে রপ্তানি আয়ও বাড়তির দিকে। জুলাই মাসে ৩৯১ কোটি ডলারের রপ্তানি হয়। জুলাই-আগস্ট দুই মাসে রপ্তানি আয় আগের চেয়ে দুই শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। যেখানে এপ্রিলে মাত্র ৫২ কোটি ডলারের আয় হয়েছিল। করোনার চলমান ধ্বংসযজ্ঞের পর দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক খাতের এই সুরক্ষা ধরে রাখতে এখনই করোনা পরবর্তী অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে একটি রোডম্যাপ তৈরির তাগিদ দিচ্ছেন শিল্প উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, করোনার ক্ষতি পোষাতে সাপ্তাহিক ছুটি কমিয়ে একদিন করা। করোনার পর পরিস্থিতি সামাল দিতে জরুরিভাবে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপের পথনকশা চূড়ান্ত করার তাগিদ অর্থনীতিবিদদের। বিশ্ব ব্যাংক, মার্কিন ম্যাগাজিন ফরেন পলিসি ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বলছে, ১৯৩০ সালের মহামন্দা পরবর্তী আবারও একটি মহামন্দার সম্মুখীন বিশ্ব। বিশ্বের সব দেশই এখন চিন্তিত অর্থনীতি নিয়ে। সংকট থেকে রক্ষা পেতে বিশ্বের প্রায় সব দেশই পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা শুরু করে দিয়েছে। নানা ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনা পরবর্তী মূল কাজ হবে অর্থনীতিকেই গুরুত্ব দেওয়া। কারণ অর্থনীতিকে কেন্দ্র করেই সুশাসন ও উন্নয়নের অন্য সূচকগুলো চালিত হয়। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রতিটি খাত গত সাত মাসে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে মোটা দাগে কৃষি, সেবা এবং শিল্প খাতে ভাগ করা হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশের অর্থনীতিতে এখন সেবা খাতের অবদান প্রায় ৫০ শতাংশ। এছাড়া শিল্প খাত ৩৫ শতাংশ এবং কৃষির অবদান ১৪ শতাংশের মতো। করোনা পরিস্থিতির জন্য অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বন্ধ থাকায় সেবা খাত ও শিল্প খাত মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বলেছে, করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশ ৩০২ কোটি ১০ লাখ ডলার পর্যন্ত আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে পারে। সংস্থাটির মতে, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে ব্যবসা-বাণিজ্য ও সেবা খাতে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তথ্য অনুযায়ী, আগামী এক বছরে চাকরি হারাতে পারে দেশের প্রায় নয় লাখ মানুষ। করোনা পরবর্তীতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি একটি অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে মনে করা হচ্ছে। বড়োসড়ো অর্থনৈতিক ধাক্কায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করনোকালে দেশের নিম্ন আয়ের মানুষের ৭৫ শতাংশ আয় কমে গেছে। দারিদ্র্যের হার ১৫ শতাংশ বেড়ে ৩৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। হতদরিদ্র মানুষের আয় ৬০ শতাংশ কমেছে। আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম প্রায় বন্ধ। প্রায় সাত মাস ধরে ফুটপাতের দোকান থেকে শুরু করে সুপারমল, গার্মেন্ট, গণপরিবহণ, পর্যটন, হোটেল, মোটেল, বিনোদনকেন্দ্র, বিমান চলাচল, নৌ চলাচল, পোল্ট্রি শিল্প, নিত্যপণ্যের দোকানসহ সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে আছে। বিপুল লোকসানে পড়ে যাওয়া বহু কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে। অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম থেমে গেছে, ফ্ল্যাট-পস্নটের দাম পড়ে গেছে। কর্ম হারিয়েছেন ক্ষুদ্র বিপণিবিতান থেকে শুরু করে সংবাদপত্র শিল্পের কর্মীরা। ভিক্ষুক ও হকাররাও বিপদে পড়েছেন। বিভিন্ন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত শ্রমিকরা কর্ম হারিয়ে কষ্টে আছেন। মুক্ত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের তথ্যে, ইতোমধ্যে ছাঁটাই ও কারখানা বন্ধ হয়ে কাজ হারিয়েছেন ৩ লাখ ২৪ হাজার ৬৪৮ গার্মেন্টশ্রমিক। কর্মসংস্থান নিয়ে অনিশ্চয়তায় দেশের প্রায় ৪০ লাখ পোশাকশ্রমিক। সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সবুজ সিকদার বলেন, কর্ম হারিয়ে গার্মেন্টশ্রমিকরা মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। প্রণোদনা ঘোষণাসহ ছয় দফা দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সহায়তা হিসেবে এডিবি এরই মধ্যে বাংলাদেশকে প্রাথমিকভাবে ৬০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ এবং ৪ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার অনুদান দিয়েছে। এছাড়া ২০২১-২৩ পর্যন্ত সময়ে সহযোগিতা করতে আরও ১১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থ সহায়তা দেবে। এ বিষয়ে সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক যায়যায়দিনকে বলেন, করোনা মোকাবিলায় কৃষকদের জন্য কয়েকটি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সরকার। এর মধ্যে ৪ শতাংশ সুদ হারে ঋণ প্রদান, নয় হাজার কোটি টাকার কৃষি ভর্তুকি, ৮৬০ কোটি টাকার বোরো ধান সংগ্রহ, ২০০ কোটি টাকার কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়, ১৫০ কোটি টাকার আমন বীজ প্রদানসহ বিভিন্ন পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। করোনাকালে কৃষি অর্থনীতিতে যা সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিলস্নুর রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, বিশ্বে চাকরি বাজার মন্দা, প্রবাসী শ্রমিক দেশে ফিরছে। করোনা দীর্ঘদিন অবস্থান করলে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয় কমতে পারে। এতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ব্যবসা-বাণিজ্যে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইজিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. সাহাদাত হোসেন সিদ্দিকী যায়যায়দিনকে বলেন, কোভিড পরবর্তী অর্থনীতি পুনর্গঠনে দেশীয় উৎপাদন বাড়াতে হবে। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত শ্রমজীবীদের সামাজিক সুরক্ষার আওতার মধ্যে আনতে হবে। সাপ্তাহিক ও সরকারি ছুটি কমিয়ে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি যথাসম্ভব পুষিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে।