এমসি কলেজে গণধর্ষণের প্রতিবাদে উত্তপ্ত সিলেট

ছাত্রলীগের ছয় কর্মীসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা, ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি

প্রকাশ | ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০০

কাইয়ুম উলস্নাস ও সুমন আহমদ, সিলেট

ক্ষোভে উত্তাল সিলেট। ছাত্রসমাজসহ সিলেটের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এমসি (মুরারীচাঁদ) কলেজ ছাত্রাবাসে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে গণধর্ষণের প্রতিবাদে ফুসে উঠেছে। নগরীজুড়ে শনিবার দিনভর দফায় দফায় বিক্ষোভ-সমাবেশ ও মিছিল হয়েছে। প্রতিবাদ জানাতে স্থানীয় শহিদ মিনারে জড়ো হয়েছেন বিশিষ্টজনরা। বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চেয়ে অবিলম্বে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন। শুক্রবার রাত ১০টার দিকে কয়েকজন দুর্বৃত্ত এ গণধর্ষণের ঘটনা ঘটায়। তারা ছাত্রলীগের কর্মী বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। পরে শাহপরাণ থানা পুলিশ ছাত্রাবাস থেকে স্বামীসহ ওই গৃহবধূকে উদ্ধার করে। ভিকটিমকে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি করা হয়েছে। এ ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। শনিবার বিকালে এমসি কলেজের সামনে ধর্ষণের প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। এরই মধ্যে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে ছাত্রাবাসের দুই গার্ডকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এদিকে শনিবার সকালে ৯ জনকে আসামি করে শাহপরাণ থানায় ধর্ষিতার স্বামী বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় ৬ জনের নাম উলেস্নখ করে অজ্ঞাত আরও ৩ জনকে আসামি করা হয়েছে। এজহারনামীয় আসামিরা হলেন- এম সাইফুর রহমান, শাহ মাহবুবুর রহমান রনি, তারেক আহমদ, অর্জুন লস্কর, রবিউল ইসলাম ও মাহফুজুর রহমান। এদের সবাই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আসামিদের মধ্যে তারেক ও রবিউল বহিরাগত; বাকিরা এমসি কলেজের ছাত্র। তাদের গ্রেপ্তারে পুলিশের অভিযান চলছে। এদিকে গণিত বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটিতে দুজন হোস্টেল সুপারকে রাখা হয়েছে। এমসি কলেজের অধ্যক্ষ সালেহ আহমদ এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, তাদের কেন আটকে রাখা হয়েছিল এবং তাদের সঙ্গে কী আচরণ করা হয়েছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। জানা যায়, শুক্রবার সিলেটের এমসি কলেজে স্বামীর সঙ্গে ঘুরতে যান ওই গৃহবধূ। এক পর্যায়ে রাত ৮টার দিকে তরুণীর স্বামী সিগারেট খাওয়ার জন্য এমসি কলেজের মূল গেটের বাইরে বের হন। এ সময় কয়েকজন দুর্বৃত্ত গৃহবধূকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যেতে চায়। তার স্বামী বাধা দিলে তাকে মারধর শুরু করেন তারা। একপর্যায়ে গৃহবধূ ও তার স্বামীকে অভিযুক্তরা এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে নিয়ে যায়। সেখানে স্বামীকে বেঁধে তিন-চারজন গৃহবধূকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। এ ব্যাপারে সিলেট মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (দক্ষিণ) মোহা. সোহেল রেজা বলেন, রাত ৯টার দিকে স্বামীকে ধরে নিয়ে কিছু ছেলে মারধর করে এবং গৃহবধূকে ছাত্রাবাসের ভেতরে নিয়ে গণধর্ষণ করেছে বলে অভিযোগ পেয়েছি। সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (গণমাধ্যম) জ্যোতির্ময় সরকার বলেন, অভিযোগকারী গৃহবধূর স্বামীর বাড়ি সিলেটের দক্ষিণ সুরমা এলাকায়। শুক্রবার বিকালে তিনি স্ত্রীসহ টিলাগড় এলাকায় বেড়াতে গেলে এ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। তিনি বলেন, অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে ছাত্রাবাসে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। সে সঙ্গে কলেজ কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ছাত্রাবাস ছাড়ছেন শিক্ষার্থীরা। পুলিশ এ ঘটনায় এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে।' এদিকে সিলেটের এমসি কলেজে ছাত্রাবাসে গৃহবধূ ধর্ষণের ঘটনায় আন্দোলনে নেমেছেন শিক্ষার্থীরা। শনিবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে এমসি ও সরকারি কলেজের শতাধিক শিক্ষার্থী কলেজের সামনে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, করোনা পরিস্থিতিতে কলেজ বন্ধ থাকার পরও ছাত্রাবাস কীভাবে খোলা রাখে কলেজ কর্তৃপক্ষ। এসব অপরাধ কর্মকান্ডের বিষয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষ অবগত থাকার পরও কেন ছাত্রাবাস বন্ধ করে দেওয়া হলো না। আজ আমাদের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠে কলঙ্কের দাগ লেগেছে। এসময় শিক্ষার্থীরা ধর্ষণ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দ্রম্নত গ্রেপ্তারের দাবি জানান। অন্যথায় তারা আরও কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করবেন বলে জানান। ছাত্রাবাস ছাড়ার নির্দেশ : ছাত্রাবাসে গৃহবধূকে ধর্ষণের ঘটনায় ছাত্রাবাস ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। শনিবার দুপুর ১২টার মধ্যে ছাত্রাবাস ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন হোস্টেল সুপার জামাল উদ্দিন। করোনার সময় হোস্টেল বন্ধ থাকলেও ছাত্ররা কীভাবে ছাত্রাবাসে থাকছে এ বিষয়ে তিনি বলেন, কলেজ বন্ধ, হোস্টেলও বন্ধ রয়েছে। তবে কিছু শিক্ষার্থী টিউশনি করানোর কারণে ছাত্রাবাসে থাকছেন। যারা এখন হল ছাড়বেন না তাদের বিরুদ্ধে কলেজ কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেবে। ছাত্রবাস যেন সাইফুরের আস্তানা ছাত্রাবাসে তুলে নিয়ে স্বামীকে বেঁধে স্ত্রীকে গণধর্ষণের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার আসামি ছাত্রলীগ ক্যাডার হিসেবে পরিচিত এম সাইফুর রহমানের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনেও আরেকটি মামলা হয়েছে। কারণ সাইফুর ছাত্রাবাসকে অস্ত্র গুদাম ও জুয়ার আস্তানা বানিয়ে ফেলেছিল। পুলিশি অভিযানে সেই আস্তানা ভেঙে দেওয়া হয়। গণধর্ষণের ঘটনার পর শুক্রবার রাত ২টার দিকে এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে তলস্নাশি চালিয়ে সাইফুরের রুম থেকে একটি আগ্নেয়াস্ত্রসহ প্রচুর পরিমাণে দেশীয় ও ধারাল অস্ত্র উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় শনিবার সকালে তার বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। করোনার কারণে কলেজ ও ছাত্রাবাস বন্ধ থাকলেও সাইফুর রহমানসহ ছাত্রলীগের কয়েকজন ক্যাডার ছাত্রাবাসে বসবাস করত। ছাত্রাবাসে অবস্থান করে কলেজ ক্যাম্পাস, টিলাগড় ও বালুচর এলাকায় তারা নিয়মিত ছিনতাই ও অপহরণ করত। রাতে ছাত্রাবাসে জুয়া ও মাদকের আসরও বসাত বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। ছাত্রাবাসে থাকার সুযোগ দিত কর্তৃপক্ষ! সিলেট এমসি কলেজের কর্তৃপক্ষ ছাত্রাবাসে থাকার সুযোগ করে দিত বহিরাগতসহ কলেজ শিক্ষার্থীদের। তা আবার সরকারের নির্দেশনা অমান্য করেই। করোনাভাইরাস নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। সরকারের নির্দেশনা থাকার পরও এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে প্রভাব খাটিয়ে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে থাকত ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী। সবকিছু জানার পরও মুখ বন্ধ করে থাকতে হতো কলেজ কর্তৃপক্ষের। বহিরাগত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি কলেজের বিভিন্ন বিভাগের সাধারণ শিক্ষার্থীরাও ছাত্রাবাসে বসবাস করে আসছিলেন। বিষয়টি কলেজ কর্তৃপক্ষের জানা থাকলেও কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এমসি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর সালেহ উদ্দিন বলেন, 'করোনা পরিস্থিতিতে সরকারি নির্দেশনা পাওয়ার পরপরই কলেজ ও ছাত্রাবাস বন্ধ করে দেওয়া হয় নোটিশ দিয়ে। তবে অনেক শিক্ষার্থী রয়েছে কলেজে পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরি ও টিউশনি করে। সেইসব শিক্ষার্থী ছাত্রাবাসে থাকার জন্য হোস্টেল সুপারের মাধ্যমে আমাকে বিষয়টি জানিয়েছিল। তখন আমি হোস্টেল সুপারকে বলেছি, যারা বৈধ তাদের কয়েকজনকে ছাত্রাবাসে থাকার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য।' তিনি বলেন, 'ছাত্রাবাসের ৬টি বস্নক ও পূর্বদিকে একটি ৪তলা ভবন রয়েছে। সেখানে প্রায় ৩০০ শিক্ষার্থী থাকত। কলেজ ও ছাত্রাবাস বন্ধ হওয়ার পর মানবিক দিক বিবেচনা করে ছাত্রাবাসে প্রায় ২০-৩০ জনকে থাকতে মৌখিকভাবে বলা হয়। বহিরাগত কেউ থাকছে কি না বা কলেজের শিক্ষার্থীরা নির্দেশনা মানছে কি না সে বিষয় দেখতেন হোস্টেল সুপার। শুক্রবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ছাত্রাবাসের কয়েকটি কক্ষ তলস্নাশি করে বন্ধ করা হয়।' গণধর্ষণের শিকার তরুণী মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এদিকে এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে গণধর্ষণের শিকার তরুণী মানসিকভাবে আতঙ্কিত অবস্থায় আছেন। তবে তার শারীরিক কোনো ঝুঁকি আপাতত নেই। সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইউনুছুর রহমান শনিবার দুপুরে এ তথ্য জানিয়েছেন। ওই তরুণী সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) চিকিৎসাধীন রয়েছেন। দুপুরে হাসপাতালের পরিচালক ওসিসিতে ওই তরুণীকে দেখতে যান। পরে তিনি বলেন, 'তরুণীর চিকিৎসার খোঁজ-খবর নিতে শনিবার সকালে ওসিসিতে গিয়েছিলাম। শারীরিক কোনো ঝুঁকি নেই। তবে মানসিকভাবে তিনি কিছুটা আতঙ্কিত। ওসিসির মাধ্যমে তার শারীরিক পরীক্ষা করা হবে। এর মধ্যে একটি পরীক্ষা ঢাকায় করানো হতে পারে। সে জন্য নমুনা পাঠানো হবে। পরে সবগুলো প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট বিভাগে হস্তান্তর করা হবে।' পুলিশ খোঁজ না পেলেও ফেসবুকে সরব আসামিরা এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে শুক্রবার সন্ধ্যায় গণধর্ষণের সংবাদ প্রচারের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ধর্ষণের ঘটনায় জড়িতদের ছবি ভাইরাল হয়। পুলিশ আসামিদের হদিস করতে না পারলেও অভিযুক্তরা ফেসবুকে সরব রয়েছেন। শনিবার এই মামলার দুই আসামিকে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিতে দেখা গেছে। স্ট্যাটাসে তারা নিজেদের নির্দোষ দাবি করেছেন। গণধর্ষণ মামলার ৫ নম্বর আসামি রবিউল ইসলাম শনিবার বেলা ১১টার দিকে ফেসবুকে পোস্ট দেন। এর আগে এই মামলার ৬ নম্বর আসামি মাহফুজুর রহমান মাসুমও ফেসবুকে লেখেন। ফেসবুকে সরব থাকার পরও আসামিদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে মহানগর পুলিশের শাহপরান থানার (ওসি) কাইয়ুম চৌধুরী বলেন, আমরা আসামিদের গ্রেপ্তারে সব ধরনের চেষ্টা চালাচ্ছি। পৃথক স্থানে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এ বিষয়ে সিলেট নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (মিডিয়া) জ্যোতির্ময় সরকার বলেন, ফেসবুক ওয়ালে আসামিদের স্ট্যাটাস দেওয়ার বিষয়টি নজরে ছিল না। এ বিষয়টি তদন্তকারী কর্মকর্তার সঙ্গে শেয়ার করব।