হুমকির মুখে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য

প্রকাশ | ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০০

আলতাব হোসেন
জলবায়ুর প্রভাবে একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য আজ হুমকির মুখে। একদিকে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা, ফণি, বুলবুল ও আম্পানের তান্ডব রোধ, অন্যদিকে মায়ের মতো বুক পেতে উপকূলীয় এলাকার মানুষ ও সম্পদ রক্ষা করছে সুন্দরবন। প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি মনুষ্যসৃষ্ট দূষণেও হুমকির মুখে সুন্দরবনের পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্য। আশপাশের নদীতে একের পর এক কয়লা ও তেলবাহী জাহাজ ডুবছে। বড় বন্যায় সুন্দরবনের নদীগুলোতে লবণপানির উচ্চতা বাড়ছে। এতে সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে পড়েছে ইরাবতী ও গোলাপি ডলফিন। এক সময় রাত-দিনে ছয়বার রূপ বদল করত সুন্দরবন। এখন সে দৃশ্যের দেখা মেলে না। করোনায় নদী আর সমুদ্রতীরে মানুষের আনাগোনা কমে যাওয়ায় ডলফিনের চলাচল দৃশ্যমান হয় কক্সবাজার ও সুন্দরবন এলাকায়। ডলফিনের লাফালাফি দেখে সাধারণ মানুষের উচ্ছ্বাস এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পায়। কিন্তু সাগরতীরে এসে মারা পড়ে অনেক বিরল ডলফিন। বৈরী আবহাওয়া ও মানুষের অত্যাচারে গভীর সাগরে ফিরে যাচ্ছে ডলফিন। গবেষকরা বলছেন, সুন্দরবনের সোয়াচ অব নো-গ্রাউন্ডে রয়েছে তিমি, ডলফিন, হাঙ্গরসহ বিভিন্ন প্রজাতির জলজ প্রাণীর অভয়ারণ্য। সুন্দরবন থেকে মাত্র ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত সাবমেরিন ক্যানিয়ন বা 'সোয়াচ অব নো-গ্রাউন্ড'কে বলা হয় ডলফিনের স্বর্গ। সুন্দরবনে তিন ধরনের ডলফিন ও এক প্রজাতির পাখনাবিহীন শুশুক পাওয়া যায়। সম্প্রতি কয়েকটি মৃত ডলফিন উদ্ধার করেছে বন বিভাগ। জলবায়ুর প্রভাবে বন্যায় লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার কারণেই ডলফিনের মৃতু্য হয় বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) নির্বাহী সহসভাপতি ডা. মো. আব্দুল মতিন বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সুন্দরবনের মধ্যে নদীগুলোর পানির উচ্চতা বাড়ছে বছরে তিন থেকে আট মিলিমিটার। ফলে জোয়ারের সময় বনভূমি ডুবে সংকুচিত হচ্ছে বন্যপ্রাণীর বিচরণক্ষেত্র। বন্যা, ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে নদীর পানির লবণাক্ততা বাড়ছে। এতে কমে আসছে বন্যপ্রাণীর বিচরণক্ষেত্র। বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবে হিমবাহ ও মেরু অঞ্চলের বরফ গলার কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ইতোমধ্যে সুন্দরবনের প্রায় তিনশ কিলোমিটার এলাকা লবণপানিতে ডুবে থাকে। পানিতে ডুবে গেছে ছোট ছোট কয়েকটি দ্বীপ। এতে ঝুঁকিতে পড়েছে বিপন্ন ইরাবতী ও গোলাপি ডলফিন। ডলফিনের উপস্থিতি মানেই জলীয় পরিবেশ অনেকটাই স্বাভাবিক। প্রধান বন সংরক্ষক আমীর হোসাইন চৌধুরী যায়যায়দিনকে বলেন, ইরাবতী ডলফিনের পিঠে ছোট ত্রিকোণ একটি পাখনা আছে। যার অগ্রভাগ প্রায় গোলাকৃতি ও ভোঁতা। এদের ঠোঁটহীন মাথাও ভোঁতা। সোজা মুখাবয়ব এবং ঘাড়ের কাছে ভাঁজ সদৃশ্যমান। পূর্ণবয়স্ক ইরাবতী ডলফিন আকারে দুই থেকে ২.৭৫ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। এদের পিঠ ও পাশের রং ধুসর ও নীলাভ-ধুসর এবং পেটের রং কিছুটা হালকা। এরা দলবদ্ধ প্রাণী। ইরাবতী ডলফিন গ্রীষ্মমন্ডলীয় ও উপ-গ্রীষ্মমন্ডলীয় ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের উপকূলীয় লবণ ও মিঠাপানিতে বাস করে। উত্তর অস্ট্রেলিয়া ও নিউগিনি থেকে বঙ্গোপসাগর এবং ইরাবতী নদী, মেকং নদী, মহাকাম নদী, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদীতে ইরাবতী ডলফিন দেখতে পাওয়া যায়। এ বিষয়ে বন্যপ্রাণীবিষয়ক গবেষক ড. অধ্যাপক আমিরুল ইসলাম যায়যায়দিনকে বলেন, সুন্দরবনে রয়েছে বিপন্নপ্রায় আরেক প্রজাতির গোলাপি ডলফিন। এ গোলাপি ডলফিনকে কেউ বলে ডানাকাটা পরি, আবার কেউ বলে সাগরের রাজকন্যা। এক সময় হারহামেশায় দেখা মিললেও এখন বঙ্গোপসাগরে ও মোহনায় কালেভদ্রে এদের দেখা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। ২০০২ সালেও ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটির একটি জরিপে বাংলাদেশে গোলাপি ডলফিনের অস্তিত্ব পাওয়ার কথা জানা যায়। পৃথিবীজুড়ে গোলাপি ডলফিনকে বিপন্নপ্রায় প্রজাতি হিসেবে মনে করা হয়। ব্যতিক্রমী গায়ের রং ছাড়া এই ডলফিনের আরেকটি বিশেষত্ব হচ্ছে এর আকৃতি ও ওজন। পৃথিবীতে যে আট প্রজাতির ডলফিন আছে তার মধ্যে এটি সবচেয়ে বড় ও বিরল। বর্তমানে জলবায়ুর প্রভাবে লবণপানি বাড়তে থাকায় ঝুঁকির মুখে রয়েছে এই প্রজাতির ডলফিন। বন অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, সুন্দরবন নানা ধরনের প্রাণীবৈচিত্র্যে অনন্য। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থল হলো সুন্দরবন। সুন্দরবনে প্রায় ২৮৯ প্রজাতির স্থলজ প্রাণী বাস করে। এছাড়া আছে প্রায় ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, আট প্রজাতির উভচর এবং বিভিন্ন প্রজাতির মাছসহ ২১৯ প্রজাতির জলজ প্রাণী। রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছাড়া সুন্দরবনের উলেস্নখযোগ্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে রয়েছে চিত্রা হরিণ, মায়া হরিণ, রেসাস বানর, বনবিড়াল, সজারু, উদবিড়াল এবং বন্য শূকর। প্রায় ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপের মধ্যে সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় সদস্য মোহনার কুমির। এদের সংখ্যা প্রায় দুইশ। সাপের মধ্যে রাজগোখরা, অজগর, কেউটে উলেস্নখযোগ্য। অমেরুদন্ডী প্রাণীর মধ্যে কতিপয় মোলাস্কা এবং ক্রাসটেসিয়ান গুরুত্বপূর্ণ মৎস্যসম্পদ হিসেবে বিবেচিত। প্রজাতিগুলোর মধ্যে তালিকাবদ্ধ হয়েছে প্রায় ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ১৪ প্রজাতির কাঁকড়া, কয়েক প্রজাতির শামুক এবং ঝিনুক। সুন্দরবনে বসবাসকারী অধিকাংশ পাখিই স্থানীয় বা আবাসিক। প্রায় ৫০ প্রজাতির পাখি পরিযায়ী এবং এদের অধিকাংশই হাঁসজাতীয়। সুন্দরবনের কীটপতঙ্গের বৈচিত্র্যও সীমাহীন। সর্বশেষ জরিপ মোতাবেক সুন্দরবনে ১০৬টি বাঘ, এক থেকে দেড় লাখ চিত্রা হরিণ, ২০ হাজার বানর রয়েছে।