শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
করোনার ভয়াল থাবা

সংসার খরচের বাড়তি চাপে জীবনযাত্রার মান কমেছে

৬৯ শতাংশ মানুষ খাবার কেনা কমিয়ে দিয়েছে :বিশ্বব্যাংক ২০-২৫% বেতন কমেছে অধিকাংশ চাকরিজীবীর সন্তানদের অনলাইন ক্লাসের কারণে খরচ বেড়েছে
সাখাওয়াত হোসেন
  ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০০

করোনা সংকটে দেশের সাধারণ মানুষের আয় তীব্র গতিতে কমলেও জীবন-যাপনের ব্যয় বাড়ছে। একদিকে গত কয়েক মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রধান পণ্যগুলোর দাম ঊর্ধ্বমুখী। তার ওপর নতুন করে চাল, ভোজ্যতেল, ডাল ও চিনির দাম বাড়ছে। খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে মূল্যস্ফীতিও আকস্মিক উচ্চলাফ দিয়েছে। সব মিলিয়ে মধ্যম ও নিম্নআয়ের মানুষ এখন সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে। সম্প্রতি নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে দেশের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবনযাত্রার মান কতটা কমেছে তার চিত্র পাওয়া গেছে।

এ পরিস্থিতিতে পরিবার-পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকার তাগিদে সাধারণ মানুষ তাদের জীবনযাত্রার মান কমিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছে। বাড়তি ব্যয়ের জাঁতাকলে অনেকের জীবনযাত্রার মান কয়েক ধাপ নিচে নেমে এসেছে। এমনকি অনেকে খাবার কেনাও কমিয়ে দিয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে বসবাসকারীদের মধ্যে ৬৯ শতাংশ মানুষ খাবার কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। অর্থাৎ তারা করোনার আগে খাবার কেনার পেছনে যে পরিমাণ অর্থ খরচ করতেন এখন তার চেয়ে কম ব্যয় করছেন।

সিটি ব্যাংকের কর্মকর্তা আকতারুজ্জামান জানান, গত জুন মাস থেকে তার বেতন ১৬ শতাংশ কমেছে। এতে তার মাসিক আয় ৪০ হাজার টাকা থেকে কমে ৩৩ হাজার ৬০০ টাকায় এসে দাঁড়িয়েছে। অথচ আগের চেয়ে তার বাড়ি ভাড়া, ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ, যাতায়াত ও চিকিৎসাসহ সব মিলিয়ে সংসারের খরচ ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা বেড়েছে। এ অবস্থায় আগের মানে সংসার চালানো তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই আগের তিন রুমের ফ্ল্যাট ছেড়ে দিয়ে অক্টোবর মাস থেকে কম ভাড়ার দুই রুমের বাসায় উঠছেন। অক্সফোর্ড স্কুলে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া তার দুই সন্তানকে বাসার কাছে একটি সাধারণ স্কুলে ভর্তি করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তার স্ত্রী ইতোমধ্যে অনলাইনে মেয়েদের পোশাক বিক্রি শুরু করেছেন। তবে জীবনযাত্রার মান

এতখানি কমিয়ে আনার পরও সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন।

বসুন্ধরা শপিং কমপেস্নক্সের কসমেটিক ব্যবসায়ী মিনহাজুল ইসলাম জানান, আগে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষও নামি-দামি ব্র্যান্ডের বডিস্প্রে-পারফিউমসহ বিভিন্ন প্রসাধনী কিনত। তবে সম্প্রতি তা অনেকাংশেই কমেছে। মানুষ কম দামে নিত্যপ্রয়োজনীয় কসমেটিকই বেশি কিনছে। ফলে অধিকাংশ ব্যবসায়ীরই দোকানের খরচ উঠাতেই গায়ের ঘাম ঝরছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে করোনা বিস্তারের শুরু থেকেই শাকসবজিসহ সব ধরনের খাদ্যপণ্যের দাম লাগামহীন। একদিকে চাল-ডাল-চিনির পর তেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী, অন্যদিকে বিদু্যৎ ও পানির দাম বেড়েছে। স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকলেও সন্তানদের অনলাইন ক্লাস-কোচিংয়ের জন্য স্মার্টফোন-ট্যাব-ল্যাপটপ কেনা এবং ইন্টারনেট বিলের বাড়তি খরচ যোগ হয়েছে। স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ও যাতায়াত বাবদ আগের চেয়ে অনেক বেশি টাকা খরচ করতে হচ্ছে। ফলে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে।

সরকারি-বেসরকারি সংস্থার একাধিক জরিপ ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মতামতের ভিত্তিতে দেখা গেছে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও সংসারের আনুষঙ্গিক খরচ বৃদ্ধির কারণে মহামারিকালীন সময় প্রতিটি পরিবারের মাসিক খরচ নূ্যনতম ৫ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। অথচ চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী ও পেশাজীবী বেশিরভাগ মানুষের আয়ই ২০ থেকে ২৫ শতাংশ কমেছে। এছাড়াও করোনার কারণে শহরাঞ্চলের বিপুলসংখ্যক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। গত কয়েক মাসে সঞ্চয় ভেঙে খাওয়া শেষে অনেকে এখন ধার-দেনা করে চলছেন।

এ অবস্থায় সংসার সামাল দিতে গিয়ে বেশিরভাগ মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ আগের বাসা ছেড়ে দিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে অল্প ভাড়ায় নিম্নমানের বাসায় গিয়ে উঠেছেন। বিদু্যতের বিলের বোঝা কমাতে কেউ কেউ বাসার এসি, গিজার ও ওয়াশিং মেশিনসহ বিভিন্ন বৈদু্যতিক সরঞ্জাম বিক্রি করে দিয়েছেন। ছোট বাসা নেওয়ায় অনেকে জরুরি আসবাবপত্রও বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। কেউ কেউ এরই মধ্যে সন্তানের গৃহশিক্ষক ও অনলাইন কোচিং কমিয়ে দিয়েছেন। আর্থিক অবস্থার বিবেচনায় মধ্যম আয়ের কিছুসংখ্যক মানুষ প্রাইভেট কার বিক্রি করে ফেলছেন। চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ীদের অনেকে আগে ট্যাক্সিক্যাব কিংবা অটোরিকশায় কর্মস্থলে যাতায়াত করলেও এখন গণপরিবহণে চড়ছেন।

অন্যদিকে বাড়তি খরচের চাপে হিমশিম খাওয়া সাধারণ মানুষ পোশাক-পরিচ্ছদ কেনাকাটা, ওষুধ খরচ ও চিকিৎসার ক্ষেত্রেও নানা হিসাব-নিকাশ কষছেন। ছোট-খাটো নমুনা পরীক্ষার জন্য যারা এক সময় বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ছুটতেন, তারা অনেকে এখন খরচ কমাতে সরকারি হাসপাতালে ছুটছেন।

মধ্যবিত্ত অনেক পরিবারই আগে দু'একমাস অন্তর বিভিন্ন বিনোদনকেন্দ্র কিংবা আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া এবং বাইরে নামি-দামি রেস্টুরেন্টে খাওয়া-দাওয়ার জন্য আলাদা অর্থ বরাদ্দ রাখলেও বেশিরভাগই এখন সে বাজেটে কাঁচি চালিয়েছেন।

অন্যদিকে বাড়তি খরচের চাপ সামলাতে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনেক মানুষ এখন আয়েশি জীবন-যাপন বাদ দিয়ে সামান্য কিছু অতিরিক্ত টাকা উপার্জনে 'পার্টটাইম জব' খুঁজে নিয়েছেন। কেউ কেউ অফিস শেষে ছোট-খাটো ব্যবসা করার চেষ্টা করছেন। অনেকে আবার অনলাইনে বিভিন্ন পণ্য বিক্রির সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। বাসা-বাড়ির ছাদ-ব্যালকনিসহ বিভিন্ন ফাঁকা জায়গায় ছোট-খাটো মুরগির খামার ও মাশরুম চাষে যোগ দেওয়া মানুষের সংখ্যাও গত কয়েক মাসে বেশ খানিকটা বেড়েছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এসব উদ্যোগে সাময়িকভাবে কিছুটা চাপ সামলানো গেলেও সার্বিক পরিস্থিতির উন্নয়ন অনেকটাই অসম্ভব। কেননা জিনিসপত্রের দাম কমার তেমন কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। বরং তা আরও বাড়তে পারে। আর বিদু্যতের দাম বাড়ার কারণে তার প্রভাব সরাসরি নিত্যপণ্যের দামের ওপর পড়বে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ঢাকা শহরের তিন রুমের একটি ফ্ল্যাটে আগে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা বিল দিতে হতো। চলতি বছরের মার্চ মাস থেকে বিদু্যতের বিল বাড়ার কারণে তা এখন তিন হাজারে এসে ঠেকেছে। এছাড়া জুলাই মাস থেকে ওয়াসার পানির দাম বাড়ায় ফ্ল্যাট বা বাসাপ্রতি ভাড়াটিয়াদের দ্বিগুণ-ত্রিগুণ বিল দিতে হচ্ছে। যা আগে ছিল সর্বোচ্চ কয়েকশ' টাকা। এদিকে বিদু্যতের দাম বাড়ার নেতিবাচক প্রভাব কেবল বাসাবাড়িতে নয়, কৃষি ও শিল্পপণ্যের উৎপাদন খরচেও পড়েছে। যার ফল ঘুরেফিরে সাধারণ মানুষকেই ভোগ করতে হচ্ছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে বাংলাদেশ যে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে, করোনা মহামারি আরও দীর্ঘমেয়াদি হলে তা ম্স্নান হয়ে যেতে পারে। এমনকি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান তলানিতে এসে ঠেকার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। সংকটময় এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারকে আগেভাগেই সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের পতন ঠেকিয়ে গত ১০ বছরের টানা সাফল্য ধরে রাখতে দারিদ্র্য দূরীকরণে গতানুগতিক ধারার সঙ্গে নতুন সমাধান দরকার। বিশেষ করে শহরাঞ্চলের দিকে এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। কেননা বর্তমান প্রবণতায় ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের অর্ধেকেরও বেশি দরিদ্রদের বসবাস শহরাঞ্চলে হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অথচ গত এক দশকে গ্রামীণ এলাকায় ৯০ ভাগ দারিদ্র্যতা দূরীকরণ করতে পারলেও শহরাঞ্চলে এর পরিমাণ খুবই কম। শহরাঞ্চলে অতি দারিদ্র্যের হার এক রকমই রয়ে গেছে। যা দারিদ্র্যতা দূরীকরণে জাতীয় উন্নয়নকে মন্থর করে দিয়েছে।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ এ প্রসঙ্গে যায়যায়দিনকে বলেন, জিনিসপত্রের দাম বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনযাত্রার মান কমবে। তিনি মনে করেন, চাল ও ভোজ্যতেলের সিন্ডিকেট কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে এর দাম বাড়াচ্ছে। গোয়েন্দাদের এ দিকে নজর দিতে হবে। কৃষকের ঘরে দীর্ঘদিন ধান-চাল মজুত রাখার সুযোগ নেই দাবি করে তিনি বলেন, এটি চাল সিন্ডিকেটের কারসাজি। সরকারকে এদের ব্যাপারে সতর্ক থাকা জরুরি। অন্যদিকে গ্যাস-বিদু্যৎ ও পানির দাম বিষয়ে প্রবীণ এ অর্থনীতিবিদ বলেন, এসব খাতে ব্যাপক লুটপাট হচ্ছে। যা পুষিয়ে নিতে সাধারণ মানুষের উপর বাড়তি বিলের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<113718 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1