করোনাভাইরাস

শনাক্তের হারে শুভঙ্করের ফাঁকি

প্রকাশ | ১৮ অক্টোবর ২০২০, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
শারীরিক দূরত্ব বজায় না রাখায় বাড়ছে করোনা সংক্রমণ -ফাইল ছবি
দেশে গত দুই মাসে করোনার সংক্রমণ ধাপে ধাপে কমে আসার তথ্য পাওয়া গেলেও বাস্তব চিত্র অনেকটাই ভিন্ন। বরং এ পরিসংখ্যানে বড় ধরনের শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জুলাইয়ের চতুর্থ সপ্তাহ থেকে বিমানযাত্রীদের করোনা টেস্ট করানো বাধ্যতামূলক হওয়ায় প্রবাসী কর্মীসহ হাজার হাজার বিদেশগামী সুস্থ মানুষ শুধু নেগেটিভ সনদ সংগ্রহের জন্য নমুনা পরীক্ষা করাচ্ছেন, যা প্রতিদিনের নমুনা পরীক্ষার মোট সংখ্যার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। তাই টেস্টের সংখ্যা অনুযায়ী শনাক্তের হার কম দেখাচ্ছে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (সিএএবি) সূত্রে জানা গেছে, গত সেপ্টেম্বর মাসে প্রবাসী কর্মী, শিক্ষার্থী ও পর্যটকসহ প্রায় দেড় লাখ মানুষ বিদেশে গেছেন। যাদের প্রত্যেককেই করোনা টেস্ট করাতে হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ৩১ আগস্ট পর্যন্ত দেশে ১৫ লাখ ৫০ হাজার ২০৩ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। যা ৩০ সেপ্টেম্বরে বেড়ে দাঁড়ায় ১৯ লাখ ৪৭ হাজার ৬৫৫ জনে। অর্থাৎ সেপ্টেম্বর মাসের ৩০ দিনে মোট ৩ লাখ ৯৭ হাজার ৪৫২ জনের করোনা টেস্ট করা হয়েছে। এদিকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ১২ হাজার ৯৯৬ জন, যা ৩০ সেপ্টেম্বরে বেড়ে দাঁড়ায় ৩ লাখ ৬৩ হাজার ৪৭৯ জনে। অর্থাৎ সেপ্টেম্বর মাসে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৫০ হাজার ৪৮৩ জন। এ হিসেবে সেপ্টেম্বর মাসে গড় শনাক্তের হার ১২.৭০ শতাংশ। তবে শুধু সনদ সংগ্রহের জন্য নমুনা পরীক্ষা করানো দেড় লাখ বিদেশগামী সুস্থ বিমানযাত্রীর হিসাব বাদ দেওয়া হলে করোনার উপসর্গ নিয়ে টেস্ট করানো মানুষের সংখ্যা দাঁড়াবে ২ লাখ ৪৭ হাজার ৪৫২ জন। এদের ওপর ভিত্তি করে করোনায় শনাক্তের হার নির্ণয় করা হলে তা ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। এ প্রসঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা মোজাহারুল হক যায়যায়দিনকে বলেন, 'এখন যে সংখ্যক টেস্ট হচ্ছে, সেটা সামগ্রিকভাবে দেশের রিপ্রেজেন্টেটিভ স্যাম্পল টেস্টিং না। এখন একটা বিপুলসংখ্যক বিদেশ যাত্রী আছেন, যাদের আসলেই করোনা নেই, তারা সুস্থ। শুধু বিমানযাত্রার বাধ্যতামূলক করোনা নেগেটিভ সংগ্রহের জন্য তারা নমুনা পরীক্ষা করাচ্ছেন। সুতরাং শনাক্তের যে হারটি আমরা ইদানীং দেখছি ১০ থেকে ১২ শতাংশের মধ্যে স্থিতিশীল বা সীমাবদ্ধ আছে, এটা সঠিকভাবে দেশের রিপ্রেজেন্টেটিভ হার না। এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, জুলাই মাস থেকে কমে করোনার শনাক্তের হার এখন ১০ থেকে ১২ শতাংশের মধ্যে স্থিতিশীল অবস্থায় আছে। তার মানে যথেষ্ট সংক্রমণ বাংলাদেশে বিদ্যমান। বর্তমান করোনা পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। আর এ সংক্রমণ কমানোর জন্য সরকারের কৌশল নির্ধারণ করে সেটা বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। যাতে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসে। সরকারকে চেষ্টা করতে হবে জনগণকে সম্পৃক্ত করে সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা। পাশাপাশি সরকারের টেস্টের আওতা বাড়াতে হবে এবং শিগগিরইর্ যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট দেশব্যাপী শুরু করতে হবে এবং জরিপ চালাতে হবে। যাতে সরকার এবং জনগণ জানতে পারে বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতি কেমন। একই সঙ্গে নিজের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য জনগণকে যেমন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে, তেমনি রাষ্ট্রকেও স্বাস্থ্যবিধি মানতে ব্যক্তি ও সংস্থাগুলোকে আইন প্রয়োগের মাধ্যমে বাধ্য করতে হবে বলে মনে করেন তিনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলোজি বিভাগের একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, শনাক্তের হার কম বলেই করোনা সংক্রমণ কমতে শুরু করেছে, এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। নমুনা পরীক্ষা কমেছে, তাই শনাক্ত কমছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের করোনার প্যাটার্ন মিলছে না উলেস্নখ করে এ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আরও বলেন, সংক্রমণের হার কমছে কিনা তা নিশ্চিত হতে হলে আরও টেস্ট বাড়াতে হবে। এতে কী ধরনের ফল আসে তার ওপর নির্ভর করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে সবার ইনফেকশন হয়ে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে, সেজন্য সংক্রমণ কমে যাচ্ছে, এটা ঠিক নয়। মাস্ক পরা, হাত ধোয়া, সামাজিক দূরত্বের মতো স্বাস্থ্যবিধিও আমরা মেনে চলছি না, তাই প্রকৃত অবস্থা বুঝতে আরও সময় লাগবে। এদিকে দেশে নমুনা পরীক্ষা কম হওয়ার কারণ হিসেবে দেশের সাধারণ মানুষ বেশকিছু পরীক্ষাগার বন্ধ থাকা, টেস্ট ফি নির্ধারণ এবং পরীক্ষা করাতে ও ফলাফল পেতে ভোগান্তির কারণ মুখ্য বলে উলেস্নখ করলেও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা কেউ কেউ বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের ধারণা, কৌশলগত কারণেই হয়তো স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নমুনা পরীক্ষা একটি নির্দিষ্ট গন্ডিতে সীমাবদ্ধ রেখেছে। তা না হলে আরটিপিসিআর মেশিনের পাশাপাশি অনুমোদন পাওয়া সত্ত্বেওর্ যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট কেন ব্যাপক হারে শুরু হচ্ছে-এমন প্রশ্ন তোলেন তারা। রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরামর্শক ও রোগতত্ত্ববিদ ডা. মুশতাক হোসেন যায়যায়দিনকে বলেন, রোগী শনাক্তের হার বর্তমানে কিছুটা কম। কিন্তু সংক্রমণ কম, এটা বলা যাবে না। এ ভাইরাস আপনা-আপনি চলে যাবে না বা সংক্রমণ কমবে না। কখনো হয়তো নানা কারণে সংক্রমণের হার কমতে পারে, কিন্তু যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে শনাক্তের হার পাঁচের নিচে নামতে সময় লাগবে। এদিকে সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী গত ২৩ জুলাই থেকে বিদেশগামী যাত্রীদের জন্য যে ১৬টি সরকারি হাসপাতাল ও প্রতিষ্ঠানে কোভিড পরীক্ষা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে তার কয়েকটিতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানে দেড় থেকে দুই শতাংশের পজিটিভ রেজাল্ট আসছে; বাকি সবারই নেগেটিভ। তবে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টার, ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথ ও ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব প্রিভেন্টিভ অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিন-রাজধানী ঢাকার এই তিন প্রতিষ্ঠানেও শনাক্তের হার সামান্য কিছুটা বেশি। লন্ডনপ্রবাসী শিক্ষার্থী মুনতাসির মামুন জানান, লন্ডনে ফিরে যাওয়ার জন্য গত সোমবার তিনি স্যাম্পল (নমুনা) দিয়েছেন। সময়মতো তিনি নেগেটিভ সনদও পেয়েছেন। ওই দিন যারা সনদ সংগ্রহের জন্য এসেছিলেন, তাদের কারও পজিটিভ রেজাল্ট এসেছে তা তিনি শোনেননি। মামুনের ভাষ্য, বিদেশ ভ্রমণ কিংবা কর্মস্থলে যোগ দিতে যাওয়ার আগে কারও করোনা উপসর্গ দেখা দিলে তার নমুনা পরীক্ষা করার কথা না। এ ধরনের উপসর্গ থাকলে স্বাভাবিকভাবেই তিনি ক'দিন দেরি করেই টেস্ট করাবেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই বিদেশগামী যাত্রীদের নমুনা পরীক্ষায় ৯৮ থেকে ৯৯ শতাংশই নেগেটিভ রেজাল্ট আসছে।