শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এবার বইয়ের মান রক্ষায় কঠোর পাঠ্যপুস্তক বোর্ড

নূর মোহাম্মদ
  ২১ অক্টোবর ২০২০, ০০:০০

বিনামূল্যে দেওয়া পাঠ্যবইয়ের মান নিশ্চিত করতে কঠোর অবস্থানে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। বই ছাপার আগে তিন স্তর এবং পরে এক স্তর মোট চার স্তরের তদারকি করছে পরিদর্শন এজেন্সি। শুধু তাই নয়, গভীর রাতে নিম্নমানের বই ছাপানো ঠেকাতে এবার প্রত্যেক প্রেসে ২৪ ঘণ্টার মনিটরিং কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কাগজের 'বাস্টিং ফ্যাক্টর' (স্থায়িত্ব), জিএসএম (উজ্জ্বলতা) কম থাকায় এরই মধ্যে ১ হাজার টনের বেশি কাগজ ও আর্টপেপার বাতিল হয়েছে। পরিদর্শন এজেন্সির কড়াকড়িতে অনেক মুদ্রণকারী প্রেস থেকে নিম্নমানের কাগজ সরিয়ে ফেলেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলেন, মুজিববর্ষে বইয়ের মানে যেন কোনো হেরফের না হয় এমন কঠোর নির্দেশনা রয়েছে।

এনসিটিবি চেয়ারম্যান প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র সাহা যায়যায়দিনকে বলেন, তদারকি প্রতিষ্ঠানকে বইয়ের মান ইসু্যতে 'কোনো ছাড় নয়' বলে স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছি। তাদের ওপর কোনো চাপ এলে এনসিটিবিকে জানাতে বলেছি। পরিদর্শন টিম এবার বেশ তৎপর। তাই মান রক্ষায় যা যা দরকার সব ধরনের সহযোগিতা তাদের দেওয়া হবে।

এদিকে মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবইয়ের প্রচ্ছদের দ্বিতীয় ও তৃতীয় পৃষ্ঠায় এবার মুজিববর্ষ, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন এবং সরকারের নানা উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের স্থিরচিত্র ক্যাপশনসহ রঙিন করে ছাপানো হবে। সেজন্য বেশকিছু ছবি বাছাই করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। সেটা মুদ্রণের জন্য আলাদা খরচের ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে বলে জানিয়েছে

এনসিটিবির চেয়ারম্যান।

জানা গেছে, চার স্তরের তদারকির প্রথম স্তরে কাগজের মান দেখা হয়। এ জন্য পরিদর্শন এজেন্সি 'ইনডিপেনডেন্ট ইনপেকশন সার্ভিসেস বিডি' প্রেস থেকে কাগজের তিন কপি নমুনা সংগ্রহ করে এক কপি প্রিন্টার্স, এক কপি এনসিটিবি এবং অন্য কপি ল্যাবে পরীক্ষা করে। কাগজের মান ভালো হলে ছাড়পত্র, না হলে তা বাতিল করে প্রেস থেকে সেই কাগজ সরিয়ে ফেলা হয়। কাগজের ছাড়পত্রের পর বই ছাপা পর্যন্ত প্রতিটি রুল তদারকি করতে একজন ২৪ ঘণ্টা ওই প্রেসে অবস্থান করছে। ছাপার পর ডেলিভারি পর্যন্ত তা নজরে থাকে। এখানেই শেষ নয়, বই উপজেলা পৌঁছানোর পর সেখানে নমুনা বই সংগ্রহ করা হবে এবং আগের বইয়ের সঙ্গে মান মিলানো হবে। এভাবেই কঠোর তদারকি চলছে এবারের পাঠ্যবইয়ের। এসব স্তরে আগে নানা কারসাজি হতো। পরিদর্শন টিম ও মুদ্রণকারীদের যৌথ কারসাজিতে নিম্নমানের বই ছাপানো হতো এবং তা সরবরাহ করা হতো।

এবার 'ইনডিপেনডেন্ট ইনপেকশন সার্ভিসেস বিডি' ৫২টি প্রেসে সার্বক্ষণিক মনিটরিং করতে আলাদা ৫২ জন দক্ষ কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছে। যাদের কাজ হবে প্রেসে নিম্নমানের কাগজ-আর্টপেপার যাতে না ঢুকাতে পারে সেটা নিশ্চিত করা, ছাপা হওয়ার পর বইয়ের মান চেক করে ডেলিভারির অনুমতি দেওয়া। এরপর উপজেলা বই পৌঁছানোর সেখান থেকে স্যাম্পল নিয়ে তা আবার পরীক্ষা করা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, আগে কোনো প্রতিষ্ঠানই প্রেসে সার্বক্ষণিক লোক রাখার কাজটি করেনি। এতে ছাড়পত্র পাওয়া কাগজ বদলে গভীর রাতে নিম্নমানের কাগজ দিয়ে বই ছাপানো হতো। সেটা ঠেকাতে ইনডিপেনডেন্ট এ পদক্ষেপ নিয়েছে।

এনসিটিবির তথ্যমতে, ৬ থেকে ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত মাধ্যমিক স্তরে ৭৬০ টন কাগজ বাতিল হয়েছে। এর মধ্যে লেটার অ্যান্ড কালার প্রিন্টার্সের ৩০০টন, মোলস্না প্রিন্টার্সের ১৮০ টন, বর্ণ ও শোভা প্রিন্টার্সের ১২৬ টন রয়েছে। বড় মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো কাগজ পরিদর্শনের আবেদন করলে সেটি আরও বেড়ে যেতে পারে। তবে এজেন্সির কড়াকড়ির বার্তা পাওয়ার পর বড় মুদ্রণকারীরা প্রেস থেকে নিম্নমানের কাগজ সরিয়ে ফেলেছে। এদিকে শিড মেশিনের জন্য এনসিটিবির কেনা ১৩ হাজার মেট্রিক টন কাগজের মধ্যে রোববার মেঘনা পেপার মিলের ৩০০ টন এবং বসুন্ধরার ২০০ টন আর্টপেপার বাতিল করা হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় ২৫ কোটি বই ছাপার কাজের তদারকি প্রতিষ্ঠান প্রথম ১৫ দিনে ২০টি প্রেসের প্রায় ১ হাজার টন নিম্নমানের কাগজ বাতিল করেছে।

সূত্রমতে, কাগজ বাতিল করায় কোনো কোনো মুদ্রণ ব্যবসায়ী হুমকি-ধমকির মতো কাজও করেছেন। গত সপ্তাহে নোয়াখালীতে অবস্থিত একটি প্রেসে নিম্নমানের কাগজ বাতিল করায় পরিদর্শন এজেন্সিকে হুমকির ঘটনা ঘটে। এ বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃক জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে ওই প্রেসে নজরদারি বাড়ানো ও পরিদর্শক টিমকে নিরাপত্তা দেওয়ার নির্দেশের পর তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

এনসিটিবির তথ্যমতে, বইয়ের মান ঠিক রাখতে চলতি বছর 'বাস্টিং ফ্যাক্টর' (বইয়ের স্থায়িত্ব) ১৪ থেকে ১৬ জিএসএম, ৮৫ শতাংশ (উজ্জ্বলতা), তদারকি পদ্ধতিসহ বেশকিছু নীতিতে পরিবর্তন এসেছে। ফলে চলতি বছর নিম্নমানের কোনো কাগজে বই ছাপার সুযোগ নেই বলে মনে করেন কর্মকর্তারা।

জানা গেছে, কাগজের 'বাস্টিং ফ্যাক্টর' (স্থায়িত্ব) ১৪ হওয়ার কারণে বছরের মাঝামাঝি সময় বইয়ের পাতা বেঁকে এবং লাল হয়ে যায়। এনসিটিবির এক কর্মকর্তা বাস্টিং ফ্যাক্টর ১৪ থেকে ১৬ করার প্রস্তাব দেন। সেটি আমলে নিয়ে একদিনের একটি প্রশিক্ষণ করা হয়। সেখানে মুদ্রণ ব্যবসায়ী, শিক্ষা ও প্রাথমিক মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ শিল্প ও বিজ্ঞান গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে বাস্টিং ফ্যাক্টর ১৬ করা হয়।

মুদ্রণ ব্যবসায়ীরা বলেন, গত বছর কাগজের দাম ছিল টনপ্রতি ৯০-৯৫ হাজার টাকা। করোনার কারণে তা প্রায় অর্ধেক কমে ৪৫ হাজার টাকা হয়েছিল; কিন্তু গত মাস থেকে হঠাৎ করে তা বেড়ে গেছে। পেপার মিলগুলো প্রতি টন কাগজ ৬০ হাজার টাকার কমে দিচ্ছে না। গত বছর খোলা বাজার থেকে কেনা কাগজ ছাড়পত্র পেলেও এবার একই মানের কাগজ গণহারে বাতিল হচ্ছে। এর প্রধান কারণ বাস্টিং ফ্যাক্টর ১৬। তবে এনসিটিবির কর্মকর্তারা বলেন, টনপ্রতি ১০-১২ হাজার বাঁচাতে গিয়ে মুদ্রণকারীরা নিম্নমানের কাগজ কিনছেন। গত বছর নানা ফাঁকফোকর দিয়ে ছাড়পত্র নিলেও এবার পরিদর্শন এজেন্সি তা আটকে দিচ্ছে। 'বাস্টিং ফ্যাক্টর' ১৬, ৮০ শতাংশ জিএসএম (পুরুত্ব) এবং ৮৫ শতাংশ উজ্জ্বলতার ব্যাপারে কোনো ছাড় দেবে না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে এনসিটিবি।

চলতি বছর প্রাথমিকে ১০ কোটি ২৫ লাখ ৫৩৪ এবং মাধ্যমিক স্তরে ২৪ কোটি ৩৩ লাখ ৩৪ হাজার কপি বই ছাপা হবে। এর মধ্যে প্রাথমিক ৯৮টি লট আর মাধ্যমিকে ২১০, ৭৫ এবং ১৭৫ লটের ভাগ করে কাজ দেওয়া হয়েছে। মাধ্যমিকে ৫৬টি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান কাজ পেয়েছে। তার মধ্যে ১০টি বড় প্রতিষ্ঠান মোট কাজের সিংহভাগ করবে। গত ৬ অক্টোবর মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে কাজ করার আনুষ্ঠানিক পত্র দেওয়া হয়েছে। এরপর বই ছাপার জন্য তারা প্রাথমিকে নিয়মিত ৯৮ দিন ও মাধ্যমিকে ৬০ দিন সময় পাবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<115961 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1