ডিএনএ ফাঁদে ধর্ষণ মামলার তদন্তে দীর্ঘসূত্রতার শঙ্কা

প্রকাশ | ২৪ অক্টোবর ২০২০, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
সারাদেশে ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড (ডিএনএ) টেস্ট ল্যাব মাত্র দুটি। এর প্রত্যেকটিতে ধর্ষণ, খুনসহ বিভিন্ন অপরাধের ঘটনায় সংগৃহীত আলামতের পাহাড় জমে আছে। সময়মতো এগুলোর রিপোর্ট দিতেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিয়মিত হিমশিম খাচ্ছে। সম্প্রতি আইন সংশোধন করে ধর্ষণের শিকার ভুক্তভোগী ও অভিযুক্ত উভয়ের ডিএনএ টেস্ট বাধ্যতামূলক করা হলেও নতুন করে ল্যাব বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ এখনো নেওয়া হয়নি। ফলে আইন সংশোধনের মূল লক্ষ্য কতটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে তা নিয়ে সংশ্লিষ্টরা গভীর দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। পুলিশ, আইনজীবী ও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করা মানবাধিকার সংগঠনগুলোর শীর্ষ কর্তাদের আশঙ্কা ডিএনএ টেস্টের ফাঁদে পড়ে ধর্ষণ মামলার তদন্তে দীর্ঘসূত্রতার সৃষ্টি হবে। এতে এসব ঘটনার বিচার স্বাভাবিকভাবেই অনেকটা পিছিয়ে যাবে। আইনজ্ঞদের পরামর্শ, ধর্ষণের শিকার নারী-শিশু ও ধর্ষক উভয়ের ডিএনএ টেস্ট বাধ্যতামূলক করার আগে দেশের প্রতিটি জেলায় ডিএনএ টেস্টের জন্য ল্যাবরেটরি স্থাপন করা প্রয়োজন ছিল। দ্রম্নততম সময়ে সেটি সম্ভব না হলেও প্রাথমিক পর্যায়ে অন্তত প্রতিটি বিভাগীয় শহরে একটি করে ল্যাব স্থাপন করা জরুরি বলে মনে করেন তারা। উচ্চ আদালতের একাধিক আইনজীবী বলেন, ধর্ষণের অপরাধে শুধু মৃতু্যদন্ডের শাস্তি থাকলেই হবে না, আইনের কঠোর প্রয়োগ থাকতে হবে। এসব অপরাধের বিচার কাজ দ্রম্নত সম্পন্ন করে সাজা কার্যকর করা জরুরি। তাদের ভাষ্য, দ্রম্নত বিচার মানুষের মৌলিক সাংবিধানিক অধিকার; কিন্তু পদ্ধতিগত কিছু ত্রম্নটির কারণে দ্রম্নত বিচার করা যাচ্ছে না। তার ওপর ধর্ষণের শিকার ভুক্তভোগী ও অভিযুক্ত উভয়ের ডিএনএ টেস্ট বাধ্যতামূলক করা হলে মামলার তদন্ত কার্যক্রম পেছানোর ফলে মূল লক্ষ্য ব্যাহত হবে। বিশেষজ্ঞমহল জানায়, ধর্ষণ মামলায় ডিএনএ টেস্ট অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হলেও এ টেস্টের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও সিআইডি সদর দপ্তরে মাত্র ২টি ল্যাবরেটরি রয়েছে। ল্যাব দুটিতে ধর্ষণ ছাড়াও হত্যা, খুন, পিতৃত্ব নির্ণয় ও অজ্ঞাত লাশের পরিচয় নির্ধারণসহ আরও বিভিন্ন মামলার বিপুলসংখ্যক ডিএনএ টেস্ট করা হয়। এর সঙ্গে প্রতিদিন ঘটে যাওয়া ধর্ষণের ডিএনএ \হটেস্টের জন্য অপেক্ষা করতে হলে স্বাভাবিকভাবে দীর্ঘসূত্রতার ফাঁদ তৈরি হবে। তারা যুক্তি তুলে ধরে বলেন, ২০১৮ সালের ২৭ মে ধর্ষণের শিকার নারীদের ডিএনএ টেস্ট বাধ্যতামূলক এবং ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ডিএনএসহ অন্যান্য নমুনা সংগ্রহ করে তা ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানোর নির্দেশনা দেন হাইকোর্ট। যেকোনো রিপোর্ট সংগ্রহ বা স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তদন্তকারী সংস্থার যেকোনো ব্যর্থতা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য করতে বলা হয়। রাজধানীতে এক গারো তরুণী ধর্ষণের ঘটনায় হাইকোর্টে রুলের শুনানি শেষে আদালত এ রায় দেন। রায়ের আরেক অংশে এ মামলায় হাইকোর্টের রায়ের সুপারিশ, পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনার আলোকে নীতিমালা তৈরি করতে আইন বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়, নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ মহাপরিদর্শককে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বলা হয়। এরপর দুই বছরেরও বেশি সময় পার হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধর্ষণের শিকার নারীর ডিএনএ টেস্ট যথাসময়ে করানো সম্ভব হয়নি। কোনো কোনো ধর্ষিতার ডিএনএ পরীক্ষার রিপোর্ট এক বছরেও পাওয়া যায়নি এমন নজিরও রয়েছে। অথচ সম্প্রতি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন অধ্যাদেশ সংশোধন করে মামলা শুরু থেকে বিচার শেষ করার জন্য ৬ মাস বা ১৮০ দিন সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। ডিএনএ টেস্ট রিপোর্ট পেতে ছয় থেকে ৯ মাস, এমনকি এরচেয়েও বেশি সময় লাগার বিষয়টি তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারাও স্বীকার করেছেন। পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা এ প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, লক্ষ্ণীপুরের এক নারী ধর্ষণের শিকার হয়ে সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়েন। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী ওই নারী লক্ষ্ণীপুর জজ আদালতে মামলা করেন। আদালত বিষয়টি তদন্তের জন্য পুলিশকে নির্দেশ দেন। এরই মধ্যে ওই নারী তার গর্ভজাত সন্তানের জন্ম দেন। পরে আদালত ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে পুলিশকে শিশুটির পিতৃত্ব নিশ্চিতের জন্য প্রতিবেদন দিতে বলেন। তবে ওই শিশুর বয়স চার বছর পেরুলেও ন্যাশনাল ফরেনসিক ল্যাব থেকে ডিএনএ রিপোর্ট না পাওয়ায় আদালতের কাছ থেকে বারবার সময় নিয়েও যথারীতি মামলায় অভিযোগপত্র দিতে তদন্তকারী কর্মকর্তা ব্যর্থ হন। বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (বস্নাস্ট) গবেষণা বিশেষজ্ঞ তাকবির হুদা যায়যায়দিনকে বলেন, 'ল্যাব ঘাটতির কারণে মামলা আটকে যাওয়ার নিশ্চিত সম্ভাবনা আছে। কারণ ডিএনএ ও ফরেনসিক এভিডেন্স খুবই টাইম সেন্সেটিভ। ধর্ষণের ঘটনার পর দেশের দূর-দূরান্ত থেকে এ এভিডেন্স ঢাকায় পৌঁছাতে স্বাভাবিকভাবেই বিলম্ব হয়। এছাড়া এতদিন আইনে ডিএনএ বাধ্যতামূলক না হওয়ায় কোন ঘটনায় টেস্ট করা হবে কিংবা হবে না সে সিদ্ধান্ত নিতেও দেরি হতো। তবে এখন আইনে ডিএনএ টেস্ট যেহেতু বাধ্যতামূলক হয়েছে, সেহেতু এখন তা কতটা প্রয়োগ হবে তার ওপর নির্ভর করছে এর মূল লক্ষ্য কতটা পূরণ হবে।' তিনি আদালতের সংখ্যার পাশাপাশি ডিএনএ ল্যাবের সংখ্যা বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে বলেন, 'তা না হলে আইন শুধু নথিপত্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে। এজন্য তিনি আইন প্রয়োগ করার জন্য রি-সোর্স বাড়ানোর ওপরও জোর দেন।' ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক, অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক যায়যায়দিনকে বলেন, 'শুধু পদক্ষেপ নিলেই হবে না। তার বাস্তবায়ন এবং সম্ভাবনা কতটুকু আছে সে বিষয়টিও আমাদের চিন্তা করতে হবে। ধর্ষণ-নির্যাতনের যে ঘটনাটির ভিডিও আছে সেটি অন্যভাবে প্রমাণের কিছু নেই। তবে ভিডিওটি এডিটিং করা কি না প্রযুক্তিবিদরা সেটা দেখবেন। ইন্সট্যান্ট এভিডেন্স দেখে যদি অপরাধী চিহ্নিত করা যায়, সেক্ষেত্রে এত টেস্টের প্রয়োজনীয়তা কম। তবে যে ক্ষেত্রে অপরাধ সন্দেহাতিতভাবে প্রমাণিত না হয়, সেক্ষেত্রে ডিএনএ টেস্ট অবশ্যই প্রয়োজন।' তিনি আরও বলেন, 'আমাদের নারী ও শিশু নির্যাতন যে ট্রাইবু্যনাল আছে, সেই ট্রাইবু্যনালের আন্ডারে বিভাগীয় প্রতিটি শহরে না হলেও অন্তত ঢাকায় তিনটি ল্যাব থাকবে, যেটি সরাসরি নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইবু্যনালের অধীনে পরিচালিত হবে। ডিএনএ ল্যাবগুলো তাদের মতোই কাজ করবে, তবে নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইবু্যনালের ইউনিট আছে এগুলো দেখভাল করবে।' বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলী যায়যায়দিনকে বলেন, 'আমাদের দেশে শুধু ডিএনএ ল্যাবই কম নয়, এক্সপার্টিজও কম। তাই শুধু আইন প্রণয়ন করলেই হবে না, আইন ইমপিস্নমেন্ট করার জন্য যেসব তথ্য-উপাত্ত, যেসব মেডিকেল এভিডেন্সসহ অন্য বিষয়গুলোর জন্য যে রকম এক্সপার্ট লাগবে, তেমনি তাদের ইন্ডিপেন্ডেন্ট মনিটর করার জন্যও ব্যবস্থা থাকতে হবে। যাতে ডিএনএ টেস্টের সঠিক রিপোর্ট সময়মতো পাওয়া যায়। এছাড়া ল্যাব থেকে ভুল রিপোর্ট দেওয়া হলে তা যাতে চ্যালেঞ্জ করা যায় তার ব্যবস্থাও করতে হবে।'