যেকোনো উপায়ে কর্মস্থলে ফিরতে মরিয়া প্রবাসীরা

প্রকাশ | ২৫ অক্টোবর ২০২০, ০০:০০

রেজা মাহমুদ
দেশে সম্পদ বলতে যা ছিল তার সিংহভাগই বিক্রি করে ২০১৬ সালে কুয়েত চলে যান পটুয়াখালী সদর থানার আজাদ হাওলাদার। জানুয়ারিতে একমাত্র বোনের বিয়ে উপলক্ষে ২ মাস ২০ দিনের ছুটিতে দেশে ফিরেছেন তিনি; কিন্তু করোনার কারণে কুয়েত প্রবেশে নিষেধাজ্ঞায় আর যাওয়া হয়নি। দীর্ঘ ৮ মাস কর্মহীন থাকায় কুয়েতে উপার্জিত অর্থের কানাকড়িও তার অবশিষ্ট নেই। আয়ের বিকল্প উৎস না থাকায় খেয়ে না খেয়ে দিনযাপন করছেন আজাদের পরিবারের সদস্যরা। একই অবস্থা বরিশালের সৌদি প্রবাসী আবদুল হাই, দুবাই প্রবাসী ফয়েজ মোলস্না ও কাতার প্রবাসী আবদুল হকের। দেশে আটকেপড়া এসব প্রবাসী ফেরত যেতে না পারায় ক্রমেই সমাজ ও পরিবারের কাছে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছেন। অথচ ছয় মাস আগেও তাদের গুরুত্ব ও মর্যাদার কমতি ছিল না। উপার্জন না থাকায় এখন নিজেদের পরিবারের বোঝা মনে করছেন এসব প্রবাসী। আর তাই যেকোনো মূল্যে আবার প্রবাসে ফিরতে মরিয়া তারা। হোক সেটা বৈধ কিংবা অবৈধ উপায়ে। এদিকে ঢাকা থেকে সরাসরি কুয়েত প্রবেশের অনুমতি না থাকলেও বিকল্প পথে ওই দেশে যাওয়ার প্রস্তাব পেয়েছেন আজাদ হাওলাদর। প্রায় ৪ লাখ টাকার বিনিময়ে এ সন্ধান দিয়েছে একটি ট্রাভেল এজেন্সি। কিন্তু এত অর্থের জোগান কীভাবে দেবেন আজাদ? হয়তো অর্থাভাবে তিনি কুয়েত যেতে পারবেন না; কিন্তু ট্রাভেল এজেন্সির নামে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা একশ্রেণির দালাল চক্রের জন্য অর্থ আয়ের যেন এটাই সুযোগ। করোনাকালে বিভিন্ন দেশ থেকে এসে আটকেপড়া প্রবাসীদের টার্গেট করে ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে এসব চক্র। প্রবাসী কল্যাণ ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্রের তথ্য মতে, প্রায় ২৫ হাজার প্রবাসীর কুয়েতে প্রবেশের বৈধতা বা আকামার মেয়াদ শেষ হয়েছে। সৌদি আরবের ভিসা কিংবা আকামার মেয়াদ শেষ হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার প্রবাসীরও। ইতোমধ্যে অনেক প্রবাসী সৌদি আরব ফেরত যাওয়ার সুযোগ পেলেও বড় একটা অংশ যেতে পারছে না। এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যেসব প্রবাসী সে দেশের নিয়োগকর্তা বা কফিলের মাধ্যমে আকামার মেয়াদ বাড়াতে পারছেন না তারাই মূলত এসব দালাল চক্রের দ্বারস্থ হচ্ছেন। সৌদি আরব প্রবাসী আবদুল হাই জানান, তিনি আকামা বৃদ্ধির জন্য দূতাবাসে অনেক ঘোরাঘুরি করেছেন; কিন্তু তারা (দূতাবাস) কফিলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলে। এদিকে কফিল আকামার মেয়াদ বাড়াতে ইচ্ছুক নয়। তখন কোনো উপায় না পেয়ে তিনি ট্রাভেল এজেন্সির দ্বারস্থ হন। তারা (ট্রাভেল এজেন্সি) কফিলের সঙ্গে যোগাযোগ করলে ভিসা বা আকামার মেয়াদ বাড়াবে বলে রাজি হয় কফিল। কিন্তু এর জন্য ১ লাখ টাকার বিশেষ প্যাকেজ দাবি করে ওই ট্রাভেল এজেন্সি। আর তাতে সম্মতও হয়েছেন আবদুল হাই। তিনি বলেন, স্ত্রীর কিছু সোনার গহনা ছাড়া তার কাছে মূল্যবান আর কিছুই নেই। এখন তা বিক্রি করেই তিনি এই এজেন্সিকে টাকা দেবেন। যদিও তিনি ব্যাংক ঋণের জন্য অনেক চেষ্টা করেছেন; কিন্তু কোনোভাবেই ঋণের ব্যবস্থা করতে পারেননি। আবদুল হাইসহ বেশ কয়েকজন সৌদি প্রবাসী যায়যায়দিনকে বলেন, এসব এজেন্সির মাধ্যমে যারা সৌদি গিয়েছেন তাদের নিয়োগকর্তাদের সঙ্গে এজেন্সিগুলোর বাণিজ্যিক সম্পর্ক থাকায় তারা (কফিল) ইচ্ছা করেই ভিসার মেয়াদ বাড়াচ্ছে না। কিন্তু এজেন্সিগুলোতে টাকা দিলেই এসব কফিল ভিসার মেয়াদ বাড়িয়ে দিচ্ছে। করোনায় আটকেপড়া এসব প্রবাসীকে ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ায় ট্রাভেল এজেন্সি ও নিয়োগকর্তরা মিলে অনৈতিক অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে বলে প্রবাসীরা অভিযোগ করেন। এদিকে গত ১ আগস্ট থেকে সীমিত পরিসরে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালুর সিদ্ধান্ত নেয় কুয়েত। তবে প্রবেশ নিষিদ্ধ ৩৪ দেশ ছাড়া অন্য যেকোনো দেশে গিয়ে ১৪ দিন অবস্থানের পর কুয়েতে প্রবেশের সুযোগ রয়েছে। তৃতীয় দেশ হয়ে প্রবাসীদের কুয়েত ফেরার এ সুযোগই নিচ্ছে ট্রাভেল এজেন্সিগুলো। এক্ষেত্রে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভ্রমণ ভিসার সুযোগ নিচ্ছেন ট্রাভেল এজেন্সিগুলো। তাদের মাধ্যমে দুবাই গিয়ে ১৪ দিন পর পিসিআর সনদ নিয়ে কুয়েতে প্রবেশ করছেন প্রবাসীরা। তবে এজন্য কুয়েত প্রবাসী বাংলাদেশিদের খরচ হচ্ছে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা। মূলত কোনো উপায় না থাকায় এক প্রকার বাধ্য হয়েই ট্রাভেল এজেন্সিতে চুক্তি করে ঝুঁকি নিয়ে প্রবাসীরা কুয়েতে প্রবেশ করছেন। জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি (বায়রা) মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান জনান, একান্ত বাধ্য হয়েই অতিরিক্ত টাকা দিয়ে বিভিন্ন এজেন্সির মাধ্যমে এ পদ্ধতিতে প্রবাসীরা কুয়েতে যাচ্ছেন। এক্ষত্রে আটকেপড়া প্রবাসীদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে অনেকেই অতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন। এদিকে তৃতীয় কোনো দেশ হয়ে কুয়েত যেতে খরচ প্রায় তিন গুণ। এছাড়া ভুয়া ট্রাভেল এজেন্সি কিংবা বিভিন্ন কারণে প্রবাসীদের দুবাই থেকেই আবার দেশে ফিরে আসতে হতে পারে। তাই কেউ যদি একান্তই বাধ্য না হয় বা দেশে থাকার কোনো সুযোগ থাকে সে ক্ষেত্রে এসব প্রবাসীকে ধৈর্য ধরার পরামর্শ দেন বায়রার মহাসচিব। প্রবাসীদের ফেরা নিয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে বলেও তিনি জানান। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমেদ বলেন, বিদেশ থেকে ছুটিতে দেশে আসা কর্মীদের অনেকেই কোভিড-১৯ মহামারির কারণে সময়মতো গন্তব্য দেশের কর্মস্থলে ফেরত যেতে পারেননি। ইতোমধ্যে অনেক কর্মীর ভিসা/আকামা/ওয়ার্ক পারমিটের মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়ের মাধ্যমে বিদেশ প্রত্যাগমনেচ্ছু কর্মীদের ভিসা/আকামার মেয়াদ বৃদ্ধি এবং ফ্লাইটের সংখ্যা বাড়াতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এছাড়া ভবিষ্যতে এসব বিষয়ে কার্যকর কূটনৈতিক প্রচেষ্টাসহ বিদেশফেরত ও আটকেপড়া কর্মীদের সহযোগিতার লক্ষ্যে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এ ধরনের সব কর্মীর নিবন্ধনের উদ্যোগ নিয়েছে। প্রসঙ্গত, করোনা মহামারিতে বিশ্বের নানা দেশ থেকে বাংলাদেশে এসে আটকা পড়েছেন প্রবাসী কর্মীরা। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের তথ্য অনুযায়ী, গত ১ এপ্রিল থেকে ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থেকে ১ লাখ ৯৫ হাজার ৬৯৮ জন প্রবাসীকর্মী দেশে ফিরেছেন। তাদের মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে সবচেয়ে বেশি কর্মী দেশে ফিরেছেন, নারী ও পুরুষ মিলিয়ে ৫২ হাজার ৫৬৫ জন।