আবহাওয়ার ব্যাকরণ না মেনে হানা দিচ্ছে বৃষ্টি

প্রকাশ | ২৬ অক্টোবর ২০২০, ০০:০০

আলতাব হোসেন
বৃষ্টিতে ভোগান্তি -ফাইল ছবি
কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের শস্য উৎপাদন পঞ্জিকা বৃষ্টির সঙ্গে সম্পৃক্ত। বর্ষার নতুন পানিতে আমন ও আউশ রোপণ করেন কৃষক। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে বজ্রপাত শুরু হলে মাছ, ব্যাঙ ও সরীসৃপ প্রাণীদের প্রজনন শুরু হয়। পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদীগুলোতে মা-মাছ গিয়ে ডিম পাড়ে। এ সময় পাট জাগ দিতেও প্রয়োজন হয় পানির। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বদলে যাচ্ছে ঋতুচক্র। সময়ে দেখা না মিললেও অসময়ে বৃষ্টির বাড়াবাড়ি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে দেশের মানুষ। শীতও তার প্রচলিত নির্দিষ্ট সময় মানছে না। আবার বন্যাও ব্যাকরণ ভুলে হানা দিচ্ছে অসময়ে। এর প্রভাব পড়ছে কৃষি ও জনজীবনে। এবার কার্তিকের বৃষ্টি যেন আষাঢ়-শ্রাবণের বৃষ্টিকেও হার মানিয়েছে। এবারের বৃষ্টি ১০০ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে। রংপুরে মাত্র ১৪ ঘণ্টায় ৪৩৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। অথচ প্রতি বছর সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর পর্যন্ত গড়ে সারাদেশে ২২৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। বৃষ্টিপাত শুধু বাংলাদেশই নয়, বৃষ্টির এ বৈরী আচরণ বিশ্বজুড়েই। আবহাওয়ার দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসেও অক্টোবর মাসে দেশে স্বাভাবিক অপেক্ষা কিছুটা বেশি বৃষ্টি হওয়ার কথা বলা হয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য মতে, আষাঢ়-শ্রাবণের সেই মুষলধারার বৃষ্টি এখন আর নেই। বর্ষাকালে বৃষ্টির পরিমাণও কমে গেছে। এতটাই কমেছে যে, সেটি স্বাভাবিকের চায়েও গড়ে প্রায় ২৫ ভাগ কম। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউট বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেছে। প্রতিষ্ঠানটির গবেষকরা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অসময়ে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির বাড়াবাড়ির ফলে দেশে খাদ্য উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, নতুন নতুন দুর্যোগ বাড়ছে ও রোগবালাইয়ের প্রকোপ দেখা দিচ্ছে। ষড়ঋতুর এ দেশে কার্তিক ও অগ্রহায়ণ হেমন্ত ঋতু। হেমন্ত মানেই শিশিরস্নাত প্রহর। অক্টোবরের শেষেও দেশের বিভিন্ন এলাকায় শ্রাবণের মতোই বৃষ্টি ঝরছে। বৃষ্টিপাতের এ আচরণ স্বাভাবিক নয় বলে বলছেন তারা। এ বিষয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত যায়যায়দিনকে বলেন, বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা ও জাতিসংঘের আন্তঃসরকার জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত প্যানেল (আইপিসিসি) বলছে, শিল্পোন্নত দেশগুলোর বিপুল কার্বন নিঃসরণের ফলে বৈরী হয়ে উঠছে আবহাওয়া। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের নির্মমতার শিকার বাংলাদেশ। জলবায়ুর প্রভাবে দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে। সে সঙ্গে দিনের পর দিন বাড়ছে আবহাওয়ার খামখেয়ালি আচরণ। অসময়ে বৃষ্টির মাত্রা বেড়ে যাওয়ার মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের স্পষ্ট ইঙ্গিত আছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক সামছুদ্দিন আহমেদ যায়যায়দিনকে বলেন, অধিদপ্তরের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আবহাওয়ার বৈরী আচরণে বৃষ্টিপাতের ধরন পাল্টে গেছে। এতে দেখা যায়, প্রতি বছর বৃষ্টিপাত টেকনাফে ৩৬ শতাংশ, কক্সবাজারে ২২ এবং পটুয়াখালী ও বরগুনায় ১৫ ও ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। অন্যদিকে ভোলা ও খুলনা-বাগেরহাট এবং সাতক্ষীরায় বৃষ্টিপাত ২০ শতাংশ করে কমে যাচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, গত ৩০ বছরে দেশের চট্টগ্রাম বিভাগে বৃষ্টিপাত অব্যাহতভাবে বাড়ছে। বিশেষ করে সেখানে বর্ষাকালে বৃষ্টিপাত স্বাভাবিকের চেয়ে ১০ শতাংশ বেড়েছে। অতিবৃষ্টির কারণে পার্বত্য এলাকায় পাহাড়ধস হচ্ছে। অন্যদিকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় লবণাক্ততা বাড়ছে। এতে ফসল উৎপাদন বিপর্যস্ত হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. আবদুল মুঈদ যায়যায়দিনকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে 'এল-নিনোর' শিকার দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো। এসব দেশে কোনো কোনো বছর কৃষি মৌসুমে তীব্র খরা হচ্ছে। আবার কোনো বছর অতিবৃষ্টি বা ঘনঘন বন্যা হচ্ছে। আবহাওয়ার এ বৈরী আচরণের প্রভাব কৃষির ওপর সরাসরি পড়ছে। দেশের বরেন্দ্র অঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির সংকটও বাড়ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে বর্তমান কৃষি ব্যবস্থায়ও বিপর্যয় নেমে আসবে বলে আশঙ্কা করছেন কৃষকরা। বিশিষ্ট আবহাওয়াবিদ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ড. আহসান আহমেদ যায়যায়দিনকে বলেন, জলবায়ুর প্রভাবে বৃষ্টিপাতের ধরন পাল্টে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছেন কৃষক। হেমন্তের এই বৃষ্টি অস্বাভাবিক এবং কৃষির জন্য ক্ষতিকর। ২০১৭ সালে মার্চের শেষদিকে অতিবৃষ্টিতে উজান থেকে নেমে আসা ঢলে হাওরের ধান তলিয়ে যায়। ওই বছর ব্রহ্মপুত্র নদের উজানে ১০০ বছরের রেকর্ড ভেঙে বেশি বৃষ্টি হয়। ২০১৮ সালের অক্টোবরেও ব্যাপক বৃষ্টি হয়। ওই বছর পাহাড়ে ৪০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত হয়। ২০১৯ সালের জুনে আবহাওয়া অধিদপ্তরের প্রত্যাশার চেয়ে বৃষ্টি হয়েছে ৩৪ দশমিক চার ভাগ কম। অথচ চলতি বছর অক্টোবরে (মধ্য আশ্বিন-কার্তিক) ৪৬ দশমিক এক ভাগ বেশি বৃষ্টি হয়েছে দেশে।