বিজয়া দশমী আজ বাজছে বিদায়ের করুণ সুর

প্রকাশ | ২৬ অক্টোবর ২০২০, ০০:০০

মন্টি বৈষ্ণব
শারদীয় দুর্গাপূজার বিজয়া দশমী আজ। দেবীর দশমী বিহিত পূজা সমাপন ও ঘট বিসর্জন করে শান্তির জল গ্রহণ করে শেষ হবে দুর্গাপূজা। মা দুর্গা তাঁর চার সন্তান লক্ষ্ণী, সরস্বতী, কার্তিক ও গণেশকে নিয়ে পাঁচদিন ভক্তদের মাঝে কাটালেন, পূজা নিলেন। আজ দুর্গতিনাশিনী দুর্গা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে মর্ত্য ছেড়ে কৈলাসে স্বামীগৃহে ফিরে যাবেন। পঞ্জিকামতে, দেবীপক্ষের পাঁচদিন পর মায়ের অকালবোধন। কিন্তু এ বছর আশ্বিন মাসে দুটি অমাবস্যা পড়ায় এটি 'মলমাস'। শাস্ত্রমতে, মলমাসে শুভকর্ম নিষিদ্ধ। তাই গত ১৭ সেপ্টেম্বর মহালয়ার পাঁচদিন পর নয়, পঁয়ত্রিশ দিন পর মা এলেন পিত্রালয়ে। গত ২২ অক্টোবর মহাষষ্ঠীর মাধ্যমে শুরু হয় পাঁচদিনের দুর্গা পূজার আনুষ্ঠানিকতা। প্রতিবারের মতো মহাষষ্ঠী, মহাসপ্তমী, মহাঅষ্টমী ও মহানবমীতে হিন্দু সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষ ধর্মীয় নানা আচার-অনুষ্ঠান পালন করেছে। শাস্ত্র মতে বোধনে 'অরুণ আলোর অঞ্জলি নিয়ে আনন্দময়ী মা উমাদেবীর আগমন ঘটে। টানা পাঁচদিন মৃন্ময়ীরূপে মন্ডপে মন্ডপে থেকে ফিরে যান কৈলাসে।' জগতের মঙ্গল কামনায় দেবী দুর্গা এবার মর্ত্যলোকে (পৃথিবী) আসেন দোলায় আর ফিরে যাবেন গজে। করোনা মহামারির কারণে এ বছর বিজয়ার শোভাযাত্রা হবে না। মন্দিরগুলো তাদের নিজ নিজ ব্যবস্থাপনায় প্রতিমা বিসর্জনের ব্যবস্থা করবে। আজ বিজয়া দশমীর সকাল থেকেই বাজবে বিদায়ের সুর। সারাদেশের পূজামন্ডপগুলোতে থাকবে বিষাদের ছায়া। মন্ডপে মন্ডপে শেষ বারের মতো শোনা যাবে ঢাক-কাঁসরের বাদ্যি-বাজনা আর শঙ্খধ্বনি। টানা মন্ত্রপাঠ। উলুধ্বনি আর অঞ্জলি। মায়ের আশীর্বাদ নিতে শেষবারের মতো মন্দিরে মন্দিরে ভিড় করবেন ভক্তরা। পূজার পর মায়ের পায়ে সিঁদুর ছুঁয়ে দেবেন। এরপর সিঁদুর খেলে মাকে বিদায় জানাবেন ভক্তরা। অশুভ শক্তি নাশ করতে কৈলাস ছেড়ে মর্ত্যলোকে এসেছিলেন দেবী দুর্গা। তাঁর এক রূপ অসুরবিনাশী, আরেক রূপ মাতৃময়ী ভালোবাসার। শক্তি ও মমতার এই দুই শক্তির গুণেই তিনি দেবকুলের কাছে পরম পূজনীয় হিসেবে গণ্য হন। মানবকুলের জন্য তিনি বহন করে আনেন মঙ্গলবার্তা। দিন শেষে হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে পরস্পরের প্রতি আনন্দ হচ্ছে বিজয়ার আনন্দ। গতকাল সারাদেশের পূজা মন্ডপে মহানবমী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। স্বাস্থ্যবিধির নিয়ম মেনে বৃষ্টি উপেক্ষা করে মহানবমীতে বিভিন্ন মন্দির ও মন্ডপে ছিল ভক্ত ও দর্শনার্থীর ভিড়। নবমী পূজা শেষে চোখের জলে ভক্তরা দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গার পায়ে অঞ্জলি দিয়েছেন। ঢাকেশ্বরী মন্দিরে নৈবেদ্য ধূপ, ফুল, পান দিয়ে শুরু হয় মহানবমীর পূজা। শাস্ত্র মতে, নবমী তিথিতে রাবণ বধের পর শ্রী রামচন্দ্র এই পূজা করেছিলেন। নীলকণ্ঠ ফুল, যজ্ঞের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয় নবমী বিহিত পূজা। মহানবমীতেও আগের দিনের মতো রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের পূজামন্ডপগুলোতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের উপস্থিতি দেখা গেছে। দুর্গাপূজা মূলত শক্তির আরাধনা। সৃষ্টির আদি কারণকে মাতৃরূপে বন্দনা করে মায়ের কাছে শক্তি প্রার্থনাই এই পূজার আসল লক্ষ্য। অশুভ শক্তির বিনাশের মধ্য দিয়ে শুভ ও ন্যায়ের বিজয় দুর্গাপূজার প্রতিপাদ্য। পুরাণ মতে, দুর্গা দুর্গতিনাশিনী, তিনি জীবের দুর্গতি নাশ করেন। দেবী দুর্গা অসুরদের দলপতি মহিষাসুরকে বধ করে দেবকুলকে রক্ষা করেছিলেন। তাঁর এই জয় অন্যায় ও অশুভর বিরুদ্ধে ন্যায় ও শুভশক্তির জয় হয়েছিল। অসুররূপী অশুভ শক্তি আমাদের ভেতরেও আছে। তাই অশুভ শক্তির বিনাশ করতে চাইলে সবার আগে আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে নিজেকেও শুদ্ধ হতে হবে। অপরের মঙ্গল কামনায় নিজেকে নিয়োজিত করতে হবে। হিংসা-বিদ্বেষ করলে সব সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন অটুট থাকার প্রত্যয় নিয়ে সফল করতে হবে শারদীয় দুর্গাপূজাকে। কেবল বাংলাদেশ বা ভারতের নয়, সারা পৃথিবীর বাঙালি হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা এই উৎসবকে তাদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব মনে করেন। তবে দুর্গাপূজা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উৎসব হলেও সব ধর্মের মানুষ এর আনন্দ ভাগ করে নেয়। শত শত বছর ধরে বাঙালি হিন্দু-মুসলমান যেমন পাশাপাশি বসবাস করে আসছে, তেমনি তারা একে অপরের ধর্মীয় উৎসবে যোগ দিয়ে সেই সামাজিক সম্প্রীতির বন্ধন আরও অটুট করেছে। এটাই বাঙালির ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে মঙ্গল বয়ে আসুক। এ বছর সারা দেশে মোট ৩০ হাজার ২১৩টি এবং রাজধানীতে ২৩২টি মন্ডপে পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। গত বছর বাংলাদেশে ৩১ হাজার ৩৯৮টি মন্ডপে দুর্গাপূজা হয়েছিল। পুরো পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ আজ করোনায় আক্রান্ত। করোনা ইতিমধ্যেই পৃথিবী থেকে সাড়ে ১১ লাখ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। আক্রান্ত হয়েছে প্রায় সোয়া ৪ কোটি মানুষ। এই মৃতু্যর মিছিল কোথায় গিয়ে শেষ হবে তা কেউ জানে না। তাই ভক্তরা এবার সর্বগ্রাসী করোনা থেকে মানব জাতিকে রক্ষা করতে মা দুর্গার পূজা করে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা উপলক্ষে আজ সরকারি ছুটির দিন। দিনটি উপলক্ষে বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশনের পাশাপাশি বেসরকারি টিভি চ্যানেল ও রেডিও বিশেষ অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচার করবে। তাছাড়া জাতীয় দৈনিকগুলোতেও থাকবে বিশেষ নিবন্ধ। বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারা হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি বিজয়া দশমীর শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।