বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য

ভুয়া এনআইডিতে অন্যের জমি রেজিস্ট্রেশন করে ব্যাংক ঋণ

দোহার-উত্তরা নির্বাচন কমিশন থেকে ভুয়া এনআইডি ষ প্রতি এনআইডি তৈরিতে নেওয়া হয়েছে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা ষ প্রাইম ও ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংকের মামলা, গ্রেপ্তার ৬

প্রকাশ | ২৭ অক্টোবর ২০২০, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন ও তানভীর হাসান
জাল এনআইডি কার্ড তৈরি করে অন্যের জমি রেজিস্ট্রেশন করে তা দুইটি ব্যাংকে বন্ধক রেখে কোটি টাকা এবং বেশ কয়েকটি ক্রেডিট কার্ড হাতিয়ে নিয়েছে সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্র। এ ব্যাপারে ডাচ বাংলা ও প্রাইম ব্যাংকের রুজুকৃত মামলার সূত্র ধরে জালিয়াত চক্রের ৬ সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর ভুয়া এনআইডি কার্ড ও জাল জমি রেজিস্ট্রেশনকারী চক্রের চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। মামলার তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) জানায়, মামলার তদন্তে নেমে তারা জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের একটি সংঘবদ্ধ জালিয়াত চক্রের সন্ধান পেয়েছে। এ চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে মোটা অঙ্কের উৎকোচের বিনিময়ে একই নামে একাধিক পরিচয়পত্র তৈরি করে বিভিন্ন জালিয়াত চক্রকে সহায়তা করে আসছে। এক একটি ভুয়া এনআইডি তৈরি করতে তারা তিন থেকে চার লাখ টাকা নিচ্ছে বলে গোয়েন্দারা নিশ্চিত হয়েছে। একই সঙ্গে ভুয়া কাগজপত্রে জমি রেজিস্ট্রেশন করিয়ে দেওয়ার সঙ্গে জড়িত একটি সংঘবদ্ধ জালিয়াত চক্রকেও গোয়েন্দারা চিহ্নিত করেছে। তবে এ দুই চক্রের কাউকে এখনো তারা গ্রেপ্তার করতে পারেনি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাইদুল ইসলাম জানান, এনআইডি জালিয়াতির ঘটনায় দুইজনকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। তারা ডাটা এন্ট্রি অপারেটর হিসেবে কর্মরত। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, শুধু জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে জমি রেজিস্ট্রি ও ব্যাংক লোন নেওয়া সম্ভব না। এর সঙ্গে সব বিভাগেরই কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জড়িত। ডিএমপির নিউমার্কেট থানায় ডাচবাংলা ব্যাংকের দায়েরকৃত মামলার এজাহার অনুযায়ী, জালিয়াত চক্রের মূল হোতা আব্দুল আলীম নিজেকে রাজধানীর নিউ এলিফেন্ট রোডের মাল্টিপস্নান সেন্টারের কটন জোন নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক বলে দাবি করে ব্যাংকে সিসি লোনের আবেদন করেন। এ সময় রাজধানীর গুলশানের কাঠালদিয়া মৌজার ৫০ শতাংশ জমি বন্ধক রাখা হয়। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আব্দুল আলীমের ব্যবসার কাগজপত্র, তার মালিকানা দাবিকৃত জমির প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যাচাই ও মূল্য নির্ধারণের জন্য নর্দান ইন্সপেকশন কো. লিমিটেডকে দায়িত্ব দেয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এসব কাগজপত্র সঠিক আছে মর্মে প্রতিবেদন দেওয়ার পর ব্যাংক আব্দুল আলীমকে ৬০ লাখ টাকা ঋণ প্রদান করে। যা ২০১৯ সালের ২০ জানুয়ারি দুইটি চেকের মাধ্যমে তিনি ব্যাংক থেকে তুলে নেন। এর কয়েকদিন পর ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে আব্দুল আলীম ও তার ঘনিষ্ঠ লোকজন হিসেবে পরিচিত সবার মোবাইল ফোনই বন্ধ পাওয়া যায়। আব্দুল আলীমের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও তালাবদ্ধ পাওয়া যায়। এ পর্যায়ে খোঁজ-খবর নিয়ে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানতে পারে আব্দুল আলীম সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের মূল হোতা। জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আত্মসাতের উদ্দেশ্যে তিনি আব্দুল আলীম নামে ভুয়া এনআইডি কার্ড তৈরি করেছেন। যা দিয়ে তিনি জনৈক আব্দুল আলীমের জমি রেজিস্ট্রেশন করে ব্যাংকে মর্টগেজ রেখেছেন। এ প্রতারকের প্রকৃত নাম শিহাব উদ্দিন। এনআইডি কার্ডে তার পিতা-মাতার নাম ও যে ঠিকানা দেওয়া হয়েছে তা-ও ভুয়া। এমনকি ব্যাংকের গ্যারান্টার হিসেবে যাদের এনআইডি জমা দেওয়া হয়েছে তাও ভুয়া। এদিকে বনানী থানায় দায়েরকৃত প্রাইম ব্যাংকের এজাহারে দেখা গেছে, একই ধরনের জালিয়াতির মাধ্যমে আব্দুল আলীম নামধারী শিহাব উদ্দিন ৫০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। সেখানেও ব্যবসায়ী হিসেবে মাল্টিপস্ন্যান সেন্টারের কটন জোন প্রতিষ্ঠানটি দেখানো হয়েছে। এমনকি মর্টগেজ হিসেবে প্রতারক চক্র ডাচবাংলা ব্যাংকে জমা দেওয়া একই জমির কাগজ দেখিয়েছে। এখানে ব্যাংকের গ্যারান্টার হিসেবে আলাদা একজনের নাম ব্যবহার করা হলেও তার জমা দেওয়া এনআইডিটিও ভুয়া। এ দুইটি মামলা গোয়েন্দা সংস্থা ডিবির কাছে হস্তান্তরের পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তদন্তে নেমে প্রতারক চক্রের সদস্য আব্দুল আলীম ওরফে শিহাব উদ্দিন, আব্দুল লতিফ ওরফে রুবেল, আব্দুস সামাদ ওরফে রাসেল, আবুল কালাম আজাদ, মো. শামীর হোসেন তালুকদার ও আবুল কাশেম ওরফে রাজুকে গ্রেপ্তার করে। পরে তাদের আদালতে পাঠানো হলে তারা ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। তারা স্বীকার করেন, তারা একই ব্যক্তির ভিন্ন ভিন্ন নামে একাধিক জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে, যা জাতীয় নির্বাচন কমিশনের সার্ভারে দৃশ্যমান ছিল। এটি দেখে ব্যাংক তাদের বিশ্বাস করে। আসামিরা আরও জানান, জনৈক জহির নামের এক ব্যক্তির সহযোগিতায় তারা এসব ভুয়া এনআইডি কার্ড তৈরি করেছিলেন। প্রতিটি কার্ড তৈরির জন্য তাদের তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা দিতে হয়েছে। তবে তদন্ত চলাকালীন সময়ের আগে জহির মারা যাওয়ায় আসামিদের দাবিকৃত তথ্য সঠিক কিনা তা জানতে পারেননি গোয়েন্দারা। এ অবস্থায় গোয়েন্দা পুলিশ জাতীয় নির্বাচন কমিশনের পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগকে ওই জালিয়াত চক্রকে দ্রম্নত চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেয়। একই সঙ্গে এ ধরনের ঘটনা যাতে ভবিষ্যতে আর না ঘটে এ ব্যাপারে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন। গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান জোনের এডিসি মো. জুনায়েদ আলম সরকার যায়যায়দিনকে বলেন, নির্বাচন কমিশনের পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগকে চিঠি দেওয়ার পর তারা সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেনি। তারা পাল্টা চিঠিতে বিভিন্নভাবে দায় এড়ানোর চেষ্টা করেছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃত আবুল কালাম আজাদ জানান, জহিরের মাধ্যমেই তিনি ভুয়া এনআইডি কার্ড সংগ্রহ করেছিলেন। তিনি তার সঙ্গে একাধিকবার জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের উত্তরা ও দোহার শাখায় গিয়েছেন। সেখানে জহিরকে তিনি সংশ্লিষ্ট শাখার আইটি এনালিস্টদের সঙ্গে কথা বলতে দেখেছেন। তারাই মূলত জাতীয় পরিচয়পত্রের সার্ভারে ভুয়া এনআইডি নিবন্ধন করে দেন, যা অনলাইন সার্ভারে দৃশ্যমান দেখা যায়। ফলে ব্যাংক কর্মকর্তারা তাদের ভুয়া এনআইডি কার্ডের বিষয়টি ধরতে পারেনি। এছাড়া জমি রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। এদিকে তেজগাঁও ভূমি রেজিস্ট্রেশন কার্যালয়ের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানায়, জাল এনআইডি দিয়ে জমি রেজিস্ট্রেশন করার কাজে সেখানেও একটি শক্তিশালী জালিয়াত চক্র রয়েছে। কেননা শুধু ভুয়া এনআইডি কার্ড দিয়ে ভূমি রেজিস্ট্রেশন ততটা সহজ নয়। ভূমি রেজিস্ট্রেশনে জমির দলিলের বাইরেও মাঠ পর্চা, খাজনা রসিদ ও বালাম বইসহ আরও অনেক বিষয়াদি সংশ্লিষ্ট রয়েছে। এ কারণে এ ধরনের জমি রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে মোটা অঙ্কের উৎকোচ দিতে হয়। গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান জোনের ডিসি মশিউর রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, প্রাপ্তবয়স্কদের এনআইডি কার্ড থাকার পরও কিছু লোকজন শুধু অসৎ উদ্দেশ্যে দ্বিতীয় আইডি কার্ড বানাচ্ছেন। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন নির্বাচন কমিশনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারী। এনআইডি জাতীয় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হওয়ায় নির্বাচন কমিশনের উচিত ওই অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শনাক্ত করে আইনের হাতে সোপর্দ করা। এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, এভাবে তৈরিকৃত জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে প্রতারণা, আদালত ও পুলিশকে বিভ্রান্ত করা, পাসপোর্ট ও ড্রাইভিং লাইসেন্স তৈরি ও পরিচয় গোপন করে বাসা ভাড়া নেওয়াসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। এছাড়া রাষ্ট্রবিরোধী জঙ্গিরা এ ধরনের জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করতে পারে। তাই এনআইডি কার্ড জালিয়াত চক্রকে দ্রম্নত চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চালানো হচ্ছে।