শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশে এইডসের নতুন আতঙ্ক রোহিঙ্গা

নূর মোহাম্মদ
  ০১ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:০০
আপডেট  : ০১ ডিসেম্বর ২০২০, ১০:২৫

আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে দেশকে এইডস রোগী মুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। সে লক্ষ্যে তারা কাজ করছিল। কিন্তু হঠাৎ নতুন আতঙ্ক তৈরি করেছে মিয়ানমার থেকে বাস্তুচু্যত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। তারা বাংলাদেশে আসার পর কক্সবাজার জেলায় চিহ্নিত এইডস রোগীর সংখ্যা বেড়েছে চারগুণেরও বেশি। ২০১৭ সালে পুরো জেলায় এইডস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল মাত্র ১৩২ জন, গত অক্টোবর পর্যন্ত সে সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৮১ জনে। যার মধ্যে ৪২৫ জনই রোহিঙ্গা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের বিভিন্ন জেলা, উপজেলা এমনকি বিভাগীয় শহরেও রোগের চিকিৎসা সেবা এখনো অপ্রতুল, সেখানে এইডস শনাক্ত হওয়া রোহিঙ্গাদের বিরাট সংখ্যক রোগীকে মোকাবিলার প্রস্তুতি কতটুকু রয়েছে? তাই কক্সবাজারে এইডস রোগীদের জন্য আলাদা ব্যবস্থাপনা করার দাবি সংশ্লিষ্টদের। কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ও সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে বসবাসরত শরণার্থীদের মধ্যে নতুন করে ৫২৪ জনের শরীরে এইচআইভি (এইডস) সংক্রমণ ধরা পড়েছে, আর যক্ষ্ণায় আক্রান্ত রোগী চিহ্নিত হয়েছে ৮ হাজার ৮২৫ জন। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা বিপর্যস্ত রোহিঙ্গা শরণার্থীরা এবার বাংলাদেশের জন্য গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। এই উদ্বেগ ভয়াবহ মরণব্যাধি এইডস আর যক্ষ্ণা রোগ নিয়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ও মিয়ানমার উভয়ই এইচআইভি ডেঞ্জার (অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ) জোন বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনেও জানানো হয়েছে। তবে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় কারণে এত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মধ্যেও বাংলাদেশ সবচেয়ে ক ঝুঁকির দেশের তালিকায় রয়েছে। আর ঝুঁকিপূর্ণ মিয়ানমার থেকে আসা নাগরিকদের মধ্যে একটি বিরাট সংখ্যক এরই মধ্যে এইডস শনাক্ত হয়েছে, যা মোকাবিলা করার মতো প্রস্তুতি দেশের নেই। সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে দেশ এইডসমুক্ত করার ঘোষণা ভেস্তে যাওয়ার পথে। তাই দেশব্যাপী বিশেষ করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো রোগ নির্মূলে আক্রান্তদের চিকিৎসার পাশাপাশি এইচআইভি টেস্টিং অ্যান্ড কাউন্সিলিং, পজেটিভ লিভিং কাউন্সিলিং, পুষ্টি ও নিরাপদ যৌন উপকরণ চিকিৎসাসহ নানা কর্মসূচির ওপর জোর দিতে হবে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে আরেকটি আতঙ্ক হলো প্রবাসীরা। প্রতি বছর ৫ লাখের বেশি মানুষ কাজের সন্ধানে বিদেশ গমন ছাড়াও ভ্রমণজনিত কারণে অসংখ্য দেশি-বিদেশি পর্যটক দেশে আসা-যাওয়া করে। তবে এই বিপুলসংখ্যক মানুষের মধ্যে কারও দেহে এইচআইভি জীবাণু রয়েছে কি না সেটি শনাক্তে তাৎক্ষণিক কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে আক্রান্ত অভিবাসী ও পর্যটকদের মাধ্যে রোগটি সহজে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা। এমন পরিপ্রেক্ষিতে জনসাধারণকে এইডস সম্পর্কে সচেতন করতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আজ মঙ্গলবার বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব এইডস দিবস-২০২০। বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে 'সারা বিশ্বের ঐক্য, এইডস প্রতিরোধে সবাই নিব দায়িত্ব'। বিশ্ব এইডস দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে আজ দুপুর সাড়ে ১২টায় রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমিতে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় আয়োজনে সেমিনার ও প্রদর্শনী। অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে বক্তব্য রাখবেন। জাতিসংঘের এসটিডি/এইডসবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ইউএন এইডসের গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বে প্রতিদিন সাড়ে ৫ হাজার মানুষ নতুন করে এইডসে আক্রান্ত হন। এর মধ্যে ৫০০ জনেরই বয়স ১৫ বছরের নিচে। আক্রান্ত ৩২ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে, যার ২০ ভাগই নারী। আক্রান্তদের ৬১ ভাগ সাব-সাহারা আফ্রিকান অঞ্চলে বসবাসকারী। প্রতিষ্ঠানটির তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে বিশ্বের মোট এইডস আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৩৭ দশমিক ৯ মিলিয়ন। এর মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক লোক ৩৬ দশমিক ২ মিলিয়ন। মোট আক্রান্তের ১৮ দশমিক ৮ মিলিয়ন নারী এবং ১ দশমিক ৭ মিলিয়ন শিশু। শুধু ২০১৮ সালে নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন ১ দশমিক ৭ মিলিয়ন, যার মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক ১ দশমিক ৬ মিলিয়ন। সময়ে এইডস আক্রান্ত হয়ে মৃতু্য হয়েছে ৭ লাখ ৯০ হাজার মানুষের। যার মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক ৬ লাখ ৭০ হাজার এবং শিশু ১ লাখ। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে বর্তমানে এইচআইভি/এইডস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় ১৩ হাজার। এসব রোগীর মধ্যে পর্যন্ত শনাক্ত হয়ে চিকিৎসার আওতায় এসেছে মাত্র ৬ হাজার ৬০৬ জন। এমনকি আন্তর্জাতিক সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন বলছে, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিকদেরকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা গেছে আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ দেশে এসে এইডসের সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। ফলে এখনই ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে এটি আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। তাছাড়া ২০১৬ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত শুধুমাত্র রাজধানীর সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে ১৯৬ জনকে এইচআইভি পজিটিভ শনাক্ত করা হয়েছে। ২০১৭ সালের ২ অক্টোবর থেকে ২০১৮ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ হাজার ৫২৬ জনের এইচআইভি পরীক্ষা করে ১৪৩ জনের পজিটিভ ধরা পরেছে। যাদের মধ্যে ১ হাজার ৩৪ জনের এআরভি দেওয়া হয়েছে। এইডস এসটিডির ডেপুটি প্রোগ্রা ম্যানেজার (স্বাস্থ্য অধিদপ্তর) ডা. ফুয়াদ আব্দুল হামিদ যায়যায়দিনকে বলেন, বর্তমান বাংলাদেশে এইডস রোগীর সংখ্যা বাড়ার কারণ রোহিঙ্গারা। গোষ্ঠীর মধ্যে যে পরিমাণ এইডস শনাক্ত বাড়ছে তা রীতিমতো উদ্বেগজনক। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে সচেতনার জন্য আরও প্রচারাভিযান দরকার। বিদেশফেরত কর্মীদের কীভাবে শনাক্ত ও এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যায় সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কোনো পরিষ্কার ধারণা ও যন্ত্রপাতি নেই। তাদের দেশে আসার পর দ্রম্নত সময়ের মধ্যে কীভাবে স্ক্রিনিংয়ের আওতায় আনা যায় সে ব্যাপারে কাজ করতে হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে