রায়ে 'আমৃতু্য' না থাকলে যাবজ্জীবন ৩০ বছর

যাবজ্জীবন মানে আসামিকে সর্বোচ্চ ৩০ বছর সাজা খাটতে হবে। তবে আদালত যদি আমৃতু্য সাজা দেন, তাহলে সেটাই গণ্য করতে হবে উলেস্নখ করে রিভিউ রায় দিয়েছে আপিল বিভাগ

প্রকাশ | ০২ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:০০ | আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:২৯

যাযাদি ডেস্ক

যাবজ্জীবনের প্রাথমিক অর্থ দন্ডিতের বাকি জীবন হলেও দন্ডবিধি ও ফৌজদারি কার্যবিধির আওতায় সাজা হয় ৩০ বছর। তবে আদালত নির্দিষ্ট করে 'আমৃতু্য কারাদন্ড' বলে দিলে আসামিকে বাকি জীবন জেলেই কাটাতে হবে বলে সিদ্ধান্ত দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত। 'যাবজ্জীবন কারাদন্ড মানে আমৃতু্য কারাবাস' আপিল বিভাগেরই এমন রায় 'অসামঞ্জস্যপূর্ণ' দাবি করে আসামিপক্ষ পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) যে আবেদন করেছিল, সে আবেদন নিষ্পত্তি করে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন সাত বিচারকের ভার্চুয়াল আপিল বেঞ্চ মঙ্গলবার এ রায় দিয়েছে। আবেদনটি সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নিষ্পত্তি করা হয়েছে জানিয়ে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন সংক্ষিপ্ত রায়ে বলেন, প্রাথমিক অর্থে যাবজ্জীবন কারাদন্ডের মানে হলো, দন্ডিত ব্যক্তি তার স্বাভাবিক জীবনের বাকি সময় কারাভোগ করবেন। দন্ডবিধির ৪৫ এবং ৫৩ ধারার সঙ্গে দন্ডবিধির ৫৫, ৫৭ ধারা এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৫(ক) মিলিয়ে পড়লে যাবজ্জীবনের সাজা কমে ৩০ বছর কারাদন্ডের সমতুল্য হয়। তবে আদালত, ট্রাইবু্যনাল অথবা ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনাল আইনে গঠিত ট্রাইবু্যনাল যখন কোনো আসামিকে আমৃতু্য কারাদন্ড দেয়, তিনি কার্যবিধির ৩৫(ক) ধারার (রেয়াতি) সুবিধা পাবেন না। রায় ঘোষণার সময় আসামিপক্ষে আদালতে যুক্ত ছিলেন আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন ও আইনজীবী শিশির মনির। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন। রায়ের পর অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, 'যাবজ্জীবন মানে আসামিকে সর্বোচ্চ ৩০ বছর সাজা খাটতে হবে। তবে আদালত যদি আমৃতু্য সাজা দেয়, তাহলে সেটাই গণ্য করতে হবে উলেস্নখ করে রিভিউ রায় দিয়েছে আপিল বিভাগ।' যাবজ্জীবনে ৩০ বছর- এ নিয়ম আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের মামলায় দন্ডিত আসামিদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না বলেও স্পষ্ট বলেন তিনি। আসামিপক্ষের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, যাবজ্জীবন মানে কতদিন, আসামিকে কতদিন সাজা ভোগ করতে হবে এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। আমরা সে ব্যাপারে রিভিউ পিটিশন করে বলেছিলাম, বর্তমান আইনের বিধান অনুযায়ী যাবজ্জীবনে ৩০ বছর হবে। কারণ ৩০ বছর যদি না হয়, তাহলে ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৫(ক)সহ অন্য আইনের বিধানগুলো এবং জেলকোড, সব বাতিল হয়ে যাবে। 'আজকের (মঙ্গলবার) রায়ে আপিল বিভাগ বলেছে, যাবজ্জীবন বলতে একজন মানুষের স্বাভাবিক জীবন যতদিন, ততদিন। কিন্তু আইন অনুযায়ী যাবজ্জীবন দন্ডপ্রাপ্ত একজন আসামির ৩০ বছরের সাজা ভোগ করতে হবে। যদি আদালত বা ট্রাইবু্যনাল বিশেষভাবে আদেশ দেন, তাহলে আমৃতু্য জেলখানায় থাকতে হবে।' এক প্রশ্নের জবাবে খন্দকার মাহবুব বলেন, 'রায়ে আমরা মোটামুটি সন্তুষ্ট। তবে আমৃতু্য সাজাটা মানবতাবিরোধী এবং আমৃতু্য সাজা যদি থাকে, তাহলে জেলাখানায় ওল্ডহোম করতে হবে। একটি মানুষ যখন অত্যন্ত বৃদ্ধ হয়ে যাবে, তখন তার চলাফেরার শক্তি থাকবে না। তখন তার সেবা- শুশ্রূষার বিষয়টিও আদালতকে বিবেচনা করতে হবে।' প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ গত বছর ১১ জুলাই শুনানি শেষে রিভিউ আবেদনটির রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রেখেছিল। রিভিউ শুনানিতে সর্বোচ্চ আদালত এ বিষয়ে পাঁচ অ্যামিচি কিউরি আইনজীবী রোকন উদ্দিন মাহমুদ, এএফ হাসান আরিফ, আবদুর রেজাক খান, মুনসুরুল হক চৌধুরী ও এএম আমিন উদ্দিনের বক্তব্য শোনেন। যাবজ্জীবন কারাদন্ড মানে আমৃতু্য কারাবাস জানিয়ে আপিল বিভাগ যে রায় দিয়েছিল, তা 'অসামঞ্জস্যপূর্ণ' দাবি করে ২০১৭ সালে এই রিভিউ আবেদন করে আসামিপক্ষ। তখন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছিলেন, এক হত্যা মামলার চূড়ান্ত বিচারে (ওই বছরের ফেব্রম্নয়ারিতে) দেওয়া ওই রায় আপিল বিভাগের আগের আরেকটি রায়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সেদিন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, ওই রায়ের কারণে আইনের ব্যাখ্যা নিয়ে 'অনিশ্চয়তার' সৃষ্টি হয়েছে। 'সঠিক বিবেচনায়' ওই রায় দেওয়া হয়নি। বিভ্রান্তি দূর করার জন্য পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করা হয়েছে। ২০০১ সালে সাভারের ব্যবসায়ী জামান হত্যা মামলায় দুই আসামির আপিল শুনানি শেষে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা নেতৃত্বাধীন চার বিচারকের আপিল বেঞ্চ ওই রায় দেয়। সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশিত হয় ২০১৭ সালের ২৪ এপ্রিল। সেখানে বলা হয়, দন্ডবিধির ৫৩ ধারা ও ৪৫ ধারায় যাবজ্জীবন কারাদন্ড হবে আমৃতু্য কারাবাস। এর ফলে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত সবাইকে আমৃতু্য কারাগারে থাকতে হবে। আপিল বিভাগের ওই রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন জমা দিয়ে সেদিন ওই সংবাদ সম্মেলনে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, প্রচলিত ফৌজদারি আইন ও কার্যবিধি অনুযায়ী যাবজ্জীবন কারাদন্ড অর্থ ৩০ বছর সাজা। এরপর আসামি রেয়াত পেলে ওই সাজার সময় আরও কমে যাবে। ফৌজদারি কারাবিধির ৩৫(ক) ধারা অনুযায়ী সাজার মেয়াদ থেকে বিচারিক সময়ের হাজতবাসের সময়ও বাদ যাবে। খন্দকার মাহবুব আরও বলেছিলেন, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার নেতৃত্বে আপিল বিভাগ ২০১৩ সালে এক রায়ে বলেছিলেন, যাবজ্জীবন কারাদন্ড অর্থ হলো সাড়ে ২২ বছর কারাদন্ড। আপিল বিভাগের ওই রায় ও আইন বলবৎ থাকা অবস্থায় বিচারপতি সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের অপর রায় আসে; সেখানে যাবজ্জীবন কারাদন্ড মানে 'আমৃতু্য কারাদন্ড' বলা হয়। জামান হত্যা মামলায় আপিলের রায়ে বলা হয়েছিল, যাবজ্জীবন কারাদন্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির সাজা মওকুফ (রেয়াত) পাওয়ার কোনো অধিকার নেই। যাবজ্জীবন কারাদন্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি অন্য কোনো সুবিধা (রেয়াত) পাওয়ার দাবি করতে পারে না। ব্রিটিশ আমলে করা আইন ও কারাবিধির বর্তমান প্রেক্ষাপটে নানা অসঙ্গতির কথা তুলে ধরতে গিয়ে বিচারপতি এসকে সিনহা আদালতের বাইরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাবজ্জীবন কারাদন্ড নিয়ে 'বিভ্রান্তির' কথা বলেছিলেন। ২০১৬ সালের ২৬ জুন গাজীপুরে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, 'যাবজ্জীবন কারাদন্ডপ্রাপ্ত আসামি বলতে আপনারা মনে করেন ৩০ বছর। ধরে নেয়, সব জায়গায়। প্রকৃতপক্ষে এটার অপব্যাখ্যা হচ্ছে। যাবজ্জীবন অর্থ হলো একেবারে যাবজ্জীবন, রেস্ট অফ দ্য লাইফ।' এরপর আদালতে দেওয়া রায়েও একই মত প্রকাশ করেন তিনি। ওই রায় প্রকাশের পরদিন তার ব্যাখ্যায় তখনকার অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছিলেন, আপিলে যাদের মৃতু্যদন্ডের সাজা কমে যাবজ্জীবন কারাদন্ড হবে, শুধু তাদের ক্ষেত্রেই আমৃতু্য কারাগারে কাটাতে হবে। আর বিভিন্ন মামলায় যাদের যাবজ্জীবন সাজা হবে, তাদের মৃতু্য পর্যন্ত কারাগারে থাকতে হবে না। দন্ডবিধি অনুযায়ী ৩০ বছর জেল খেটেই বের হবেন তারা।