সাংগঠনিক নিষ্ক্রিয়তায় মৃতপ্রায় ২০ দল!

২০ দলীয় জোটের ৭টি দলের নিজস্ব কোনো কর্মকান্ড নেই। ১১টি দলে নামকাওয়াস্তে কিছু কার্যক্রম থাকলেও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল

প্রকাশ | ০৩ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:০০ | আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:০৪

যাযাদি রিপোর্ট

অনিয়মের অভিযোগে জাতীয় নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করা বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলের জাতীয় সব ইসু্যতে সরকারকে বেকায়দায় রাখার বিষয়টি স্বাভাবিক হলেও বাস্তবে তাদের অবস্থান একেবারেই উল্টো। কাগজে-কলমে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক জোটটির বিভিন্ন দলে দফায় দফায় ভাঙন, নিয়মিত বৈঠক না হওয়া এবং অধিকাংশ শরিক দলের নিষ্ক্রিয় ভূমিকার কারণে মৃতপ্রায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দলীয় জোটের ৭টি দলের নিজস্ব কোনো কর্মকান্ডও নেই। ১১টি দলে নামকাওয়াস্তে কিছু কার্যক্রম থাকলেও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। বড় দুই দলের মধ্যে জামায়াতের কার্যক্রম নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আর নিজস্ব কিছু কর্মসূচি নিয়ে বিএনপি মাঠে থাকলেও জোটের রাজনীতি নিয়ে আগ্রহ কম। জোট নেতাদের মতে, জোটের প্রায় সব দলই বিএনপির আলোয় আলোকিত। যেখানে জোটকে সক্রিয় রাখতে তাদের অবদান সবচেয়ে বেশি থাকার কথা সেখানে বিএনপির অসহযোগিতায় জোট আরও নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। যদিও জোট থেকে ছিটকে পড়ার আশঙ্কায় বিএনপির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কিছু বলতে কেউই সাহস করে না। জোটের ছোট কয়েকটি দলের নেতার অভিযোগ, বিএনপি ঐক্যফ্রন্টকে গুরুত্ব দিয়ে ২০ দলীয় জোটকে ধীরে ধীরে নিষ্ক্রিয় করেছে। এই অভিমান থেকে বিজেপির আন্দালিব রহমান পার্থ আগেই জোট ছেড়েছেন। জোটের অন্যতম শীর্ষ নেতা কর্নেল (অব.) ডক্টর অলি আহমদ 'জাতীয় মুক্তি মঞ্চ' গঠন করেছিলেন। এই মঞ্চে জোটের শরিক জামায়াত, কল্যাণ পার্টি, জাগপাসহ ছোট কয়েকটি দলও যুক্ত হয়। ফলে ২০ দলীয় জোটের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব আরও স্পষ্ট হয়। এর বাইরে করোনার প্রভাবে এমনিতে রাজনৈতিক কর্মকান্ড বন্ধ থাকায় শরিক দলগুলো নিজেদের কর্মকান্ড আরও সঙ্কুচিত করে। জোটের শরিক প্রভাবশালী এক নেতা বলেন, বিএনপির কারণেই মূলত ২০ দলীয় জোট এখন মৃতপ্রায়। এর প্রথম কারণ হচ্ছে, কোনো দলের ভাঙনের অবস্থা তৈরি হলেও বিএনপির একটা অংশ এক পক্ষে আরেকটি অংশ অপর পক্ষে অবস্থান নিয়ে ভাঙনকে উৎসাহিত করেছে। ফলে ছোট দল আরও ক্ষুদ্র হয়ে গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সর্বশেষ জুলাই মাসে ২০ দলের ভার্চুয়াল একটি সভা হয়েছিল। সেখানেও বিএনপির পক্ষ থেকে অন্য দলগুলোরের প্রতি কোনো দিকনির্দেশনা ছিল না। নিজেরা উদ্যোগী হয়ে ছোট দলগুলো কিছু কর্মসূচি করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সেসব কর্মসূচি অংশগ্রহণে বিএনপির কোনো তারকা নেতাকে পাওয়া যায়নি। বিএনপির কোনো বড় নেতা ছাড়া ছোট দলগুলোর কর্মসূচি গুরুত্বও পায় না। এজন্য ছোট ছোট দলগুলো ইচ্ছা থাকলেও কোনো কর্মসূচি পালন করে না। ২০ দলীয় জোটের বিভিন্ন দলের কর্মকান্ড প্রসঙ্গে সিনিয়র এক নেতা জানান, মুসলিম লীগ, ডেমোক্রেটিক লীগ, পিপলস লীগ, ন্যাপ-ভাসানী, বাংলাদেশ ইসলামিক পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাপ ও সাম্যবাদী দলের গত এক বছরে কোনো কর্মকান্ডের রেকর্ড নেই। এলডিপি (দুই অংশ), জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর), কল্যাণ পার্টির সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, খেলাফত মজলিশ, ইসলামী ঐক্য জোট, নেজামী ইসলামী, জমিয়তে উলামা ইসলামী (দুই অংশ), এনপিপি, লেবার পার্টি, এনডিপি, জাগপা, জাতীয় দলের নিজস্ব উদ্যোগে মানববন্ধন, আলোচনা সভা, ইফতার পার্টি ও প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি পালন করেছে। জামায়াতে ইসলামীর দলের অভ্যন্তরীণ কিছু কর্মকান্ড থাকলেও জোটকেন্দ্রিক কোনো তৎপরতা নেই। আর জোটের নেতৃত্বে থাকা বিএনপিরও জোটের রাজনীতি নিয়ে তেমন কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না। জোট রাজনীতির ধীরগতির বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, রাজনৈতিক জোট গঠন করা হয়েছে একটি বিশেষ প্রেক্ষাপটে। তাদের সঙ্গে বিএনপির আদর্শিক জোট হয়নি, হয়েছে নির্বাচন ও আন্দোলনকেন্দ্রিক জোট। বর্তমানে দেশে করোনাকাল চলছে। তাই রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ বা কর্মসূচি কম। সরাসরি বৈঠক কম হলেও জোটের সঙ্গে বিএনপির যোগাযোগ আছে। সময়মতো মাঠের কর্মসূচি নিয়ে যৌথভাবে রাজপথে নামবেন। নিষ্ক্রিয় কর্মকান্ডের কারণে জোটের রাজনীতি মৃতপ্রায় অবস্থা থেকে উত্তরণের কোনো উপায় আছে কিনা জানতে চাইলে এলডিপির একাংশের মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, জোট সক্রিয় থাকুক তা সময়ের দাবি। কিন্তু একটি বিশেষ দলকে কেন্দ্র করে জোট ও ঐক্যফ্রন্ট একমঞ্চে আসতে না পারায় দুই জোট এক হতে পারছে না। ফলে ঐক্যবদ্ধ একটি পস্ন্যাটফর্ম ও তৈরি হচ্ছে না। কোনো দল যদি বৃহত্তর ঐক্য গঠনে অন্তরায় হয় তাহলে জাতীয় স্বার্থে তাদের বাদ দিয়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়া উচিত। তাহলে জোটের রাজনীতিও বাঁচবে। মৃতপ্রায় শব্দটা তখন আর বলা যাবে না। বিএনপি ও জোটের রাজনীতির ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১৯৯৯ সালে চারদলীয় ঐক্যজোট গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করে বিএনপি। বছরের শুরুতে এইচ এম এরশাদ, জামায়াতের তৎকালীন আমির গোলাম আযম ও ইসলামী ঐক্যজোটের তখনকার চেয়ারম্যান শায়খুল হাদিস আলস্নামা আজিজুল হককে সঙ্গে নিয়ে চারদলীয় জোট গঠনের চেষ্টা শুরু করেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। একপর্যায়ে এইচ এম এরশাদ এই প্রক্রিয়া থেকে সরে এলে নাজিউর রহমান মঞ্জুর নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির একাংশকে নিয়ে চারদলীয় জোট গঠিত হয়। ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে থাকা চারদলীয় জোট কলেবরে বেড়ে ১৮ দলীয় জোট হয়। বিএনপি ছাড়া সে সময় জোটের শরিক দলগুলো ছিল জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত মজলিশ, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), কল্যাণ পার্টি, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা), ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি), ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এনডিপি), লেবার পার্টি, ইসলামিক পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাপ, ন্যাপ ভাসানী, মুসলিম লীগ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, পিপলস লীগ ও ডেমোক্রেটিক লীগ। পরে বিভিন্ন সময়ে জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) ও সাম্যবাদী দলের একাংশ এই জোটে যোগ দিলে তা ২০ দলীয় জোটে পরিণত হয়। জোট গঠন প্রক্রিয়ার শুরুতেই এরশাদ সরে যাওয়ার বিষয়টির মতো গত কয়েক বছরে জোটের শরিকদের মধ্যে নানা টানাপড়েন লেগেই ছিল। জোটের দলগুলোর কর্মকান্ডের জন্য দলের ভেতরে-বাইরে দুই ক্ষেত্রেই সমালোচনা শুনতে হয়েছে বিএনপিকে। বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের সাজা পাওয়ার কারণে তীব্র সমালোচনায় পড়লেও জামায়াতকে ছাড়েনি বিএনপি। সংশ্লিষ্টদের মতে, ভোটের রাজনীতির নানা মেরুকরণের বিবেচনায় জামায়াতকে এখনো সঙ্গী করে রেখেছে বিএনপির নেতৃত্ব। ২০ দলীয় জোট গঠনের পর কয়েক দফা ভাঙনের মুখে পড়ে। এনপিপি, এনডিপি, ন্যাপ ভাসানী, ইসলামী ঐক্যজোট, এলডিপিসহ কয়েকটি দলের ভাঙনের কারণে কয়েকটি দলের শীর্ষ নেতারা জোট ছাড়েন। কিন্তু ঐসব দলের বিদ্রোহী একাংশ ব্রাকেট বন্দী দল গঠন করে ২০ দলেই থেকে যায়। ২-১টি দলের উভয় অংশই ব্রাকেট বন্দি থেকে যায় ২০ দলীয় জোটে। ফলে ২০ দল একটি পর্যায়ে ২৩ দলে রূপান্তরিত হলেও নাম ২০ দলই থেকে যায়।