বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আপাতত মাস্কই ভ্যাকসিনের বিকল্প

জাহিদ হাসান
  ০৩ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:০০
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ রোধে মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন প্রচার ও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করার পরও মাস্ক ছাড়াই ঘুরছে বেশিরভাগ মানুষ। ছবিটি বুধবার রাজধানীর গুলিস্তান থেকে তোলা -ফোকাস বাংলা

করোনা মহামারি থেকে আত্মরক্ষার প্রধান উপায়গুলোর মধ্যে মাস্ক পরিধান প্রাথমিক চিকিৎসা হওয়ায় সংক্রমণের শুরু থেকেই জনস্বাস্থ্যবিদরা বিষয়টির প্রতি গুরুত্বারোপ করে আসছেন। এদিকে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের মতো চলতি শীতে দেশেও করোনার সম্ভাব্য দ্বিতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। যার উদাহরণ গত তিন সপ্তাহে ক্রমেই সংক্রমণ ও মৃতু্য বাড়ছে। এমনকি প্রায় তিন মাস পর গত সোমবার একদিনে আড়াই হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার ভাইরাসটির প্রকোপ মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সংক্রমণের লাগাম টানতে আপাতত মাস্ককেই ভ্যাকসিনের বিকল্প হিসেবে দেখছে।

২৫ নভেম্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাঁচ সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি করোনার শীতকালীন প্রকোপ ও দ্বিতীয় ঢেউ সামলাতে ১৩ দফা-সংবলিত একটি কর্মপরিকল্পনা জমা দিয়েছেন। সেখানে জনসাধারণের মধ্যে বিনামূল্যে মাস্ক বিতরণের পরামর্শ দিয়ে সেটা বাস্তবায়নে গোটা সরকারব্যবস্থাকে যুক্ত হওয়ার কথা বলা হয়েছে।

ওই কমিটির অন্যতম সদস্য জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল যায়যায়দিনকে বলেন, শীতের শুষ্ক মৌসুমে বাতাসে ধূলিকণার পরিমাণ বেড়ে যায়। দূষণের কারণে এমনিতেই জ্বর-কাশি ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে থাকে। ইতোমধ্যে শিশুসহ বিভিন্ন বয়সের লোকজন বায়ু দূষণের কারণে অসুস্থ হচ্ছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে করোনার সঙ্গে এই ইনফেকশন আলাদা করতে সমস্যা হচ্ছে।

এ জন্য বিশেষজ্ঞ কমিটি সুনির্দিষ্ট কাজের সুপারিশের পাশাপাশি সার্বজনীন মাস্ক ব্যবহারের জন্য মাস্ক উৎপাদন, বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে মাস্ক বিতরণের পরামর্শ দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে দরিদ্র মানুষ, পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও অ্যাম্বুলেন্স চালকদের মধ্যে মাস্ক বিতরণে বেশি গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে। যা বাস্তবায়নে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এফবিসিসিআই, বিজেএমএইএ ও বিকেএমইএ, বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ওষুধ কোম্পানি এবং ব্যাংকে যুক্ত করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

এদিকে জনসাধারণকে মাস্ক ব্যবহারে বাধ্য করতে সরকার রাজধানী থেকে শুরু করে

জেলা-উপজেলা পর্যায়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মাধ্যমে জরিমানা ও মাস্ক বিতরণ করছে। এই সচেতনতামূলক প্রচারণায় বেসরকারি অফিস-আদালত, মসজিদ-মন্দির থেকে শুরু করে বাজার-ঘাট, গণপরিবহণের যাত্রীদের মধ্যে মাস্ক ব্যবহারের প্রবণতা বাড়তে দেখা গেছে।

জনসাধারণকে মাস্ক পরতে উদ্বুদ্ধ করতে মঙ্গলবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক আয়োজিত অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য সচিব আব্দুল মান্নান বলেন, 'খুব তাড়াতাড়িই বাংলাদেশ করোনার ভ্যাকসিন পাবে। সেটা আগামী বছরের ফেব্রম্নয়ারি মাস অথবা এর আগেও হতে পারে। কিন্তু এর আগ পর্যন্ত আমাদের বাঁচার, সংক্রমণ ঠেকানোর একমাত্র পথ হচ্ছে মাস্ক পরে থাকা।'

এ ছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, 'সারা বিশ্বে গবেষণায় দেখা গেছে, কেউ যদি সুরক্ষিত একটা মাস্ক পরতে পারে, তাহলে শতকরা ৯৫ শতাংশের বেশি নিরাপদ থাকবে। কাজেই শিশু থেকে শুরু করে প্রত্যেককে মাস্ক পরতে হবে। মাস্ক পরে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলাসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। আর এ জন্য সারাদেশে 'নো মাস্ক নো সার্ভিস' ঘোষণা করা হচ্ছে।'

এর আগে গত ৩০ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে করোনার বিস্তার রোধে আরও কঠোর হওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। বৈঠকে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে মাস্ক পরার ওপর কড়াকড়ি আরোপ করা, মাস্ক না পরলে সর্বোচ্চ জরিমানা করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়া হয়। এভাবে এক সপ্তাহ থেকে ১০ দিন চলার পরও যদি লোকজনের মধ্যে মাস্ক ব্যবহারে উদাসীনতা দেখা দেয়, তা হলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে কারাদন্ড দেওয়ার মতো কঠোর অবস্থানের কথা জানানো হয়।

এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগে জনাকীর্ণ জায়গায় অবস্থানরত অধিকাংশ মানুষ মাস্ক ব্যবহারে নানা অজুহাত দেখালেও বর্তমানে সরকারের প্রচারণা ও কঠোর অবস্থানের কারণে পরিস্থিতির পরিবর্তন হচ্ছে। এ ছাড়া এখন পর্যন্ত ভাইরাসটির কার্যকর প্রতিষেধক না আসায় আপাতত মাস্কই ভ্যাকসিনের বিকল্প হিসেবে আত্মরক্ষার প্রধান উপায়। যা ধীরে হলেও মানুষ বুঝতে শিখছে, অনেকে সচেতন হয়ে মাস্ক ব্যবহার করছে। তবে এর সঙ্গে নিয়মিত সাবান-পানি বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কারের অভ্যাস, পারসোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট বা পিপিইর মতো সুরক্ষাসমাগ্রী ব্যবহার বাস্তবায়নে সরকারকে আরও বেশি জোর দিতে হবে। করোনার মতো জাতীয় দুর্যোগ মোকাবিলায় সব স্তরের প্রশাসন, বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন, বেসরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।

করোনাভাইরাস প্রতিরোধে মাস্ক ব্যবহারের উপকারিতা-

২০১৬ সালে নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি সমীক্ষায় বলা হয়, মানুষ প্রতি ঘণ্টায় গড়ে ২৩ বার হাত দিয়ে মুখ স্পর্শ করে। তবে মাস্ক পরিধান হাঁচি বা কাশি থেকে ভাইরাসের সংক্রমণের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করতে পারে। এটি হাত থেকে মুখের সংক্রমণের বিরুদ্ধেও সুরক্ষা দেয়।

চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা আরও জানান, একটি ডিসপোজেবল মাস্ক, যাকে সার্জিক্যাল ফেস মাস্কও বলা হয়। যা হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা বেশি ব্যবহার করেন। এটি চিকিৎসক ও রোগী উভয়কেই সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে। তবে এই মাস্ক বাতাসের ছোট ছোট কণা আটকাতে পারে না। আর ৩-৮ ঘণ্টার বেশি পরা উচিত নয়।

অন্যদিকে এন-৯৫ রেসিপিরেটর মাস্ক সম্পর্কে চিকিৎসকরা বলেন, অস্ত্রোপচারের মাস্কের চেয়েও এটি বেশি কার্যকর। কারণ, এটি বাইরে থেকে ভেতরে ব্যাক্টেরিয়া সংক্রমণকে প্রতিরোধ করে। এই মাস্ক করোনা, এইচ-১ ডবিস্নউ-১ এবং সার্সের মতো ভাইরাসের সংক্রমণে সহায়তা করে। ফলে করোনাভাইরাস থেকে সুরক্ষা পেতে এন-৯৫ রেসিপিরেটরের ব্যবহার বেশি কার্যকর। কারণ, এই মাস্কগুলো ভালো ফিট হয় এবং প্রায় শূন্য দশমিক তিন মাইক্রোনের ব্যাসযুক্ত ছোট কণাগুলোকে ফিল্টার করে দেয়। এটি বাতাসে উপস্থিত ছোট কণার ৯৫ শতাংশকে অবরুদ্ধ করতে পারে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে