মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ড গঠিত হয়

যাযাদি রিপোর্ট
  ০৩ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:০০

একাত্তরের এ দিনে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসরদের পরাজিত করে বরগুনাকে মুক্ত করেন বাংলার দামাল ছেলেরা। এদিন গঠিত হয় বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ড। ভারতীয় মিত্রবাহিনী আর বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের মিলিত প্রতিরোধের মুখে পরাজিত হতে থাকে পাক হানাদাররা। অসীম সাহসী মুক্তিবাহিনী শক্ত মনোবল আর দৃঢ়প্রতিজ্ঞা বিজয় অর্জনের পথে সব বাধা অতিক্রম করে এগুতে থাকে দুর্দমনীয় গতিতে।

মুক্তিযুদ্ধের পুরো ৯ মাস বরগুনা জেলা ছিল ৯ নম্বর সেক্টরের অধীনে। এ সেক্টরের বুকাবুনিয়া সাব-সেক্টরের অধীনে মুক্তিসেনারা প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তোলেন। প্রতিরোধ যুদ্ধের একপর্যায়ে চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের মুহূর্তে সাব-সেক্টর সদর দপ্তর থেকে মুক্তিযোদ্ধা মো. সাত্তার খানের প্রতি বরগুনাকে হানাদারমুক্ত করার আদেশ জারি হয়। ওই আদেশের সঙ্গে সঙ্গেই সাত্তার খানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ১৯৭১ সালের ২ ডিসেম্বর বুকাবুনিয়া থেকে বেতাগী থানার বদনিখালী

হ বাজারে গিয়ে অবস্থান নেন। এর আগে মুক্তিযোদ্ধা তোফাজ্জল হোসেনকে ছদ্মবেশে পাঠানো হয় বরগুনা সদরে। তিনি জেলা শহরের পুরো পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সিগন্যাল দেওয়ার পরপরই মুক্তিযোদ্ধারা বদনিখালী থেকে হেঁটে কালীবাড়ি লঞ্চঘাটে যান। সেখানে রাত ২টায় একটি নৌকায় চড়ে বরগুনা সদরের উদ্দেশে যাত্রা করেন তারা। তীব্র শীত উপেক্ষা করে ভোরে মুক্তিযোদ্ধারা পোটকাখালী পৌঁছে নিজেদের অস্ত্র লুকিয়ে রেখে ছয়টি টার্গেট পয়েন্টে গিয়ে অবস্থান নেন। ওই সময় বীর যোদ্ধারা যুদ্ধের সংকেত হিসেবে ফজরের আজানকে ব্যবহার করেন। নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা চূড়ান্ত করে সিদ্ধান্ত নেন, আজানের সঙ্গে সঙ্গেই সব পয়েন্ট থেকে একসঙ্গে আক্রমণ শুরু করবেন। সেই অনুযায়ী ফজরের আজান শুরু হতেই ছয়টি পয়েন্টে অবস্থান নেওয়া মুক্তিযোদ্ধারা একসঙ্গে শত্রম্নর অবস্থান লক্ষ্য করে একযোগে গুলিবর্ষণ শুরু করেন। পরিস্থিতি আর নিজেদের অনুকূলে নেই বুঝতে পেরে পাকিস্তানি বাহিনীর অনুগত পুলিশ সদস্যরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এর মধ্য দিয়েই স্বাধীন হয় বরগুনা।

একাত্তরের আজকের দিনে কলকাতার গড়ের মাঠে ভাষণ দিয়ে বাংলাদেশ নামের নতুন রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার কথা ছিল ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর। এ ঘোষণার জন্য উন্মুখ হয়ে ছিল কোটি বাঙালির প্রাণ। কিন্তু কোনো ঘোষণা আসে না। উল্টো পাকিস্তান বাহিনী ভারতের অমৃতসর, পাঠানকোট, শ্রীনগর, অবন্তীপুর, যোধপুনর, আম্বালা এবং আগ্রা বিমান ঘাঁটিতে আক্রমণ করে বসে। এদিন মধ্যরাতে ভারতও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করে।

পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনীর নাজেহাল পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান কেন ভারত আক্রমণ করে যুদ্ধের সূচনা ঘটাল, সেটা অনেকের কাছে বড় জিজ্ঞাসা হয়ে রয়েছে। এর আগে ভারত মুক্তিবাহিনীর সমর্থনে সীমান্ত অতিক্রম করলেও তা ছিল সীমিত সংখ্যায় ও সীমিত আকারে। ভারত যুদ্ধ শুরুর দায় নিজের কাঁধে নিতে চাইছিল না। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন প্রদানের নীতি গ্রহণের পরও এ ক্ষেত্রে ভারতের দ্বিধার মূল কারণ ছিল, বিশ্বের সামনে নিজেকে আক্রমণের সূচনাকারী হিসেবে চিহ্নিত হতে না দেওয়া। তা হলে পাকিস্তান কেন স্ব-উদ্যোগে যুদ্ধের সূচনা করল? এর উত্তর আসলে খুঁজতে হবে পাকিস্তানি সামরিক শাসকগোষ্ঠী ও এলিট চক্রের মানসের মধ্যে। দীর্ঘকাল রাষ্ট্রক্ষমতা যথেচ্ছভাবে ভোগের ফলে বিপুল সামরিক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে পড়ে ক্ষুদ্র এক চক্র, যারা নিজেদের বুদ্ধি অথবা বুদ্ধিহীনতার আবর্তে ঘুরপাক খেতে খেতে বিপুল মানুষের জীবনসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে পরিচয় দেয় চরম অবিমৃশ্যকারিতার। এ কারণেই তাদের হাতে প্রণীত হয়েছিল অপারেশন সার্চলাইটের মতো নিষ্ঠুর গণহত্যা-পরিকল্পনা, যা অচিরে পরিগণিত হয় জাতিহত্যা বা জেনোসাইডে। বিশ শতকের ইতিহাসে হিটলারের বাহিনীর মতো আরেক ঘৃণিত বাহিনীর রূপ নেয় পাকিস্তান সেনাবাহিনী, যদিও যেই কুসিত চেহারা আড়াল করার জন্য প্রসাধনী জোগানো হয়েছে অনেক দিক থেকে, বিশ্ব রাজনীতির ক্ষমতাধররা দিয়েছে এক প্রলেপ, ইসলামের নাম ভাঙিয়ে লাগানো হয়েছে আরেক প্রলেপ।

একাত্তরের এ দিনে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর বীর সেনাদের হামলায় নারায়ণগঞ্জের গোদাইল ও চট্টগ্রামের ফুয়েল পাম্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখানে পরাজিত হয় দখলদারবাহিনী। দেশের বিভিন্ন স্থানে এ রকম ছোট-বড় সফল অপারেশন বাঙালির বিজয়ের সম্ভাবনাকে আরও সুনিশ্চিত করে তোলে। স্বাধীনতার জন্য দিন গুনতে থাকে এ স্বাধীনতাকামী বাঙালি। এদিন কুমিলস্নায় মেজর আইনউদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী মিয়াবাজারে পাক সেনাদের ওপর হামলা চালায়। মুক্তিযোদ্ধারা মিয়াবাজার দখল করে নেন। আখাউড়ার আজমপুর স্টেশনে দু'পক্ষ নিজ নিজ অবস্থানে থেকে দিনভর চালিয়ে যায় যুদ্ধ। নোয়াখালীতে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল মুক্ত করেন সোনাইমুড়ি। এরপর তারা চৌমুহনীতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওপর আক্রমণ শুরু করেন। মেজর জাফর ইমামের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী মাইজদীতে পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায় একাত্তরের এদিনে। রংপুরের পলাশবাড়িতে ১২ পাক সেনা আত্মসমর্পণ করে। সাতক্ষীরা থেকে পিছু হটে দৌলতপুরের দিকে পালিয়ে যায় পাকবাহিনী।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে