অবশেষে রোহিঙ্গাদের প্রথম দল ভাসানচরে

প্রকাশ | ০৫ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:০০ | আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:০৫

স্টাফ রিপোর্টার, ঢাকা ও হাতিয়া (নোয়াখালী) প্রতিনিধি
কক্সবাজারের উখিয়া থেকে নিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের শুক্রবার সকালে জাহাজে করে নোয়াখালীর ভাসানচর নিয়ে যাওয়া হয় -স্টার মেইল

নানা বিতর্ক ও সমালোচনাকে তুচ্ছ করে শেষ পর্যন্ত ভাসানচরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বাংলাদেশে আশ্রিত মিয়ানমারের বাস্তুচু্যত রোহিঙ্গাদের একাংশকে। এরইমাঝে ভাসানচরে পৌঁছেছে এক হাজার ৬৪২ জন রোহিঙ্গার প্রথম দল। শুক্রবার দুপুর ২টায় তারা ভাসানচরে পৌঁছে। এর আগে চট্টগ্রাম থেকে সাতটি জাহাজ তাদের নিয়ে ভাসানচরে ভেড়ে। উখিয়ার আশ্রয়শিবির থেকে বৃহস্পতিবার এই রোহিঙ্গাদের বাসে করে চট্টগ্রামে নিয়ে আসা হয়েছিল। ভাসানচরে স্থানান্তরের জন্য এই রোহিঙ্গাদের বুধবার রাতেই উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পসংলগ্ন ঘুমধুম ট্রানজিট ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয়। এ সময় উখিয়া ডিগ্রি কলেজ ক্যাম্পাসে জড়ো করা হয় কয়েক ডজন বাস। এসব বাসে করে মোট পাঁচটি দলে ভাগ করে উখিয়া থেকে রোহিঙ্গাদের চট্টগ্রামে নিয়ে আসা হয়। যাত্রাপথে বাসগুলোর সামনে ও পেছনে ছিলর্ যাব, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়া নিরাপত্তা। তবে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা সরকারের এই উদ্যোগ থেকে দূরত্ব রেখে চলেছে। বুধবার এক বিবৃতিতে জাতিসংঘ বলেছে, রোহিঙ্গাদের ভাসান চরে নেওয়ার যে পরিকল্পনা সরকার করেছে, তার সঙ্গে জাতিসংঘের কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা নেই। ভাসানচরে যাওয়ার ক্ষেত্রে রোহিঙ্গারা যেন সব তথ্য জেনে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তা নিশ্চিত করতেও সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয় ওই বিবৃতিতে। এদিকে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচও (এইচআরডবিস্নউ) বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। তবে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান শেষে শুক্রবার রোহিঙ্গাদের নৌবাহিনীর ছয়টি এবং সেনাবাহিনীর একটি জাহাজে তোলা হয় ভাসানচরে নিয়ে যাওয়ার জন্য। জাহাজগুলোর ডেকে অস্থায়ী বেঞ্চ বসিয়ে করা হয় সবার জন্য বসার ব্যবস্থা। সকাল সোয়া ১০টার পর চট্টগ্রামের বোট ক্লাব, আরআরবি জেটি ও কোস্টগার্ডের জেটি থেকে জাহাজগুলো ভাসানচরের উদ্দেশে রওনা হয় বলে নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কমান্ডার এম কে জেড শামীম জানান। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, এই দলে রয়েছেন, ৩৬৮ জন পুরুষ, ৪৬৪ জন নারী এবং ৮১০ শিশু। আগামী প্রায় এক সপ্তাহ নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে তাদের রান্না করে খাওয়ানো হবে। ২২টি এনজিও রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা দিতে ইতোমধ্যে ভাসানচরে অবস্থান করছে বলেও জানা গেছে। এর আগে নৌবাহিনীর দুটো জাহাজে করে রোহিঙ্গাদের ১০১৯টি লাগেজ বৃহস্পতিবারই ভাসানচরে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। শুক্রবার নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ডের আরও আটটি জাহাজ কনভয়ের সঙ্গে ভাসানচরে যায়। কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির ও তার বাইরে অবস্থান নিয়ে থাকা প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে নিয়ে নানা সামাজিক সমস্যা সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে দুই বছর আগে তাদের একটি অংশকে হাতিয়ার কাছে মেঘনা মোহনার দ্বীপ ভাসানচরে স্থানান্তরের পরিকল্পনা নেয় সরকার। এরপর গত ৫ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের শরণার্থী ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গাদের একটি প্রতিনিধি দলকে দেখার জন্য ভাসান চরে পাঠানো হয়। তারা ফেরার পর তাদের কথা শুনে রোহিঙ্গাদের একাংশ ভাসানচরে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করে বলে জানানো হয় সরকারি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে। এদিকে বৃহস্পতিবার (৩ ডিসেম্বর) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানিয়েছিল, মোট এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে আশ্রয় দেওয়ার জন্য ঘর তৈরি করা হয়েছে। যেসব রোহিঙ্গা সেখানে যাবে, তাদের জন্য আগামী তিন মাসের খাদ্য মজুত আছে। এ ছাড়াও পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসেবা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রস্তুত রয়েছে। এমনকি এই চরে হাঁস-মুরগি পালন ও সবজি চাষেরও সুযোগ থাকবে রোহিঙ্গাদের। এর আগে করোনা মহামারির সময়ে সুমদ্র থেকে ভাসমান অবস্থায় উদ্ধার করা ৩০৬ জন রোহিঙ্গাকে আগেই ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়েছিল। তবে তাদের কক্সবাজারে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের জন্য ভাসানচরের এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। যা পরবর্তী সময়ে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৯৪ কোটি টাকায়। ভাসানচরে নির্মিত প্রতিটি বাড়িতে ১৬টি করে রোহিঙ্গা পরিবার থাকতে পারবে। প্রতি গুচ্ছতে ১২টি করে বাড়ি রয়েছে। এরকম ১০০টিরও বেশি গুচ্ছের প্রতিটিতে শিশুদের জন্য খেলা ও পুকুরের ব্যবস্থা আছে। এছাড়া সেখানে বর্ষার পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা, সৌর চালিত পাম্পের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ব্যবস্থা, মাল্টি পারপাস সাইক্লোন শেল্টার, সৌর বিদু্যৎ ও অন্যান্য সরকারি অফিস রয়েছে। তবে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের বসবাসের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হবে সরকারের, যা একটি বড় বোঝা হতে পারে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, সেখানে ৩০৬ জন রোহিঙ্গার জন্য প্রতি তিন মাসে খরচ হয় প্রায় তিন কোটি টাকা। ভাসানচরে রোহিঙ্গার সংখ্যা বাড়লে অর্থ ব্যয়ের পরিমাণ আরও বাড়বে।