দেশে ওয়াইম্যাক্স যুগ প্রায় শেষ

গত পঁাচ বছরে এই সেবা গ্রাহক হারিয়েছে ৮৪ শতাংশ বাজারে দুই হাজার কোটি টাকা হারিয়েছে কিউবি

প্রকাশ | ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:০০

আহমেদ তোফায়েল
কয়েক বছর আগেও দেশে ইন্টারনেট সংযোগের জন্য বেশ জনপ্রিয় ছিল তারবিহীন ব্রডব্যান্ড সাভির্স ‘ওয়াইম্যাক্স’। এখন ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়ার দৌড়ে টিকে থাকতে না পেরে নিজেদের অস্তিত্বের শেষপ্রান্তে এসে দঁাড়িয়েছে এ সেবা। উচ্চগতির মোবাইল ইন্টারনেট সেবার বিপরীতে গত পঁাচ বছরে এই ব্রডব্যান্ড সিস্টেম হারিয়েছে ৮৪ শতাংশ গ্রাহক। এক যুগ আগেও দুই প্রতিযোগী অপারেটর বাংলা লায়ন ও কিউবি শুধু লাইসেন্স বাবদ কোম্পানি ফি দিয়েছে ২১৫ কোটি টাকা করে। গ্রাহক ও নেটওয়াকর্ সম্প্রসারণে প্রত্যেকটি কোম্পানি খরচ করেছে ২ হাজার কোটি টাকার ওপর। ২০১৩ সালের জুন পযর্ন্ত দেশে থ্রিজি সেবা চালুর মুহূতের্ ওয়াইম্যাক্স ব্রডব্যান্ডের গ্রাহক সংখ্যা দঁাড়িয়েছিল ৫ লাখ ৫ হাজার। আর চলতি বছরের জুন মাসের শেষ পযর্ন্ত গ্রাহক নেমে দঁাড়িয়েছে ৮০ হাজার ৮৬০ এ। আগস্ট মাসের ৩০ তারিখে কিউবি যখন ঘোষণা করে তারা আর ইন্ডিভিজুয়্যাল সাবসক্রাইবারদের সেবা দিচ্ছে না তখন আরও কমেছে ১০ হাজার গ্রাহক। কিউবির মালিকপক্ষ ‘ওগার ওয়্যার কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের চিফ কমাশির্য়াল অফিসার প্রতীক কুÐ জানান, মোবাইল ইন্টারনেটের ক্ষেত্রে থ্রিজি ও ফোরজির আবিভার্ব তাদের পিছিয়ে দিয়েছে। অচল হয়ে পড়ছে বিশ্বব্যাপী ওয়াইম্যাক্স সেবা। মালিকপক্ষ চাচ্ছেন তাদের এই ব্যবসা শিফট করতে। কিন্তু তারা নতুন কোনো যন্ত্রপাতি এই ক্ষেত্রে যোগ করতে পারছেন না। প্রতীক কুÐ বলেন, এই বাজারে তারা দুই হাজার কোটি টাকা হারিয়েছেন। কোম্পানির অস্বিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য এখন আরও বিনিয়োগের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। ২০১৩ সালে কিউবি বাজারে আসার পর থেকে গত জুন মাস পযর্ন্ত এই ব্রডব্যান্ড সাভির্সটির ১৬ হাজার ২১১ জন গ্রাহক ছিল। এমনকি এই প্রতিষ্ঠানটি দেশে ইন্টারনেট সেবার দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মাকের্ট লিডার বাংলা লায়নকে টেক্কা দিয়ে ব্যবসা করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এখন সারা দেশে তাদের কিছু করপোরেট গ্রাহক ছাড়া আর কোনো গ্রাহক নেই। জানা যায়, ওয়াইম্যাক্স ইন্টারনেট সেবার সীমাবদ্ধ নেটওয়াকর্ কাভারেজের কারণেই গ্রাহক হারিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এই সেবাটি পাওয়া যেত শুধু শহরাঞ্চলে। অথচ থ্রিজি ইন্টারনেট সেবা এখন শুধু শহরেই নয় সারাদেশেই বিস্তৃত। বাংলা লায়নের হেড অব মাকেির্টং অ্যান্ড কমিউনিকেশন জিএম ফারুক খান বলেন, ইন্টারনেট সেবায় নতুন কিছু করতে তারা নতুন সেবা চালু করতে যাচ্ছেন। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে তারা কোনো সহযোগিতা পাচ্ছেন না। তিনি বলেন, থ্রিজি সেবা চালুর পরপরই দেশের তরুণ সমাজ সেই দিকে ঝুঁকেছিল। বিশ্বের সব তরঙ্গ বিক্রেতারা ওয়াইম্যাক্স নেটওয়াকর্ যন্ত্রপাতি, ডিভাইস ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি বিক্রি করা বন্ধ করে দিয়েছে। রাকিব হাসনাত নামে কিউবির এক গ্রাহক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তিনি কল্যাণপুর দারুস সালাম রোডে থাকেন। অনেক দিন থেকে কিউবির ইন্টারনেট ব্যবহার করে আসছেন। এমনকি সাভির্সও ভালোই পেয়েছেন। কিন্তু এখন হঠাৎ করে তারা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করায় বিপাকে পড়তে হয়েছে তাকে। তিনি এসএমএস পাঠিয়ে বাংলা লায়নে ট্রান্সফার করতে বলেন। অথচ বাংলা লায়ন তার এ সংযোগটি সচল করতে অপারগতা জানায়। কিউবি কতৃর্পক্ষ বলছে, ওয়াইম্যাক্স সেবা বিশ্বব্যাপী মারা গেছে। আর সে কারণে তারা নিজেদের সেবার ধরন বদলে এলটিইতে (লং টামর্ ইভল্যুয়েশন) নিতে যাচ্ছে। আর সে কারণেই গ্রাহকদের তারা হস্তান্তর করছেন অপর একটি এলটিই কোম্পানির কাছে। তবে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে কিউবি এলটিই চালু করার পর নতুন করে এসব গ্রাহককে আবার তাদের সেবা নেয়ার আহŸান জানানো হবে বলেও জানিয়েছেন দায়িত্বশীলরা। উল্লেখ্য, এলটিই বা লং টামর্ ইভল্যুয়েশন ফোরজি হিসেবে পরিচিত। এটি মোবাইল ফোন এবং ডাটা টামির্নালগুলোর জন্য উচ্চগতির তথ্য আদান-প্রদানের বেতার যোগাযোগ ব্যবস্থাকে বোঝানো হয়। একে জিএসএম/এজ এবং ইউএমটিএস/এইচএসপিএ নেটওয়াকর্ প্রযুক্তির উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। ২০০৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর অসলো এবং স্টকহোম এ সেবা বিশ্বে প্রথমবারের মতো এলটিই সেবা সাধারণ জনগণের জন্য চালু করে। বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) তথ্যমতে, ২০১৩ সালের জুন পযর্ন্ত বাংলা লায়নের গ্রাহক সংখ্যা ছিল ৪ লাখের ওপর। কিন্তু এই বছরের জুন পযর্ন্ত বাংলা লায়নের গ্রাহক এসে দঁাড়িয়েছে ২৮ হাজার ৬১৯ জনে। বিটিআরসি আরও জানিয়েছে, ২০১৩ সালেই লাইসেন্স পাওয়া অলোর গ্রাহক সে বছরই ছিল ৭৫ হাজার ৩৯১ জন। অবশ্য এই কোম্পানিটি ২০১৫ সালে লংটামর্ ইভল্যুয়েশন (এলটিই) সেবার মাধ্যমে বেশ কিছু গ্রাহককে নিজেদের আওতায় আনতে পেরেছে। এই বছরের জুন পযর্ন্ত এই কোম্পানির গ্রাহক এসে দাঁড়িয়েছে ৩৬ হাজার ৪১ জনে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এখন অবশ্য ওয়াইম্যাক্স অপারেটররা এলটিই সেবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এটি মোবাইল ফোনের হাইস্পিড ইন্টারনেট সংযোগ ও ডাটা টামির্নালের জন্য সময়োপযোগী হবে। তাদের গ্রাহকদের ধরে রেখে নতুন গ্রাহকও টানতে পারবে অপারেটরগুলো। এদিকে ব্যক্তিগত গ্রাহকদের ওয়াইম্যাক্স সেবা দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে কিউবি। গত ৩০ আগস্ট তারা গ্রাহকদের সেবা বন্ধ করে দেয়। বাংলাদেশ থেকে একেবারে গুটিয়ে না নিলেও ব্যবসা সঙ্কুচিত করার পরিকল্পনা কিউবির অনেক দিনের। তার প্রক্রিয়ায় এখন কেবল তারা কপোের্রট গ্রাহকদেরকেই সেবা দেবেন। জুন মাসে এসে কিউবির সব মিলে ১৬ হাজার গ্রাহক থাকলেও তার মধ্যে ১২ হাজার ছিল ব্যক্তিগত পযাের্য়র গ্রাহক। এদিকে নিজেদের প্রতিদ্ব›দ্বী অপারেটর বাংলা লায়নের সঙ্গে চুক্তি করে কিউবি। যাতে করে কিউবি গ্রাহকরা বাংলা লায়নের গিয়ে ঠিকঠাক সেবা পান। কিন্তু ১২ হাজারের মধ্যে মাত্র হাজার দুয়েক গ্রাহক শেষ পযর্ন্ত বাংলা লায়নের কাছে গেছে বলে জানা গেছে। গ্রাহক হস্তান্তর করতে গিয়ে কিউবি তাদের গ্রাহকদেরকে চিঠি দিয়ে বাংলা লায়নের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার অনুরোধ জানায়। কিউবি কতৃর্পক্ষ বলছে, ওয়াইম্যাক্স সেবা বিশ্বব্যাপী মারা গিয়েছে। আর সে কারণে তারা নিজেদের সেবার ধরন বদলে এলটিই-তে চলে যাচ্ছে। আর সে কারণেই গ্রাহকদের তারা হস্তান্তর করেছেন অপর একটি এলটিই কোম্পানির কাছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে কিউবি এলটিই চালু করার পর নতুন করে এসব গ্রাহককে আবার তাদের সেবা নেয়ার আহŸান জানানো হবে বলেও বলছেন দায়িত্বশীলরা। উল্লেখ্য, ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে নিলামের মাধ্যমে ২১৫ কোটি টাকায় ব্রডব্যান্ড ওয়্যারলেস অ্যাকসেস (বিডবিøউএ) লাইসেন্স পায় কিউবি। এর এক বছর পর সেবা চালু করে তারা। পরে ২০১৩ সালে দেশে থ্রিজি মোবাইল সেবা চালু হওয়ার পর থেকে দেশে ওয়াইম্যাক্স একটি বড় ধাক্কা খায়। এই চ্যালেঞ্জ আর কাটিয়ে ওঠা তাদের পক্ষে কখনই সম্ভব হয়নি।