শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রাজনীতির আবর্তে বিশ্বব্যাপী ভ্যাকসিন কার্যক্রম

যাযাদি ডেস্ক
  ১৪ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০
টিকা পেতে মরিয়া

সম্প্রতি করোনা মহামারির এক বছর পূর্ণ হয়েছে আর এ সময়ের মধ্যে লাখ লাখ মানুষ প্রাণঘাতী এ ভাইরাসে প্রাণ হারিয়েছে। সারাবিশ্বে এতদিন ধরে তান্ডব চালিয়েও ক্ষান্ত হচ্ছে না করোনা। প্রতিদিনই বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতু্যর সংখ্যা। করোনা যখন বিশ্বজুড়ে দাপট দেখানো শুরু করেছে তখন থেকেই আর বসে থাকতে পারেননি বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞরা। কীভাবে এ ভাইরাস থেকে মানবজাতিকে রক্ষা করা যায়, সেটাই ছিল একমাত্র লক্ষ্য। আর এ নিয়ে দিন-রাত পরিশ্রম করে তারা সফলও হয়েছেন। এরই মধ্যে বেশকিছু সফল ভ্যাকসিন মানুষের হাতে এসে পৌঁছেছে। সংবাদসূত্র : ডিডবিস্নউ নিউজ

কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এরই মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে টিকাদান কর্মসূচিও শুরু হয়েছে, যা নিঃসন্দেহে এক মহৎ উদ্যোগ। এছাড়া অনেক দেশই ভ্যাকসিন নিয়ে রাজনীতি শুরু করেছে। কেউ কেউ এটি থেকে সুবিধা পাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। ভ্যাকসিন জোগাড়ের জন্য বিভিন্ন দেশ যেন মরিয়া হয়ে উঠেছে। ভ্যাকসিন উন্নয়নে মূলত ধনী দেশগুলোই এগিয়ে আছে।

অনেক ধনী দেশ এরই মধ্যে ভ্যাকসিন কিনতে অগ্রীম চুক্তি করে ফেলেছে। ফলে বিপাকে পড়ছে দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলো। ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত এক নিবন্ধের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডবিস্নউএইচও) সদস্য ১৯৪টি দেশে করোনার দুটি টিকার জন্য ১৫০০ কোটিরও বেশি ডোজের প্রয়োজন হবে।

ওই নিবন্ধে উলেস্নখ করা হয়েছে যে, করোনার ২৭৩টি ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা

চললেও মোট ১২টি ভ্যাকসিন গবেষণার তৃতীয় ধাপ পার করেছে। এদের মধ্যে কয়েকটি ভ্যাকসিনের ৭০ শতাংশ থেকে ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত কার্যকারিতা লক্ষ্য করা গেছে। এর মধ্যে ছয়টি ভ্যাকসিনকে বিভিন্ন দেশের সরকার জনগণের ওপর ব্যবহারের জন্য অনুমতি দিয়েছে।

এগুলো হলো- ফাইজার-বায়োএনটেক কোম্পানির তৈরি টোজিনামেরান, মডার্না কোম্পানির এমআরএনএ-১২৭৩, চীনা কোম্পানি সিনোফার্ম ও সিনোভ্যাকের দুটি ভ্যাকসিন, রুশ কোম্পানি গামালেয়া রিসার্চ ইন্সটিটিউটের তৈরি একটি এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়-অ্যাস্ট্রেজেনেকার তৈরি একটি ভ্যাকসিন।

আর এসব ভ্যাকসিন হাতে পাওয়ার জন্য ধনী দেশগুলো অনেক আগে থেকেই আগাম বুকিং দিয়ে রেখেছে। চরম স্বাস্থ্য সংকটের মুখে দরিদ্র দেশগুলোও চেষ্টা করছে যত দ্রম্নত সম্ভব এই ভ্যাকসিন সংগ্রহ করতে। আর এখানেই সুযোগ তৈরি হয়েছে প্রভাব বিস্তারের। তবে এত কিছুর পরও অনেক দেশই বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দেওয়ার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এছাড়া ভ্যাকসিন উৎপাদন, সরবাহ এবং তা লোকজনের কাছে পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত যেসব কাজ তা বেশ পরিশ্রম সাধ্য। এর সঙ্গে জড়িত লোকজন মানব কল্যাণে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। এটা খুব সহজ কোনো কাজ নয়।

এখন পর্যন্ত করোনা সংক্রমণে শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এরপরেই রয়েছে ভারত ও ব্রাজিল। করোনা সংক্রমণ সংক্রমণ যেভাবে বাড়ছে তাতে ব্রাজিলের দ্রম্নত গতিতে তাদের দেশে করোনা ভ্যাকসিন কর্মসূচি শুরু করা উচিত। এরই মধ্যে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায় ভ্যাকসিন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ভারতেও খুব দ্রম্নতই ভ্যাকসিন কর্মসূচি শুরু হবে।

ব্রাজিলের ভ্যাকসিন তৈরির প্রতিষ্ঠান সাও পাওলোর বুটানটান এবং ফেওক্রুজের রিও ডে জেনেরিও চলমান টিকাদান কর্মসূচির ক্ষেত্রে অসাধারণ সহযোগিতা করে যাচ্ছে। সাও পাওলোর মাইক্রোবায়োলজিস্ট নাতালিয়া পাস্তারনাক বলেন, যদি কর্তৃপক্ষ সঠিকভাবে করোনা ভ্যাকসিনের দিকে মনোযোগী হতো তবে তারা নিজেরাই হয়তো ভ্যাকসিন তৈরিতে সক্ষম হতো।

রাজনীতির কারণে করোনা মহামারিতে সবচেয়ে বেশি ভুগতে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রাজিলকে। দুটি দেশের ক্ষেত্রে একই চিত্র দেখা গেছে। এই দুই দেশের রাষ্ট্রপ্রধান প্রথম থেকেই করোনা মহামারিতে তেমন একটা পাত্তা দেননি। আর তার ফল ভোগ করতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। তবে বিদায়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দেশে ভ্যাকসিন দ্রম্নত আনার তোড়জোর করলেও ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট বোলসোনারো প্রথম থেকেই ভ্যাকসিন নিয়ে নেতিবাচক তথ্য প্রচার করেছেন। অন্যদিকে, ভারত বলছে প্রথম দফায় তারা বিনামূল্যেই ভ্যাকসিন দেবে।

একক বাজার ধরে রাখার ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। এর পরই যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান। মার্কিন সরকার এরই মধ্যে শত শত কোটি ডলার ব্যয় করেছে ভ্যাকসিন কেনার জন্য। মার্কিন সরকারের অপারেশন ওয়ার্প স্পিডের আওতায় ৩শ কোটি ডলার ব্যয়ে ভ্যাকসিন কেনার জন্য ছয়টি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ও মানব সেবামন্ত্রী অ্যালেক্স অ্যাজার বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র যে ভ্যাকসিন পাবে সেটা আগে দেশের জনগণের জন্য ব্যবহার করা হবে। তারপরই অন্যদেশে ভ্যাকসিন পাঠানোর কথা বিবেচনা করা হবে।

কিন্তু কোন দেশ মার্কিন ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির কাছ থেকে ভ্যাকসিন কিনে নিতে চাইলে ট্রাম্প প্রশাসনের কোনো আপত্তি নেই বলে তিনি জানিয়েছেন। তবে জো বাইডেনের নেতৃত্বাধীন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সরকার অন্য দেশের সঙ্গে ভ্যাকসিন শেয়ার করার প্রশ্নে কী অবস্থান নেবেন তা এখনো পরিষ্কার না।

অন্যদিকে, অপর দুই পরাশক্তির দেশ চীন এবং রাশিয়া নিজেদের তৈরি ভ্যাকসিনের ওপরই নির্ভরশীল। ভ্যাকসিন সরবরাহের প্রশ্নে অস্পষ্ট মার্কিন অবস্থান রাশিয়ার জন্য তৈরি করেছে ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের এক নতুন সুযোগ। মস্কোর সরকার ঘোষণা করেছে, ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ ২০টি দেশ তাদের তৈরি স্পুটনিক-ভি ভ্যাকসিনের আগাম চালান চেয়েছে।

রুশ সরকারের বিনিয়োগ সংস্থা, রাশান ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড, স্পুটনিক-ভি ভ্যাকসিনের শত শত কোটি ডোজ বিক্রির জন্য এশিয়া, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ডজন খানেক চুক্তি করেছে।

ভ্যাকসিন কূটনীতির ক্ষেত্রে রাশিয়া তার সোভিয়েত আমলের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাচ্ছে বলে ওই প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে। ১৯৬০'র দশকে সোভিয়েত রাশিয়া স্মলপক্স বা গুটি বসন্তের টিকা বহন করার জন্য 'ফ্রিজ-ড্রায়েড' পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিল।

ওই প্রযুক্তি ব্যবহার করে সোভিয়েত রাশিয়া সে সময় ৪৫ কোটি গুটি বসন্ত ভ্যাকসিনের ডোজ বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশে পাঠিয়েছিল। মূলত গুটি বসন্তের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নকে এক জায়গায় আনতে পেরেছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এর ফলে ১৯৮০'র দশকে রোগ সম্পূর্ণ নির্মূল হয়ে যায়।

এবার স্পুটনিক-ভি নিয়ে রাশিয়ার ভ্যাকসিন কূটনীতির লক্ষ্য তিনটি- বাণিজ্যিক, রাজনৈতিক ও মানবিক। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যটা বেশ সরল বলছেন গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর গেস্নাবাল ডেভেলপমেন্টের ক্যালিপসো চোকিডো। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলো যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোভ্যাক্স কর্মসূচির মাধ্যমে তাদের জনগণের পুরো অংশের জন্য ভ্যাকসিন পেতে ব্যর্থ হবে তা পরিষ্কার। তাই তারা দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে ভ্যাকসিনের ডোজ সংগ্রহ করতে চাইবে। আর এখানেই রাশিয়া আর্থিকভাবে মুনাফা করতে চাইবে। কারণ আগামী বছরও কোটি কোটি ডোজ ভ্যাকসিনের যথেষ্ট চাহিদা থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে।

অন্যদিকে, স্বল্পমূল্যে কার্যকর ভ্যাকসিন সরবরাহের মধ্য দিয়ে রাশিয়া আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গত এক দশকে তার স্থবির অবস্থানকে কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গবেষকরা। আর নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে পাঠানো রুশ টিকা মানুষের জীবন রক্ষায় সহায়তা করবে যা এক কথায় মহৎ একটি উদ্যোগ।

এই মহামারির সূত্রপাত চীন থেকে হয়েছে। মহামারির শুরুর দিকে যে দুর্নাম রটেছিল, বেইজিং সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতায় তা অনেকখানিই কমে গেছে। সাংহাই গবেষণাগারের চীনা বিজ্ঞানীরা সরকারের প্রায় বিনা অনুমতিতেই কোভিড-১৯ এর জিন সিকোয়েন্স বিশ্বের কাছে প্রকাশ করেছে।

এরপর বিশ্বব্যাপী সাপস্নাই চেইন ব্যবহার করে চীন নানা দেশে পিপিই সরঞ্জাম পাঠিয়েছে, যদিও এসবের গুনগত মান নিয়ে শুরুর দিকে অনেক প্রশ্ন উঠেছিল। কিন্তু মহামারি ছড়িয়ে পড়ার জটিল সময়ে বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সেবার সঙ্গে জড়িতদের সেগুলো খুবই কাজে লেগেছে।

ভ্যাকসিন গবেষণায় অগ্রগতির পথ ধরে চীনা কূটনীতিতে এক নতুন পর্যায় শুরু হয়েছে। যেমন, সিনোভ্যাক ইন্দোনেশিয়ার সরকারের সঙ্গে 'প্রায়োরিটি অ্যাক্সেস' চুক্তি করেছে যার আওতায় এক কোটি ২০ লাখ ডোজ টিকা এরই মধ্যে সে দেশে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে এবং জানুয়ারি শেষ হওয়ার আগেই আরও এক কোটি আট লাখ ডোজ সরবরাহের কথা রয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে