শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

করোনার ভ্যাকসিন নিয়ে জনমনে স্বস্তি, উদ্বেগও কম নয়

জাহিদ হাসান
  ১৪ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০

প্রাণঘাতী করোনার টিকাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে নানা নিশ্চয়তা-অনিয়শ্চতার প্রশ্ন উঠলেও অবশেষে আগামী মাসের শুরুতেই দেশে ভাইরাসটির টিকা প্রয়োগ শুরু হচ্ছে। এ লক্ষ্যে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ টিকা ব্যবস্থাপনায় প্রশিক্ষণ নির্দেশিকা তৈরি, টিকার নিবন্ধন কার্ড চূড়ান্তসহ প্রচার-প্রচারণার কাজও প্রায় শেষ করেছে। উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে সমসমায়িক সময়ে টিকা জোগাড়ের এই অগ্রগতিতে দেশের মানুষের মধ্যেও এক ধরনের স্বস্তি বিরাজ করছে। তবে টিকা সংগ্রহের ক্রয় পদ্ধতি, অগ্রাধিকার অনুযায়ী প্রাপ্যতা, প্রয়োগ-পরবর্তী পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে প্রি-ট্রায়াল না হওয়ায় জনসাধারণ ও অভিজ্ঞমহলের এক ধরনের উদ্বেগও দেখা গেছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের মানুষকে টিকা প্রদানের আশ্বাসের প্রেক্ষিতে সরকার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তা সরবরাহ করবে। এজন্য প্রথম পর্যায়ে ভারতে সিরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত ৫০ লাখ কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন আনার পর যথাযথভাবে সংরক্ষণ ও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিতরণে জোর প্রস্তুতিতে কাজ করছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা যায়যায়দিনকে

\হবলেন, প্রস্তুতির অংশ হিসেবে গতকাল বুধবার থেকে সংশ্লিষ্ট প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী কোভিড-১৯ টিকা প্রয়োগ মাঠপর্যায়ে কাজের গতি আনতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ দেবেন। এ জন্য নির্দেশিকাও চূড়ান্ত হয়েছে। চলতি জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীদেরও এই প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এছাড়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাঠকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।

এদিকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ 'টিআইবি'র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, করোনা থেকে সুরক্ষা পেতে কার্যকর টিকার সংখ্যা এখন পর্যন্ত খুবই কম। উৎপাদন ও সরবরাহ সীমাবদ্ধতা থাকায় প্রাপ্তি নিয়ে শুরু থেকেই এক ধরনের প্রতিযোগিতা লক্ষণীয় ছিল। এমন বাস্তবতার মাঝেও সরকার অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রোজেনেকার উদ্ভাবিত টিকা দ্রম্নত সংগ্রহের উদ্যোগ প্রশংসা পওয়ার যোগ্য। তবে টিকা সংক্রান্ত বাণিজ্যিক চুক্তি এবং এই উৎস থেকে সময়মতো প্রাপ্তির সম্ভাবনা বিতর্ক এড়াতে পারেনি। এছাড়া সরকারি মূল্যায়ন অনুযায়ী সেরামের টিকার বাইরে ফাইজারের টিকা সংরক্ষণে জটিলতা রয়েছে। কারণ এটি ব্যবহারে ৬৪ জেলার ৫৬টিতেই মানসম্পন্ন বিশেষ শীতলীকরণ ব্যবস্থা নতুন করে তৈরি করতে হবে। টিকাটির প্রয়োগে বিশেষ সিরিঞ্জের প্রাপ্তির চ্যালেঞ্জ রয়েছে, ফলে ওই টিকার তুলনামূলক দরের বিষয়টি কতটা বিবেচনা করা হয়েছে, তা পরিষ্কার করা প্রয়োজন।

বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, পর্যাপ্ত টিকা প্রাপ্তিসাপেক্ষে সরকার বিনামূল্যে জনসংখ্যার ৮০ ভাগ মানুষকে তা দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। কিন্তু এটির দ্রম্নত প্রাপ্যতার ব্যাপারে অনেকের মধ্যে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন শাখার একাধিক কর্মকর্তা যায়যায়দিনকে বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কার্যক্রম ছাড়াও ফেব্রম্নয়ারির শুরুতে দেশে করোনা ভ্যাকসিন প্রয়োগ ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠুভাবে নিশ্চিত করতে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম গঠন করা হয়েছে। 'ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম-২০২১' নামে এই টিমের সদস্য করা হয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের কর্মকর্তাদের। টিমের কার্যাবলি সম্পর্কে সংশ্লিষ্টরা জানান সদস্যদের তত্ত্বাবধানে করোনা ভ্যাকসিন সংক্রান্ত দেশ-বিদেশের সব তথ্যের হালনাগাদ পরিসংখ্যান সংগ্রহের পাশাপাশি করোনা সংক্রান্ত তথ্য সংরক্ষণ করা হবে। সঙ্গে যোগাযোগ সমন্বয়ের কাজটিও করবে তারা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমএনসিঅ্যান্ডএএইচ অপারেশনাল প্যানের লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. শামসুল হক বলেন, আগামী ২৭ জানুয়ারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে টিকা পৌঁছবে। ইতিমধ্যে করোনার টিকাগ্রহীতাদের নিবন্ধনের জন্য একটি অ্যাপ তৈরির কাজ শেষের দিকে। জনসাধারণকে টিকা দিতে আগামী ২৬ জানুয়ারি থেকে নিবন্ধন শুরু হবে। তবে টিকা পাওয়ার পর কয়েকটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ও স্বেচ্ছাসেবকদের দেওয়া হবে। এক সপ্তাহ পর অর্থাৎ ফেব্রম্নয়ারির প্রথম সপ্তাহে মাঠ পর্যায়ের টিকা দেওয়া শুরু হবে। টিকা রাখার জন্য সব জেলায় আইস লাইনার রেফ্রিজারেটর (আইএলআর) ব্যবস্থা রয়েছে। এ ছাড়া টিকা সংরক্ষণে ২৯টি জেলায় ওয়াক ইন কুল (ডবিস্নউআইসি) অর্থাৎ এক ধরনের শীতল কক্ষ ব্যবস্থাও রয়েছে। আরও ১৮টি জেলায় ডবিস্নউআইসি স্থাপনের কাজ চলছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক জনস্বাস্থ্যবিদ বে-নজির আহমেদ বলেন, দেশের মানুষকে টিকা দেওয়ার পূর্বে একটা ট্রায়াল দেওয়া জরুরি। এতে টিকার কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যাবে। ফলে কোনো এলাকায় পরীক্ষামূলক টিকা প্রয়োগ বাস্তবায়ন করা দরকার। এটি করতে পারলে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ দূর হবে। পাশাপাশি টিকা সংরক্ষণ যেন সঠিক তাপমাত্রায় হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া টিকাদান শুরুর আগে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা দরকার। যেন মানুষ স্পষ্টভাবে জানতে পারে দেশব্যাপী কী হতে যাচ্ছে।

এদিকে দেশে বেশি দামে করোনার টিকা ক্রয়কে লুটপাট উৎসবের প্রস্তুতি আখ্যায়িত করে বুধবার বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ সভায় অভিযোগ করেন সেরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে ভারত সরকার প্রতি ডোজ করোনার টিকা কিনছে ২০০ রুপি বা ২ দশমিক ৭২ ডলার দরে। বাংলাদেশি মুদ্রায় এটি ২৩১ টাকার মতো। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়, কোভিশিল্ডের প্রতি ডোজ টিকা কিনতে বাংলাদেশকে ৪ মার্কিন ডলার খরচ করতে হচ্ছে। বাংলাদেশি টাকায় এর দাম পড়ে প্রায় ৩৪০ টাকা, এই হিসাবে বাংলাদেশকে টিকার প্রতি ডোজ কিনতে ভারতের চেয়ে প্রায় ৪৭ শতাংশ বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে।

টিকার প্রয়োগ ও প্রাপ্তিতে বৈশ্বিক বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ

টিকার প্রয়োগ ও প্রাপ্তিতে বৈশ্বিক বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ সম্পর্কে গত সোমবার রয়টার্স নেক্সট কনফারেন্সে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আউটব্রেক অ্যালার্ট অ্যান্ড রেসপন্স নেটওয়ার্কের চেয়ারম্যান ডেল ফিশার বলেন, 'আমরা আগের স্বাভাবিক জীবনে সহসাই ফিরে যেতে পারছি না। এখন পর্যন্ত টিকা বিতরণ পরিস্থিতির যে হালনাগাদ তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে এর চেয়ে ভালো কিছু আর আশা করা যায় না। কারণ করোনাভাইরাস ভবিষ্যতে নিজেকে কতটা বদলে ফেলতে পারে, সে বিষয়টি এখনো মানুষের অজানা। তাছাড়া ভাইরাসটির অনেক বেশি মিউটেশন হলে এখনকার টিকা আর কার্যকর নাও হতে পারে।

একইভাবে ইউনিভার্সিটি অফ ইন্দোনেশিয়ার এপিডেমিওলজিস্ট পান্ডু রিওনো বলছেন, মহামারি সামাল দিতে টিকাই যথেষ্ট নয়। এ জন্য পরীক্ষা, প্রচার, সুরক্ষা বিধি মেনে চলতে মানুষকে সচেতন হওয়া জরুরি। কারণ যাদের দরকার তাদের সবার কাছে টিকা পৌঁছাতেও বেশ কিছুটা সময় লেগে যাবে। তিনি বলেন, টিকার ওপর কিছু দেশের সরকারের মাত্রাতিরিক্ত আস্থা বিপদ ডেকে আনতে পারে। তাতে শিগগিরই হার্ড ইমিউনিটিতে পৌঁছানো সম্ভব নাও হতে পারে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে