শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

কাদের মির্জার তোপে ছয় নেতা 'প্রশ্নবিদ্ধ'

ফয়সাল খান
  ১৪ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই আব্দুল কাদের মির্জা। যিনি দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সদ্য-সাবেক কমিটির সহ-সভাপতি ছিলেন। জেলার বসুরহাট পৌরসভায় টানা তিন মেয়াদে মেয়রের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। আগামী শনিবার অনুষ্ঠেয় বসুরহাট পৌরসভা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী তিনি। নিজের ভাইসহ আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা ও এমপি-মন্ত্রীদের সমালোচনা করে আলোচনায় এসেছেন তিনি।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, কিছুদিন আগে ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত হয়ে মারাত্মক অসুস্থ ছিলেন আব্দুল কাদের মির্জা। এরপর আমেরিকার একটি হাসপাতাল থেকে উন্নত চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে ফিরে আসেন। অসুস্থ থাকার সময় 'রাজনীতিতে শুদ্ধতা' ফিরিয়ে আনতে কাজ করবেন বলে বিভিন্ন বক্তব্যে তিনি উলেস্নখ করেছেন। যতদিন বাঁচবেন 'অসততার বিরুদ্ধে' কথা বলবেন বলেও প্রতিজ্ঞা করেছেন তিনি। এরই ধারাবাহিকতায় সরকারের শীর্ষ ব্যক্তি, রাজনৈতিক নেতা ও আমলাদের সমালোচনা করছেন।

এরই মধ্যে আব্দুল কাদের মির্জার সমালোচনার তোপে পড়েছেন তার ভাই ওবায়দুল কাদের, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা মাহবুব-উল আলম হানিফ, ফেনীর নিজাম হাজারী এমপি, নোয়াখালীর এমপি একরামুল করিম চৌধুরী, সন্দ্বীপের এমপি মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী, স্থানীয় ডিসি-এসপি থেকে শুরু করে তার সমালোচনার তোপ থেকে বাদ যাননি নির্বাচন কমিশনারও। নির্বাচন কমিশনার শাহাদাত হোসেনের সমালোচনা করেও বক্তব্য দিয়েছেন তিনি। এর প্রেক্ষিতে ওবায়দুল কাদেরসহ কেন্দ্রীয় নেতারাও বক্তব্য দেন। কিন্তু কোনো কিছুতেই দমানো যাচ্ছে না কাদের মির্জাকে। নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করবেন বলে জানান তিনি।

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে নিয়ে আব্দুল কাদের মির্জা বলেছেন, 'তার (ওবায়দুল কাদের) ওপরও আমার ক্ষোভ আছে। এখানে জিততে হলে তার আমাদের লাগবে। সামনে জিততে হলে ওনাকেও সতর্ক হতে হবে। এত সহজ নয়, কঠিন ব্যাপার। বউ-টউ (স্ত্রী)

সামলাতে হবে। আর ওনার সঙ্গে যারা হাঁটেন, তারা কার থেকে মাসোহারা পান, তার খোঁজখবর নিতে হবে।'

তিনি আরও বলেন, 'আমি ফেয়ার নির্বাচন চাই। এলাকায় শান্তি চাই। যদি কেউ যড়যন্ত্র করে, নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, কোনো মায়ের বুক খালি করলে এর সব দায়-দায়িত্ব ওবায়দুল কাদের সাহেবকে নিতে হবে। কারণ, তিনি এই এলাকার এমপি। এ ছাড়া নির্বাচন কমিশনার শাহাদাত, ডিসি-এসপি, জেলা নির্বাচন অফিসার অভিযুক্ত হবেন। এ জন্য সব দায়-দায়িত্ব নিতে হবে। আমি আলস্নাহ ছাড়া কাউকে ভয় পাই না। ওবায়দুল কাদেরকেও ভয় পাই না। আমি নির্বাচনে হেরে গেলেও জনগণের সঙ্গে থাকব। ধমকায় গুলি করবে, ঝাঁজরা করে দিবে। কিন্তু আমি এসবকে ভয় পাই না। আমি দল থেকে বহিষ্কার করে দেওয়া হলেও আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতি ছেড়ে যাব না। আমাকে বহিষ্কার করলেও আমি বলব বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা ও ওবায়দুল কাদের। কেউ আমাকে বাধা দিতে পারবে না।'

মির্জা কাদের বলেন, 'আমায় একটা জায়গায় নিয়ে ঠেকায়, সেটা হলো- ওবায়দুল কাদের সাহেব অসুস্থ, আমি মরে যাব। এটা বললে আমি দুর্বল হয়ে যাই। আমি অসুস্থ, আমি মরে যাব। এটা বললে আমি দুর্বল হয়ে যাই। এরপরও ওনার বোঝা উচিত, উনি জাতীয় নেতা। আলস্নাহ ওনাকে সম্মান দিয়েছে, আওয়ামী লীগের দুইবারের সাধারণ সম্পাদক। ওনার বোঝা উচিত।'

ফেনীর এমপি নিজাম হাজারীকে নিয়ে কাদের মির্জা বলেন, 'আমার বিরুদ্ধে, ভোটের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। আমি নির্বাচনকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অংশ হিসেবে নিয়েছি। তাই তারা একরাম চৌধুরী, ফেনীতে নিজাম হাজারী, নোয়াখালীর ডিসি-এসপি, জেলা নির্বাচন অফিসার নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে।'

তিনি বলেন, 'আমি যখন অন্যায়ের বিষয়ে কথা বলি, প্রতিবাদ করি; টেন্ডারবাজি, চাকরি বাণিজ্যের বিরুদ্ধে কথা বলি এবং যখন বলি; নিজাম হাজারীর নেতৃত্বে উপজেলা চেয়ারম্যান একরামকে গুলি করে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। তখন আমাকে বলে পাগল, উন্মাদ। আমরা ওবায়দুল কাদের সাহেবের বাসায় যেতে পারি না অথচ নিজাম হাজারীকে নিয়ে দোতলায় নিয়ে ভাত খাওয়ায়। এ কথা বললে আমাদের নেতার মনে কষ্ট পায়।'

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফকে উদ্দেশ্য আব্দুল কাদের মির্জা বলেছেন, 'কুষ্টিয়ায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙা হয়েছে। আপনি দায়িত্বশীল লোক? এগুলো বন্ধ করেন। কী করবেন, জেলে নেবেন? বহিষ্কার করবেন? মেরে ফেলবেন? আমি বলব। আমি বলেছি, নোয়াখালী, ফেনীর অপরাজনীতির কথা। আপনারা কেন নিজেদের গায়ের ওপর নিচ্ছেন? আজকে আমি মনে করি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অসহায়। কেন অসহায়? শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আজকে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র চলছে।'

নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও নোয়াখালী চার আসনের সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরীর সম্পর্কে তিনি বলেন, 'একরামুল করিম চৌধুরীর সঙ্গে নোয়াখালী পৌরসভার সাবেক বিএনপি সমর্থিত মেয়র হারুনুর রশীদ আজাদের সম্পর্ক ভালো। একরাম চৌধুরী ভোট বানচাল ও আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার জন্য বিএনপির সেই মেয়রকে টাকা দিয়ে কোম্পানীগঞ্জ পাঠিয়েছেন। একরাম চৌধুরী নির্বাচনী কর্মকান্ডে আসলে, হয় সকাল কিংবা সন্ধ্যায় আসবেন। সন্ধ্যায় এসে তার কাজ কী?'

'আমি শেখ হাসিনা ও প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদের কথা বলেছি, বলব। তারা ভালো মানুষ। ভোট ও আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে। যাতে আমাদের দলের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। এখানকার ২-৩ জন জনপ্রতিনিধি একরাম চৌধুরীর সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন।'

চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের এমপি মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী সম্পর্কে কাদের মির্জা বলেন, 'আমি যখন নোয়াখালীর অপরাজনীতি, ফেনীর অপরাজনীতি এবং সন্দ্বীপের এমপি, যে আমার এলাকার হাজার হাজার একর জমি দখল করে রেখেছে, তাদের কথা যখন বলি, যখন প্রশাসনের অনিয়মের কথা বলি, যখন ভোট ডাকাতির বিরুদ্ধে কথা বলি, তখন আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র আজকে জাতীয় পর্যায় থেকে।'

সিপিবি নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্সকে উদ্দেশ্য করে আব্দুল কাদের মির্জা বলেন, 'ঢাকা ইউনিভার্সিটির নুরা পাগলার সঙ্গে আপনারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক তার সঙ্গে বের হয়ে মুক্তিযোদ্ধার কোটার বিরোধিতা করেছেন, আহারে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি! আহারে বাম দল! এটা কি আপনাদের রাজনীতি! ঠাকুর ঘরে কে রে আমি কলা খাই না। বক্তৃতা দেন। আপনারা হলেন সাইনবোর্ডসর্বস্ব দল।'

এ ছাড়া অনেক নেতার নাম উলেস্নখ না করে বিভিন্ন সমালোচনা করেন তিনি। আওয়ামী লীগের এক কেন্দ্রীয় নেতার উদ্দেশ্যে কাদের মির্জা বলেন, 'কষ্ট লাগে, কেন্দ্রীয় নেতা, আমরা ছোটখাট কর্মী, গ্রামের। প্রেসিডিয়াম সদস্য। যে আসনে তিনি ভোট করেন, সেখানে ৯৯ ভাগ আওয়ামী লীগ। সেখানে এমপি হয়েছেন। আগে মন্ত্রী ছিলেন, এখন নেই। উনি ভালো মানুষ। এ জন্য মন্ত্রী হননি। আমি আর কিছু বললাম না। বললে এখন বিপদ।'

প্রশাসনের অসযোগিতার অভিযোগ তুলে কাদের মির্জা বলেন, 'যুব মহিলা লীগের এক মহিলা অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেছে। প্রশাসনকে জানিয়েছি, তারা মোবাইল ট্র্যাকিং দিয়ে সব তথ্য পেয়েছে, কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। তথ্য সব পাওয়ার পরও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। তাহলে এই মহিলার হাতটা অনেক শক্তিশালী। না হলে ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি কেন?'

সুষ্ঠু নির্বাচন হলে এমপিরা পালানোর জায়গা পাবে না : কাদের মির্জা বলেন, 'বৃহত্তর নোয়াখালীতে আওয়ামী লীগের কিছু কিছু চামচা নেতা আছেন, যারা বলেন, অমুক নেতা তমুক নেতার নেতৃত্বে বিএনপির দুর্গ ভেঙেছে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বৃহত্তর নোয়াখালীতে তিন-চারটা আসন ছাড়া বাকি আসনে আমাদের এমপিরা পালানোর দরজা খুঁজে পাবে না।'

আঞ্চলিক ভাষায় তিনি বলেন, 'নোয়াখালীর মানুষজন বলে, শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা বেড়েছে। এটা সত্য। কিন্তু আপনাদের জনপ্রিয়তা বাড়েনি। আপনারা প্রতিদিন ভোট কমান। টাকা দিয়ে বড় রড় জনসভা করা, মিছিল করা কোনো ব্যাপার নয়। টাকা দিলে, গাড়ি দিলে আমিও অনেক লোক জড়ো করতে পারব। না হয় রাজনীতি থেকে বিদায় নেব।'

কারও নাম উলেস্নখ না করে আব্দুল কাদের বলেন, 'প্রকাশ্যে দিবালোকে পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করেন, তারা হচ্ছেন নেতা। টেন্ডারবাজি করে কোটি কোটি টাকা লুটপাট যারা করেন, তারা হচ্ছেন নেতা। পুলিশের, প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি দিয়ে যারা পাঁচ লাখ টাকা নেন, তারা হচ্ছেন নেতা। গরিব পিয়নের চাকরি দিয়ে তিন লাখ টাকা যারা নেন, তারা হচ্ছেন নেতা।'

একজন উপজেলা চেয়ারম্যানের সমালোচনা করে কাদের মির্জা বলেন, 'এই উপজেলা চেয়ারম্যান ক্ষমতায় থাকাকালে সরকারি বাসায় নারী, জুয়া চলত। চর বালুয়ায় হাজার হাজার একর জমি দখল করেছে। মাদকের ব্যবসা করে। কোম্পানীগঞ্জের বড় কাজগুলো নোয়াখালীর নেতারা দিচ্ছে, সে করেছে। আরেকজন আছে আমার ভাগনে রাহাত, আমাদের রক্তের নয়। সে বদির সঙ্গেও দেখা করেছে। সে সরকারি জায়গা দখল করে ভবন করেছে। আমি সেনাবাহিনী নিয়ে ভাঙতে গেছি, সে আমার দিকে চোখ রাঙিয়েছে, কারণ; তার কাছে অস্ত্র আছে।'

আব্দুল কাদের মির্জা বলেন, 'নোয়াখালীর রাজনীতি অতি কষ্টের। এই বৃহত্তর নোয়াখালীতে আমাদের নেতা ওবায়দুল কাদের, মওদুদ সাহেব (বিএনপির মওদুদ আহমদ), আবু নাছের সাহেব (জামায়াতের) এই তিনজন ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ, তাদের সমমর্যাদার কেউ নেই। কোনো নেতা সৃষ্টি হয়নি। এখন তো ওবায়দুল কাদের, মওদুদ আহমদের নাম বিক্রি করি। তারা তিনজন তো অসুস্থ, তারা মারা গেলে কার নাম বিক্রি করবে, কেউ নাই।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে