বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
সপ্তাহে লাখো মৃতু্যর শঙ্কা

ভ্যাকসিন নিয়ে নৈতিক ব্যর্থতার মুখে বিশ্ব :ডবিস্নউএইচও

যাযাদি ডেস্ক
  ২০ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০

করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন নিয়ে অসম নীতির কারণে বিশ্ব একটি 'বিপর্যয়কর নৈতিক ব্যর্থতার' মুখে রয়েছে বলে সতর্ক করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডবিস্নউএইচও)। সংস্থাটির মহাসচিব টেড্রোস আধানম গেব্রেইয়েসাস সোমবার এক বিবৃতিতে এই সতর্কতার কথা উচ্চারণ করেন। সংবাদসূত্র : রয়টার্স, এএফপি

জেনেভায় ডবিস্নউএইচওর নির্বাহী বোর্ডের একটি বৈঠকে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন গেব্রেইয়েসাস। এ সময় তিনি বলেন, 'বিশ্বের ৪৯টি ধনী দেশে এরই মধ্যে ৩৯ মিলিয়ন, অর্থাৎ তিন কোটি ৯০ লাখ ডোজের বেশি করোনার টিকা দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, একটি গরিব দেশে মাত্র ২৫ ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। ২৫ মিলিয়ন নয়, ২৫ হাজারও নয়, মাত্র ২৫টি।'

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাসচিব বলেন, 'করোনার ঝুঁকিতে থাকা গরিব দেশের নাগরিকদের আগে ধনী দেশগুলোর কম বয়সি ও স্বাস্থ্যবান লোকজনের টিকা পাওয়াটা মোটেই নৈতিক নয়।' তিনি বলেন, 'আমাকে রুঢ়ভাবে বলতে হচ্ছে, বিশ্ব এক বিপর্যয়কর নৈতিক ব্যর্থতার মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর এই ব্যর্থতার মূল্য বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোয় জীবন ও জীবিকা দিয়ে দিতে হবে।'

এ সময় ধনী দেশগুলোর 'আমিই প্রথম' দৃষ্টিভঙ্গির তীব্র সমালোচনা করেন গেব্রেইয়েসাস। তিনি বলেন, 'এই নীতি

আত্মঘাতী হবে। কারণ, এই নীতি টিকার দাম বাড়িয়ে দেবে। টিকার মজুতকে উৎসাহিত করবে।' ডবিস্নউএইচওর মহাসচিব বলেন, শেষ পর্যন্ত এসব কর্মকান্ড মহামারিকে কেবল দীর্ঘায়িতই করবে। এটি থামাতে বিধিনিষেধ দরকার।'

করোনার টিকা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোরও সমালোচনা করেন গেব্রেইয়েসাস। তার অভিযোগ, প্রতিষ্ঠানগুলো বৈশ্বিকভাবে ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে টিকার তথ্য ডবিস্নউএইচওকে না দিয়ে ধনী দেশগুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে দিচ্ছে।

বিশ্বজুড়ে করোনার টিকার ন্যায্য প্রাপ্তির অঙ্গীকার এখন গুরুতর ঝুঁকিতে পড়েছে বলে উলেস্নখ করেন ডবিস্নউএইচওর প্রধান। করোনার টিকা বণ্টনের বৈশ্বিক উদ্যোগ 'কোভ্যাক্সের' বিষয়ে পূর্ণ প্রতিশ্রম্নতির ডাক দেন তিনি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তত্ত্বাবধানে কোভ্যাক্স উদ্যোগের মাধ্যমে আগামী মাসে টিকার সরবরাহ শুরু হতে পারে। বিশ্বের ১৮০টির বেশি দেশ কোভ্যাক্স উদ্যোগে যুক্ত হয়েছে। কোভ্যাক্সের উদ্দেশ্য হলো, অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর জন্য চলতি বছরের মধ্যে ২০০ কোটি টিকার ডোজ নিশ্চিত করা।

যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জার্মানিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনার টিকা অনুমোদন পেয়েছে। পুরোদমে এসব দেশে টিকা দেওয়া হচ্ছে। এ অবস্থায় সংস্থাটি উদ্বেগের সঙ্গে বলছে, বিশ্বের নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলো এখনো করোনাভাইরাসের টিকা পায়নি। তারা ধারাবাহিকভাবে টিকার ন্যায্য বণ্টনের আহ্বান জানাচ্ছেন।

অন্যদিকে, বারবার সতর্ক করার পরও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার আর জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর ধীর এবং অদক্ষ সাড়া দানে করোনাভাইরাস সংকট কীভাবে একটি বৈশ্বিক ব্যর্থতার নজির হয়ে উঠেছে, সেই চিত্র এসেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডবিস্নউএইচও) এক প্রতিবেদনে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি প্যানেলের তৈরি করা অন্তর্র্বর্তীকালীন এই প্রতিবেদন দেখিয়েছে, ধারণার ভুল, পরিকল্পনার ত্রম্নটি এবং পদক্ষেপ নিতে বিলম্ব; এমনকি খোদ ডবিস্নউএইচওর ভুল পদক্ষেপ কীভাবে মহামারির বিস্তার ঠেকানোর চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়েছে, কেড়ে নিয়েছে ২০ লাখের বেশি মানুষের প্রাণ।

মহামারি মোকাবিলার প্রস্তুতি ও সাড়া দান বিষয়ে সংস্কারের লক্ষ্য নিয়ে গঠিত এই স্বাধীন প্যানেল তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, 'সামগ্রিকভাবে আমরা ব্যর্থ হয়েছি, মানুষের জন্য একটি সুরক্ষা বলয় তৈরি করার জন্য আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে চেষ্টা করতে পারিনি।'

অনেক দেশে পর্যাপ্ত সুরক্ষা সামগ্রী না পাওয়া এবং বড় পরিসরে 'কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং' (ব্যক্তিপর্যায়ে নজরদারি) করতে না পারার মতো ব্যর্থতাগুলো বছরজুড়ে চলা করোনাভাইরাসের মহামারির শুরুর দিকেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। প্যানেলের প্রতিবেদন বলছে, এই সংকট উত্তরণে নেতৃত্ব দেওয়ার, মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব যাদের ওপর ছিল, তারা বারবার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।

নিউজিল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হেলেন ক্লার্ক ও লাইবেরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট এলেন জনসন সারলিফের নেতৃত্বে গঠিত এই প্যানেল এখনো তাদের কাজ শেষ করেনি। তবে তাদের প্রাথমিক প্রতিবেদনের খসড়ায় এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, নতুন কোনো রোগের প্রাদুর্ভাবে সাড়া দেওয়ার কর্মপদ্ধতি নিয়ে বিশ্বকে নতুন করে ভাবতে হবে।

মহামারির সতর্কতা জারির ক্ষেত্রে শ্লথগতি ও অস্পষ্টতা, প্রস্তুতির বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে তৈরি করা পরিকল্পনা সময়মতো বাস্তবায়ন করতে না পারা, সাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক দেশের সরকারে সমন্বয়ের অভাব এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি- এ রকম একেকটি ব্যর্থতা কী করে আরেকটি ব্যর্থতা ডেকে এনেছে, সেই বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে এই খসড়ায়।

প্যানেল বলছে, জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলোও তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারেনি। ২০১৯ সালের শেষে চীন থেকে করোনাভাইরাস ছড়াতে শুরু করার পর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আন্তর্জাতিক জরুরি স্বাস্থ্য সতর্কতা জারি করার জন্য কেন ২০২০ সালের ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিল, সেটা বোধগম্য নয়। উলেস্নখ্য, চীনের বাইরে করোনাভাইরাসের প্রকোপ ১৩ গুণ বৃদ্ধি পাওয়ার প্রেক্ষাপটে গত ১১ মার্চ দুনিয়াজুড়ে মহামারি ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

কোনো একটি ভাইরাস যে মহামারির আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে, সেই সতর্কবার্তা দেওয়া হচ্ছিল বহু বছর ধরেই। সে রকম জরুরি পরিস্থিতির জন্য ডবিস্নউএইচওকে প্রস্তুত করতে বিভিন্ন রকম কমিটি, টাস্কফোর্স আর উচ্চপর্যায়ের প্যানেল কাজ করলেও কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসেনি। ফলে যখন কোভিড-১৯ এলো, তখন পুরো বিশ্ব সেই বিপদের সামনে উন্মুক্ত অবস্থায় ছিল বলে মনে করছে প্যানেল।

সপ্তাহে লাখো মানুষের মৃতু্যর শঙ্কা

এদিকে, করোনাভাইরাসে সপ্তাহে লাখো মানুষের মৃতু্যর আশঙ্কার কথা জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। খুব শিগগিরই এমন পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। সোমবার ডবিস্নউএইচওর জরুরি স্বাস্থ্য কর্মসূচির প্রধান মাইকেল রায়ান এমন আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কার্যনির্বাহী বোর্ডের ১৪৮তম অধিবেশনে দেওয়া বক্তব্যে মাইক রায়ান বলেন, 'নতুন করে ফের করোনার ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা শুরু হয়েছে। গত সপ্তাহেই দুনিয়াজুড়ে প্রায় ৫০ লাখ মানুষের শরীরে এই ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। একই সময় মৃতু্য হয়েছে ৯৩ হাজার মানুষের। খুব শিগগিরই সপ্তাহে মৃতের সংখ্যা এক লাখে পৌঁছে যেতে পারে।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে