শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান

দুই বছরে ১০ কোম্পানির উৎপাদন বন্ধ

বাজারে প্রতিষ্ঠানগুলো সুনাম ও বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকটে পড়েছে ষ করোনার প্রাদুর্ভাব, দুর্বল পরিচালনা পর্ষদ ও করপোরেট সুশাসনের অভাবে বন্ধ হচ্ছে একের পর এক প্রতিষ্ঠান
আহমেদ তোফায়েল
  ২০ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০

কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাব, দুর্বল পরিচালনা পর্ষদ এবং করপোরেট সুশাসনের অভাবে গত দুই বছরের পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত ১০ কোম্পানি তাদের উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে।

বাজারবিশ্লেষকরা বলেন, এভাবে একের পর এক তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়ায় বিনিয়োগকারী ও নিয়ন্ত্রকসংস্থাগুলো উদ্বিগ্ন। তারা বলেন, আকস্মিকভাবে উৎপাদন বন্ধের সিদ্ধান্তের ফলে বাজারে তাদের সুনাম নষ্ট হচ্ছে এবং বিনিয়োগকারীরা আস্থার সংকটে পড়েছেন।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্যানুসারে ২০২১ সালের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত ১০ প্রতিষ্ঠান তাদের কারখানা লে-অফ ও উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে।

বাজার বিশ্লেষকরা বলেন, দুর্বল আইপিও অনুমোদন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্বল তদারকি ও দুর্বল পরিচালনা পর্ষদের কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছে।

আজিজ পাইপস : চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি আজিজ পাইপ সাময়িকভাবে তাদের উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। কোম্পানিটি লোকসানে ছিল। প্রতিষ্ঠানটি ডিএসইসিকে জানিয়েছে, তাদের উৎপাদন বন্ধের কারণ হচ্ছে করোনাভাইরাস মহামারির জন্য সরবরাহকারীর কাছ থেকে সঠিকভাবে পিভিসি রেজিন (উৎপাদনের মূল কাঁচামাল) না পাওয়া এবং মজুত সংকট।

কোম্পানিটির কর্তৃপক্ষ বলছে, পিভিসি রেজিনের পরিস্থিতির উন্নতি হলে আবার উৎপাদন

শুরু করা হবে। ১৯৮৬ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া আজিজ পাইপস সর্বশেষ ২০২০ সালের ৩০ জুন সমাপ্ত অর্থবছরে বিনিয়োগকারীদের ১ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে। কোম্পানিটি চলমান হিসাব বছরের প্রথম প্রান্তিকে (২০২০ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর) লোকসানের খাতায় নাম লিখিয়েছে। এই প্রান্তিকে কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি লোকসান করেছে ৭ পয়সা। আগের বছরের একই সময়ে শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয় ২২ পয়সা।

শ্যামপুর সুগার মিলস : ২ ডিসেম্বর শিল্প মন্ত্রণালয়ের এক নির্দেশে চলতি ২০২০-২১ হিসাব বছরের জন্য আখ মাড়াইয়ের মাধ্যমে চিনি উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয় শ্যামপুর সুগার মিল। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এ কোম্পানি ৩০ জুন সমাপ্ত ২০২০ হিসাব বছরের জন্য শেয়ারহোল্ডারদের কোনো লভ্যাংশের সুপারিশ করেনি। আলোচ্য সময়ে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ১২১ টাকা ৩৮ পয়সা, আগের হিসাব বছরে যা ছিল ১২৬ কোটি ২৯ লাখ টাকা।

অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ : গ্যাস লাইনের সমস্যার কারণে দীর্ঘদিন ধরে লোকসানে নিমজ্জিত পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ গত ২ নভেম্বর থেকে ৪৫ দিনের জন্য তাদের কারখানা বন্ধ করে দেয়। ফলে এ সময়ে কোম্পানিটির উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ ছিল। পরে আবার নতুন করে আরও ৩০ দিনের জন্য প্রতিষ্ঠানটির কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

১৯৯৬ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ ২০১৭ সাল থেকে নিয়মিত বড় লোকসান করছে। আর ২০১৫ সালের পর থেকে কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের কোনো ধরনের লভ্যাংশ দেয়নি। ফলে পঁচা 'জেড' গ্রম্নপে স্থান হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির।

রিং শাইন টেক্সটাইল : বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বস্ত্র খাতে তালিকাভুক্ত রিং শাইন টেক্সটাইলের কারখানা ২৭ সেপ্টেম্বর একমাসের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। রিং শাইন টেক্সটাইল ডিএসইকে জানিয়েছে, করোনাভাইরাসের কারণে দেশের বাইরে থেকে তেমন কোনো কাজে আসছে না। আর যে কাজ পাওয়া যাচ্ছে তা তৈরি করার জন্য কাঁচামাল পাওয়া যাচ্ছে না। তাই ইপিজেড শ্রমিক আইনের ১১ ধারা অনুযায়ী কারখানা বন্ধ করা হয়।

সিভিও পেট্রোলিয়াম : কনডেনসেট সরবরাহ স্থগিত থাকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত জ্বালানি ও বিদু্যৎ খাতের কোম্পানি সিভিও পেট্রোকেমিক্যাল রিফাইনারি ৫ জুলাই থেকে উৎপাদন প্রক্রিয়া বন্ধ ঘোষণা করে।

তথ্য ম?তে, চলতি বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কোম্পানিটির কনডেনসেট সরবরাহ বন্ধ ছিল। এ কারণে তিন মাস কোম্পানিটির উৎপাদন বন্ধ থাকে। এরপর বিদু্যৎ, খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ থেকে কনডেনসেট সরবরাহ চালুর জন্য কোনো নির্দেশনা না দেওয়ায় কোম্পানিটি উৎপাদন চালু করতে পারছে না।

দুলামিয়া কটন : বিদ্যমান পরিস্থিতি বিবেচনায় ১৩ জুন কারখানা বন্ধের ঘোষণা দেয় পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত বস্ত্র খাতের কোম্পানি দুলামিয়া কটন স্পিনিং মিলস লিমিটেড। চলতি হিসাব বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে (জুলাই-মার্চ) কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি লোকসান (ইপিএস) হয় ১ টাকা ৫২ পয়সা, আগের হিসাব বছরের একই সময়ে যা ছিল ৩ টাকা ২১ পয়সা।

তিন দশকের বেশি সময় আগে প্রতিষ্ঠিত দুলামিয়া কটন সুতা উৎপাদন করে, যা মূলত স্থানীয় বস্ত্র শিল্পেই ব্যবহার হয়। মাল্টিমুড গ্রম্নপের এ প্রতিষ্ঠানটি পুঁজিবাজারে আসে ১৯৮৯ সালে। কোম্পানির অনুমোদিত মূলধন ৩০ কোটি টাকা। পরিশোধিত মূলধন ৭ কোটি ৫৫ লাখ ৭০ হাজার টাকা। নিরীক্ষিত প্রতিবেদন অনুসারে কোম্পানির পুঞ্জীভূত লোকসান ৩৩ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। এ কোম্পানির ৭৫ লাখ ৫৬ হাজার ৬০০টি শেয়ারের মধ্যে ৩৩ দশমিক ১৬ শতাংশ শেয়ার উদ্যোক্তা-পরিচালক, ৩ দশমিক ৪ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ও বাকি ৬৩ দশমিক ৪৪ শতাংশ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে।

তালস্নু স্পিনিং : মহামারি করোনাভাইরাসের পরিপ্রেক্ষিতে ৩১ মে কারখানা বন্ধ করে দেয় পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত তালস্নু স্পিনিং। তালস্নু স্পিনিং কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ডিএসই জানিয়েছে, ৭ এপ্রিল কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ সভা করে কারখানা লে-অফ ঘোষণা করে। পরে লে-অফ তুলে নিয়ে কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়। কোম্পানিটি জানিয়েছে, মহামারি করোনাভাইরাসের পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত কারখানা বন্ধ থাকবে। ডিএসইর তথ্যানুযায়ী সংস্থাটি এখনো উৎপাদন শুরু করতে পারেনি।

আলহাজ টেক্সটাইল : বস্ত্র খাতের কোম্পানি আলহাজ টেক্সটাইল মিলসের পরিচালনা পর্ষদ ২০১৯ সালের অক্টোবরে কারখানা বন্ধ ঘোষণা করে ওই সময় ২৫ জুন থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত ৩০ দিনের জন্য কারখানা লে-অফ ঘোষণা করা হয়। পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় পরে ২৫ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট ১৫ দিনের জন্য, ৯ আগস্ট থেকে ২৩ আগস্ট ১৫ দিনের জন্য, ২৪ আগস্ট থেকে ৭ সেপ্টেম্বর ১৫ দিনের জন্যসহ মোট ১১৫ দিন মিল লে-অফ করার পরও বিক্রয় পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। পরে পরিচালনা পর্ষদ মিলের কর্মী ও শ্রমিকদের ওই বছরের ৮ অক্টোবর থেকে আবার নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়।

মিথুন নিটিং : পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বস্ত্র খাতের কোম্পানি মিথুন নিটিং অ্যান্ড ডাইং ফ্যাক্টরির কার্যক্রম ২০১৯ সালের ২০ সেপ্টেম্বর বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়। চট্টগ্রামের ইপিজেডে অবস্থিত মিথুন নিটিং এখনো তাদের কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি।

আরএন স্পিনিং মিলস : কুমিলস্না ইপিজেডে অবস্থিত আরএন স্পিনিং মিলস লিমিটেডের কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকান্ড ঘটে ২০১৯ সালে। এতে কোম্পানিটির দুটি ইউনিট পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৮ এপ্রিল বন্ধ হয়ে যায় কারখানার উৎপাদন কার্যক্রম।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আবু আহমেদ যায়যায়দিনকে বলেন, 'প্রতিষ্ঠান চালাতে না পারলে বন্ধই হবে। এখানে যোগ্য নেতৃত্বের অভাব পরিলক্ষিত হয়। নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসব দুর্বল কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে আসার অনুমতি দিয়েছে। কোনো সবল কোম্পানি তো বন্ধ হচ্ছে না। এ দায় বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি)। এসব কোম্পানি উদ্যোক্তারা নিজেরাই সব শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। ফলে তারা কোম্পানি চালানো গরজ মনে করছেন না। চালাতে গেলে মুনাফা দেখাতে হবে। আর মুনাফা দেখালে তা পাবেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। এ জন্য তারা কোম্পানি না চালিয়ে লে-অফ বা বন্ধ করে দিয়ে হয় ঘরে বসে আছেন অথবা বিদেশ চলে যাচ্ছেন, টাকা পাচার করছেন। এসব কারণে প্রকৃত বিনিয়োগকারীরা ফতুর হয়ে যাচ্ছেন।'

\হ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে