চালের মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ

প্রকাশ | ২২ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০

আলতাব হোসেন
চাল উৎপাদনে উদ্বৃত্তের রেকর্ড, হচ্ছে আমদানিও। আমদানি সহজ করার পর সরকারি বেসরকারিভাবে চাল আসছে দেশে। চাহিদার চেয়ে সরবরাহ বেশি; তারপরও বেড়েই চলছে অপরিহার্য খাদ্যপণ্যের দাম। কারো কাছে নেই এর কোনো সদুত্তর। চলছে দোষারোপের খেলা। সরকার, ভোক্তা ও চাল ব্যবসায়ীরা বলছেন, চালের মূল্য বৃদ্ধির পেছনে মিল মালিকরাই দায়ী। তাদের কারসাজিতে চালের দাম লাগামহীন। আর চালকল মালিকরা অভিযোগ করছেন, সরকারের পক্ষ থেকে পাইকারি ও খুচরা বাজারে মূল্য নির্ধারণ ও বাজার মনিটরিং না থাকায় চালের দাম বাড়ছে। এক পক্ষ আরেক পক্ষের উপর দায় চাপানোর পাল্টাপাল্টি অভিযোগের খেলায় চালের দাম এখন অনেকের নাগালের বাইরে। করোনাকালে চালের দামে জনজীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে। দেশে পর্যাপ্ত মজুদ থাকার পরও চালের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকায় বাজার নিয়ন্ত্রণে আমদানির সুযোগ উন্মুক্ত করে সরকার। বেসরকারিভাবে চালের আমদানি শুল্ক আগের ৬২.৫০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ নির্ধারণ করে সরকার। এতে বসরকারিভাবে চাল আমদানিতে শুল্ক কমেছে ৩৭.৫ শতাংশ। আমদানি শুল্ক কমানোর পর চাল আমদানিতে হিড়িক পড়ে ব্যবসাীয়দের মধ্যে। রোববার পর্যন্ত বেসরকারিভাবে ১০ লাখ ১৪ হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সরকারিভাবে আসছে তিন লাখ ৬৩ হাজার টন। পুরান ঢাকার বাবুবাজার ও বাদামতলী এলাকার কয়েকজন চাল ব্যবসায়ীরা জানান, আমদানির খবরে চালের দাম বস্তাপ্রতি ৩০০ টাকা পর্যন্ত পাইকারি বাজারে কমে। আমদানিকৃত চাল খুচরা বাজারে প্রবেশের একদিন যেতে না যেতে আবারও বাড়ছে চালের দাম। আমদানিকৃত চাল ভালো মানের না হওয়ার কারণে ফের \হবস্তা প্রতি দেশী চালের মূল্য ৫০ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছেন মিল মালিকরা। ব্যাংক ঋণ নিয়ে ধানের বড় মজুত গড়ে তোলেছেন মিল মালিকরা। বাজারে চালের দাম মূলত তাদের ওপর নির্ভর করে। তারা কারসাজির মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেছেন। ব্যাবসায়ীরা বলেন, বাজারে চালের ঘাটতি রয়েছে ১০ থেকে ১৫ লাখ টন। তাই বাজারে চালের দাম অস্বাভাবিক। কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকও মিল মালিকদের কারসাজিতে চালের বাজার টালমাটাল বলে মন্তব্য করেন। কাওরানবাজারের কুমিলস্না চাল ট্রেডাসের ম্যানেজার রঞ্জিত পোদ্দার যায়যায়দিনকে বলেন, আমদানিকৃত নাজিরসাইল জাতের চিকন চাল বুধবার বাজারে এসেছে। এ চাল অনেকটা কালচে রঙের। ৫৯ টাকা কেজি দরে পাইকারিভাবে কিনে ৬০ টাকায় বিক্রি করছেন খুচরা বিক্রেতারা। আর দেশীজাতের চিকন নাজিরসাইল চাল বিক্রি হচ্ছে ৬২ টাকা দরে। আমদানি চালের মান ভালো না হওয়ায় ভোক্তারা দুই টাকা বেশি দিয়ে দেশী চিকন নাজিরের চালই কিনছেন। তিনি আরো বলেন, চাল আমদানি ও বিপণন পর্যবেক্ষণ করতে একটি মনিটরিং সেলও গঠন করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। তবে মনিটরিং কোথায় করছে সে কথা কোনো ভোক্তা কিংবা খুচরা ব্যবসায়ীরা জানেন না। এই সুযোগটা নিয়ে মিল মালিকরা আবারও চালের দাম বস্তা প্রতি ৫০ থেকে ১০০ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছেন। চালের ভরা মৌসুম, পর্যাপ্ত মজুদ ও আমদানি পরও দেশে কেন চালের দাম বাড়ছে, জানতে চাইলে বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এ কে এম লায়েক আলী যায়যায়দিনকে বলেন, কৃষক বা সরকারের মজুদ থেকে বাজারে চালের কোনো সরবরাহ নেই। শুধু মিল মালিকরা বাজারে চাল সরবরাহ করছে। চাল আমদানির কারণে পাইকারি বাজারে বস্তাপ্রতি চালের দাম ৩০০ টাকা পর্যন্ত কমেছে। সরকারের মনিটরিং ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে পাইকারি ও খুচরা বাজারের মধ্যে বড় ফারাক রয়েছে। সরকারের উচিত পাইকারি ও খুচরা বাজারের জন্য চালের দাম নির্ধারণ করা। তিনি আরো বলেন, সরকারের আমদানিকৃত চালের মান ভালো না, আমদানি প্রক্রিয়া বিলম্ব হচ্ছে। সরকার ৩৪ টাকা কেজি দরে চাল আমদানি করছে। চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের উচিত আমদানি মূল্যেই ভোক্তাদের চাল দেয়া। বর্তমান সময়ে তো সরকারের ভিজিডি, ভিজিএফ এবং স্বল্পমূল্যের চাল বিক্রি বন্ধ আছে। সরকারের তরফ থেকে চাল নিয়ে বাজারে না নামলে বাজার নিয়ন্ত্রন সম্ভব হবে না। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র গবেষক এম আসাদুজ্জামান যাযাদিকে বলেন, উদ্যোগে চাল কল স্থাপন করলে সিন্ডিকেট থাকবে না। চাল নিয়ে আসলে কোথায় কারা সিন্ডিকেট করে চালবাজি করছে তা খুঁজে বরে করতে হবে সরকারকে। বাজার মনিটরিং জোরদার না করে আমদানি করলে খুব বেশি কাজে আসবে না। সরকারি উদ্যোগে চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসে চালের পাইকারি ও মিল পর্যায়ে দাম নির্ধারণ করে তা কার্যকর করতে হবে। বাংলাদেশ রাইস মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহসভাপতি জাকির হোসেন যাযাদিকে বলেন, আগামী তিন-চার মাসের মধ্যে বাজারে বোরো মৌসুমের নতুন চাল বাজারে আসবে। বোরো ধান ওঠার আগে কি পরিমাণ চালের প্রয়োজন তা নির্ধারণ করা উচিত। কারণ ঘাটতির চেয়ে বেশি আমদানি হলে কৃষকরা লোকসানে পড়বে। চাল আমদানির অনুমোদনের আগে চাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করা দরকার ছিলো। যেনতেন আমদানির নামে টাকা পাচার হতে পারে। রাজনৈতিক নেতা বা মৌসুমী ব্যবসায়ীরা চাল আমদানির অনুমোদন পেলে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা নাখোশ হবেন। সেদিকে সরকারকে কঠোর নজরদারি করতে হবে। খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার যায়যায়দিনকে বলেন, বিশেষ পরিস্থিতিতে বাজার নিয়ন্ত্রণ করার জন্য চাল আমদানির অনুমোদন দেওয়া হলেও দেশে পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত সরকারি গুদামে পাঁচ লাখ ৩৮ হাজার টন চাল ও এক লাখ ৭৩ হাজার টন গম মজুদ আছে। দেশে ১৯ হাজার ৭৩৪টি চালকল বা চাতাল রয়েছে। প্রতিটি চাতালে ৫০০ থেকে এক হাজার বস্তা চালের মজুদ আছে। ছোট ছোট মুদি দোকানগুলোতেও ৫ থেকে ১০ বস্ত চাল মজুদ থাকে। সেই হিসাবে দেশে প্রায় ৩৫ লাখ টন চাল মজুদ রয়েছে। চলতি অর্থবছরে চাহিদার তুলনায় ২৯ লাখ টন ধান বেশি উৎপাদন হয়েছে। চালের কোনো ঘাটতি নেই। বরং বোরো ধান ওঠার আগে স্বল্পমূল্যে মানুষের মাঝে খাদ্য বিতরণ করতে হবে। এর বাইরে সরকারি পর্যায়ে রেশনিং, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি ও জরুরী প্রয়োজনেই চাল আমদানি করা হচ্ছে। সরকারি সংস্থাট ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ি সোমবার মোটা জাতের চাল বাজার বেধে ৪৪ থেকে ৪৬ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। আর মাঝারি মানের চাল ৪৭ টাকা এবং চিকন চাল ৬২ থেকে ৬৪ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ফুড পস্নানিং অ্যান্ড মনিটরিং ইউনিটের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্ববাজারে চালের দাম পরতির দিকে। দেশে ধান-চাল এখন প্রয়োজনের তুলনায় বেশি আছে। লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে বোরো ধান উৎপাদন হয়েছে প্রায় দুই কোটি দুই লাখ টন। আমন উৎপাদন হয়েছে প্রায় দেড় কোটি টন। নেত্রকোনার দুর্গাপুরের গাঁওকান্দিয়া ইউপির কৃষক আবু সামা বলেন, গত ২৫ বছরের মধ্যে এবার আমন ধান বেশি দামে বিক্রি করেছি। গত বছর যে ধান ৬শ' টাকা মণে বিক্রি করেছিলাম, এবার সেই চিকন ধান বিক্রি করছি ১৮শ' টাকা মণে। কোথাও কোথাও দুই হাজার টাকা মণেও ধান বিক্রি হচ্ছে। সরকার এক হাজার ৫০ টাকা মণে ধান কিনছে, তাই কৃষকরা সরকারের কাছে না বেচে পাইকারদের কাছে বিক্রি করছে।