পৌর নির্বাচনে ি

বদ্রোহীদের ইন্ধন নজরদারিতে শতাধিক মন্ত্রী-এমপি

প্রকাশ | ২২ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০

ফয়সাল খান
আওয়ামী লীগের দুর্গ হিসেবে পরিচিত সিলেটের হবিগঞ্জ জেলা। দুই ধাপে এ জেলার তিনটি পৌরসভায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তিনটিতেই পরাজিত হয়েছেন নৌকার প্রার্থীরা। সবশেষ গত শনিবার অনুষ্ঠিত মাধবপুর পৌরসভার নির্বাচনে জামানত হারিয়েছেন সরকার দলীয় প্রার্থী শ্রীধাম দাশগুপ্ত। তিনি নৌকা প্রতীকে ৬০৮ ভোট পেয়ে চতুর্থ হয়েছেন। এ পৌরসভায় দু'জন বিদ্রোহী প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, যাদের একজন স্থানীয় প্রতিমন্ত্রীর আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত। শুধু হবিগঞ্জ জেলাই নয়, আওয়ামী লীগের শক্তিশালী অবস্থান থাকার পরও দেশের বিভিন্ন জায়গায় জয় ঘরে তুলতে পারেনি নৌকার প্রার্থীরা। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও এমপি-মন্ত্রীদের উল্টো পথে চলার কারণে দুই ধাপে ২৩ পৌরসভায় দলীয় প্রার্থীরা পরাজিত হয়েছেন। এর মধ্যে প্রথম ধাপের ২৩টির মধ্যে ৫টি ও দ্বিতীয় ধাপের ৫৯টির মধ্যে ১৮টি পৌরসভায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা পরাজিত হন। স্থানীয় সরকারের এসব নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী ও বিশৃঙ্খলার পেছনে এমপি-মন্ত্রী এবং প্রভাবশালী নেতাদের ইন্ধন থাকতে পারে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা। বিভাগীয় সাংগঠনিক টিম এসব বিষয় নিয়ে কাজ করছে। স্থানীয় পর্যায়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পেছনে জড়িত এমপি-মন্ত্রীর স্থানীয় কর্মকান্ড পর্যালোচনা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তারা। গেল দুই ধাপের নির্বাচনে বিদ্রোহীদের উস্কানি দেওয়াসহ তৃতীয় ও চতুর্থ ধাপে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনী এলাকাগুলোর সংসদ সদস্য, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও প্রভাবশালী নেতাদের প্রতি তীক্ষ্ন নজর রাখবে দলীয় ও সরকারি বিভিন্ন সংস্থা। আগামী ৩০ জানুয়ারি তৃতীয় ধাপে দেশের ৬৪ পৌরসভা ও ১৪ ফেব্রম্নয়ারি চতুর্থ ধাপে ৫৬ পৌরসভায় ভোট হওয়ার কথা রয়েছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর জামানত হারানো হবিগঞ্জের মাধবপুর পৌরসভা বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মাহবুব আলীর নির্বাচনী এলাকা। এ পৌরসভায় ৫ হাজার ৩১ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন বিএনপির প্রার্থী হাবিবুর রহমান মানিক। হিসাব অনুযায়ী, ৪ হাজার ১৮৫ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে আছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী পঙ্কজ কুমার সাহা। তিনি প্রতিমন্ত্রীর আস্থাভাজন হিসেবে এলাকায় পরিচিত এবং তার নির্বাচন করার ক্ষেত্রে প্রতিমন্ত্রীর লোকজন সহায়তা করছেন বলে জানা গেছে। তৃতীয় স্থানে আছেন অন্য একজন প্রভাবশালী নেতার আস্থাভাজন আওয়ামী লীগের অপর বিদ্রোহী প্রার্থী শাহ মো. মুসলিম। তিনি ভোট পেয়েছেন ৩ হাজার ৮৫। স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, ১৯৯৭ সালে মাধবপুর পৌরসভা গঠিত হওয়ার পর এই প্রথম বিএনপির কোনো প্রার্থী জয়লাভ করল। পৌর নির্বাচন ছাড়াও এর আগে কখনো কোনো নির্বাচনে ভালো ফল করতে পারেনি বিএনপি। ২৮ ডিসেম্বর প্রথম ধাপের পৌর নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এই জেলার শায়েস্তাগঞ্জ ও নবীগঞ্জ পৌরসভায় নৌকার প্রার্থীরা পরাজিত হয়েছেন। শায়েস্তাগঞ্জেও আওয়ামী লীগের একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী ছিল। দলীয় সূত্রগুলো বলছে, শুধু হবিগঞ্জেই নয়, সারাদেশে পৌর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এমপি-মন্ত্রী ও প্রভাবশালী নেতারা নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে মনোনয়ন পাইয়ে দিতে চেষ্টা করছেন। এ চেষ্টায় ব্যর্থ হলে নানা কৌশলে বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন। যার কারণে চলমান পৌরসভা নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী নিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কঠোর অবস্থানের পরও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে। সূত্র মতে, বিদ্রোহী প্রার্থী নিয়ে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। আগে বিভিন্ন নির্বাচনের সময় জয়ী হয়ে এলে বিদ্রোহী প্রার্থীকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হতো। কিন্তু এবার তা দেওয়া হচ্ছে না। প্রথম ধাপের নির্বাচনের সময় নেত্রকোনা জেলার এক পৌরসভায় আগের নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে জয়লাভ করা একজনকে মনোনয়ন দিয়েও তা পরবর্তীতে বাতিল করা হয়। দলীয় সভাপতি ও কেন্দ্রীয় নেতাদের এমন কঠোর অবস্থানও তৃণমূল পর্যায়ে বিদ্রোহী প্রার্থী দমন করা যাচ্ছে না। যার ফলে মারামারি ও সহিংসতা দিন দিন বাড়ছে। এমপি-মন্ত্রীদের সঙ্গে স্থানীয় নেতাকর্মীদের দূরত্ব দিন দিন বেড়েই চলছে। নিজস্ব বলয় সৃষ্টি ও সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া বিভিন্ন গ্রম্নপ-উপ গ্রম্নপ এখনো সক্রিয় আছে। যার প্রভাব পড়েছে সদ্য সমাপ্ত পৌরসভা নির্বাচনের মাঠে। কারণ হিসেবে আওয়ামী লীগের একধিক নেতা যায়যায়দিনকে জানিয়েছেন, কোনো বিদ্রোহী প্রার্থীই নিজের শক্তি বা সামর্থ্য নিয়ে দলীয় প্রার্থীকে চ্যালেঞ্জ করে নির্বাচন করতে পারে না। বিদ্রোহী প্রার্থীদের পেছনে দলের এক অংশের নেতাদের ইন্ধন ও সমর্থন থাকে। স্থানীয় এমপি-মন্ত্রীরা প্রকাশ্যে না বললেও নির্বাচনের আগে-পরে একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়, কে কার সমর্থন নিয়ে নির্বাচন করছে। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় এমপি-মন্ত্রী ও জেলা-উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালীদের ইন্ধনে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন মনোনয়নবঞ্চিতরা। দলীয় বিদ্রোহী থাকায় ভোটের মাঠে পরাজিত হওয়ার পাশাপাশি সাংগঠনিক শৃঙ্খলাও বিনষ্ট হচ্ছে। জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান যায়যায়দিনকে বলেন, যারাই বিদ্রোহীর পক্ষ নিয়ে নৌকার বিরোধিতা করছেন, তারা যতই প্রভাবশালী নেতা হোক, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ বিষয়ে বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা কাজ করছেন। নৌকার বিরোধীদের শাস্তির মুখোমুখি করা হবে। অন্যদিকে, গত শনিবার অনুষ্ঠিত হয়েছে বেলকুচি পৌরসভার নির্বাচন। ওই নির্বাচনে জয় পেয়েছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মো. সাজ্জাদুল হক। ভোটের মাঠে তার কাছে পরাজিত হয়েছেন নৌকা প্রতীকের প্রার্থী বেগম আশানুর বিশ্বাস। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরেই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে দুই ভাগে বিভক্ত বেলকুচি উপজেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতি। এতে দুই পক্ষে নেতৃত্বে দিচ্ছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য আবদুল মোমিন মন্ডল এবং জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আবদুল লতিফ বিশ্বাস। সদ্য সমাপ্ত পৌরসভা নির্বাচনে নিজ বলয়ের প্রার্থী নৌকার মনোনয়ন বঞ্চিত হওয়ায় ভোটের মাঠে বিদ্রোহী প্রার্থীকে সরাসরি ইন্ধন দেন স্থানীয় সংসদ সদস্যের কাছের লোকজন। ফলে স্থানীয় আওয়ামী লীগের ভোট দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। প্রকাশ্যে এমপির এমন পক্ষপাতিত্বে ভোটের মাঠে পরাজিত হন নৌকার মনোনীত প্রার্থী বেগম আশানুর বিশ্বাস। স্থানীয় এমপি এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে দিনাজপুরের বীরগঞ্জ পৌরসভায় নির্বাচিত হয়েছেন দলটির 'বিদ্রোহী' প্রার্থী মো. মোশাররফ হোসেন। কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী পৌরসভায় দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থী মোহাম্মদ হোসেনের কাছে পরাজিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী ফরহাদ হোসেন ধলু। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, একাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর থেকেই অভ্যন্তরীণ কোন্দলে চলছে স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতি। দলীয় এই দ্বন্দ্বের নেতৃত্বে দিচ্ছেন স্থানীয় সাংসদ আসলাম সোহেন সওদাগার। তার ক্ষমতার দাপটে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে দলটির ত্যাগী, পরিশ্রমী, পরীক্ষিত ও দুর্দিনের নেতাকর্মীরা। চলমান দ্বন্দ্বের মাঝেই নাগেশ্বরী পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের মনোনয়ন পান স্থানীয় ওই সংসদ সদস্যের আপন ভাই ফরহাদ হোসেন ধলু। তিনি সংসদ সদস্যের ভাই হওয়ায় বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশ। অভ্যন্তরীণ কোন্দলের বলি হয়েছেন গাইবান্ধা পৌরসভা আওয়ামী লীগের প্রার্থী শাহ মাসুদ জাহাঙ্গীর কবির (মিলন)। সেখানে বিদ্রোহী প্রার্থী জয়লাভ করেছেন মো. মতলুবর রহমান। এ পৌরসভায় বিদ্রোহী প্রার্থী ছিল চারজন। আগামী ৩০ জানুয়ারি তৃতীয় ধাপে দেশের ৬৪ পৌরসভা, ১৪ ফেব্রম্নয়ারি চতুর্থ ধাপে ৫৬ পৌরসভা ও পঞ্চম ধাপে ২৮ ফেব্রম্নয়ারি ৩১ পৌরসভায় ভোট হওয়ার কথা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, পরবর্তী পৌরসভা নির্বাচনে নৌকার বিপক্ষে যে কোনো পর্যায়ের নেতা এবং জনপ্রতিনিধিরা জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিদ্রোহী ও তাদের মদদদাতাদেরও কোনো প্রকার ছাড় দেওয়া হবে না।