২৫ জানুয়ারির মধ্যে পৌঁছাবে ক্রয়কৃত ৫০ লাখ ডোজ

দেশে এলো ভারতের উপহারের টিকা

প্রকাশ | ২২ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০

জাহিদ হাসান
ভারতের উপহার হিসেবে করোনা টিকা বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডক্টর এ কে আব্দুল মোমেন ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের কাছে হস্তান্তর করেন ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী -আমিনুল ইসলাম শাহীন
দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে বৃহস্পতিবার দেশে এসেছে করোনাভাইরাসের টিকা। প্রতিবেশী দেশ ভারতের উপহার হিসেবে দেওয়া ২০ লাখ ডোজ টিকার প্রথম চালান গতকাল সকাল সোয়া এগারটায় এয়ার-ইন্ডিয়ার বিশেষ ফ্লাইটে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছায়। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকারের এই টিকা দ্রম্নতই দেশের মানুষকে দেওয়া শুরু হবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা। পূর্ব নির্ধারিত সময় অনুযায়ী গতকাল সকাল আটটায় মুম্বাইয়ের ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উপহারের ২০ লাখ ডোজ টিকা নিয়ে বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা দেয় ফ্লাইটটি। সকাল সোয়া দশটায় ভারতীয় হাইকমিশনের ফেসবুক পেজেও এ বিষয়ে জানানো হয়। সেখানে টিকাসহ একটি উড়োজাহাজের ছবি দিয়ে বলা হয়, গন্তব্য বাংলাদেশে! ভারতে তৈরি কোভিড টিকার চালান বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা হয়েছে! এছাড়া ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এক টুইটে টিকা প্রেরণের বিষয় নিশ্চিত করে 'বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয় ভারত, ভ্যাকসিনমৈত্রী তারই নজির।' বলে স্ট্যাটাস দেন। এদিকে উপহারের টিকা গ্রহণ কার্যক্রমে স্বয়ং স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বিমানবন্দরে উপস্থিত হওয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন উপ-পরিচালকের নেতৃত্বে একটি দল টিকা বুঝে নিতে বিমানবন্দরে যান। তাদের সঙ্গে ছিলেন ঢাকায় ভারতীয় হাই-কমিশনের কর্মকর্তারা। বিমানবন্দরের কার্যক্রম শেষে সকাল সোয়া এগারটার দিকে দুটি ফ্রিজার ভ্যানে টিকার বাক্স তেজগাঁওয়ের ইপিআই সংরক্ষণাগারে রাখার উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর দুপুর দেড়টার দিকে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের হাতে উপহারের টিকা তুলে দেয় ভারত সরকার। এ সময় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের হাতে পৃথকভাবে করোনার টিকার দুটি স্যাম্পল বক্স তুলে দেন ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী। তারা করোনা টিকা উপহার পেয়ে ভারত সরকারকে ধন্যবাদ জানান। জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সংশ্লিষ্টরা যায়যায়দিনকে জানান, ভারতের ২০ লাখ ডোজ উপহারের টিকার বাইরে বাংলাদেশ সরকারিভাবে সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ৩ কোটি ডোজ টিকা কিনছে। যার প্রথম চালানে ৫০ লাখ ডোজ টিকা ২৫ জানুয়ারির মধ্যে পৌঁছাতে পারে। ফলে ফেব্রম্নয়ারির প্রথম সপ্তাহে টিকাদান শুরুর পরিকল্পনা হলেও তা আগে পাওয়ায় প্রয়োগের সময় এগিয়ে আনা হয়েছে। এ ব্যপারে বুধবার স্বাস্থ্য সচিব মো. আবদুল মান্নান প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আয়োজিত এক সভায় আগামী ২৭ বা ২৮ জানুয়ারি টিকা প্রয়োগ শুরুর কথা জানান। তিনি বলেন, প্রথম দিন চিকিৎসক, নার্স, মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক, পুলিশ, সেনাবাহিনী, প্রশাসন, সাংবাদিকদের একজন করে প্রতিনিধিকে টিকা দেওয়া হবে। প্রথম দিন এরকম ২০ থেকে ২৫ জনকে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল থেকে টিকাদান উদ্বোধন করার কথা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এ কর্মসূচির উদ্বোধন করবেন। প্রথমে যে টিকা দেওয়া হবে, তা হবে পরীক্ষামূলক প্রয়োগ। ঢাকা মেডিকেল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল এবং কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে প্রাথমিকভাবে এই টিকা দেওয়া হবে। শুরুতে নিবন্ধন ছাড়াই দেওয়া হবে করোনা টিকা অনলাইনে নিবন্ধন ছাড়া কাউকে করোনা টিকা দেবে না সরকার। তবে বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার জরুরি ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। ফলে দেশে এ টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল না হওয়ায় গণটিকাদান শুরু করার আগে সংক্ষিপ্ত পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য সচিব বলেন, 'প্রথমদিন টিকা দেওয়ার পরদিন ড্রাই রান বা টেস্ট হিসেবে এই টিকা দেওয়া হবে। তারপর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রটোকল অনুযায়ী এক সপ্তাহ অপেক্ষা করব। আমরা দেখব টিকা নেওয়ার পরে তাদের মধ্যে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে কিনা।' প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ শেষে সারাদেশে টিকা বিতরণ শুরু হবে। সরকারের কেনা টিকা জেলা পর্যায়ে পৌঁছে দেবে সেরাম ইন্সটিটিউটের ডিস্ট্রিবিউটর বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস। আর ভারত সরকারের উপহার হিসেবে পাওয়া টিকা সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির আওতায় জেলা পর্যায়ে পৌঁছানো হবে। অনুমোদন পাচ্ছে না বেসরকারি টিকাদান কর্মসূচি আগামী ৮ ফেব্রম্নয়ারি জেলা-উপজেলা এবং মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে টিকা দেওয়া হবে। তবে প্রাথমিকভাবে বেসরকারি হাসপাতালে করোনাভাইরাসের টিকা দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য সচিব। গণটিকাদান শুরুর আগে অ্যাপের মাধ্যমে নিবন্ধন শুরু হবে। স্বাস্থ্যকর্মীসহ মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সামনের সারির কর্মীরা আগে টিকা পাবেন। প্রথম ডোজ দেওয়ার আট সপ্তাহ পর দিতে হবে দ্বিতীয় ডোজ। টিকার প্রাপ্যতা অনুযায়ী মাসভিত্তিক একটি বিতরণ তালিকাও ইতোমধ্যে তৈরি করা হয়েছে। সরকারের কেনা ও ভারতের উপহারের টিকার বাইরে কোভ্যাক্সের আওতায় ছয় কোটি ৮০ লাখ ডোজ টিকা বাংলাদেশ পাবে। সব মিলিয়ে এই টিকা দেওয়া যাবে ৫ কোটি ১০ লাখ মানুষকে। এ হিসাবে দেশের অন্তত আট থেকে নয় কোটি মানুষকে যেন টিকা দেওয়া যায় সে প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, যদি দেশের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দেওয়া যায়, তাহলে সে দেশে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হবে। ১২ ঘণ্টার মধ্যে দেশের যে কোনো স্থানে নেওয়া যাবে টিকা আপাতত রাজধানীর তেজগাঁওয়ে ইপিআই সেন্টারে সংরক্ষণ করা হয়েছে ভারতের দেওয়া ২০ লাখ ৪ হাজার ডোজ টিকা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ডা. রওশন জাহান আক্তার বলেন, সর্বমোট ১৬৭টি কার্টনে করে ভ্যাকসিনের ডোজ এসে পৌঁছেছে। প্রতি কার্টনে আছে ১২০০ ভায়াল ভ্যাকসিন। এক ভায়ালে ১০ জনকে টিকা দেওয়া যাবে। ২০ লাখ চার হাজার ডোজ ভ্যাকসিন আছে বলে নিশ্চিত করেন তিনি। এছাড়া ঢাকা জেলার ই পি আই স্টোরের প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. মাওলা বক্স চৌধুরী বলেছেন, প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস প্রতিরোধের ভ্যাকসিন সংরক্ষণের জন্য তাদের কোল্ড বক্স আছে, সেখানে ২৪টি আইস প্যাক দিয়ে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। সেই কোল্ড বক্সে ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত ভ্যাকসিন রাখা যায়। দেশের যে কোনো জায়গায় যদি এই ভ্যাকসিনটি পরিবহণ করা হয়, তবে ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টার মধ্যে সবচেয়ে দূরে যে জেলাটি আছে পঞ্চগড় অথবা কক্সবাজারে যাওয়া যাবে। টিকা দিতে প্রস্তুত রাজশাহীর চার কেন্দ্র ঢাকার বাইরে টিকা প্রয়োগের জন্য ইতিমধ্যে রাজশাহীতে চারটি কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে। এসব কেন্দ্রে ১৬টি বুথে টিকা দেওয়া হবে। কেন্দ্র চারটি হলো- রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতাল, সিটি করপোরেশনের নগর ভবন, রাজশাহী পুলিশ লাইনস হাসপাতাল এবং রাজশাহী সেনানিবাস হাসপাতাল। রাজশাহী বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হাবিবুল আহসান তালুকদার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।