শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
মাঠ পর্যায়ে মনিটরিংয়ে বিশেষ টাস্কফোর্স সেচকাজে নিরবচ্ছিন্ন বিদু্যৎ সরবরাহ

নির্বিঘ্নে বোরো উৎপাদনে জোর দিচ্ছে সরকার

আলতাব হোসেন
  ২৫ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০

করোনাকালেও চাল উৎপাদনে বিশ্ব রেকর্ড। হচ্ছে আমদানিও। আমনের বাম্পার ফলনেও কমেনি বাজারের অস্থিরতা। বাজার স্থিতিশীল ও সংকট উত্তরণে বোরো উৎপাদন নির্বিঘ্ন করতে জোর দিচ্ছে সরকার। এবার বোরো আবাদে নেওয়া হয়েছে মহাপরিকল্পনা। বোরো মৌসুমে সার ও ডিজেল সংকট নিরসনে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠনের পাশাপাশি সার ও ডিজেলের পর্যাপ্ত মজুদ গড়ে তোলা হচ্ছে। চোরাচালান ঠেকাতে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে সীমান্তে। সেচকাজে বিদু্যৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে প্রয়োজনে শহরে লোডশেডিং করে কৃষিকাজে বিদু্যৎ নিরবচ্ছিন্ন রাখার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

উচ্চ ফলনশীল হাইব্রিড ধানের আবাদ বাড়ানো হচ্ছে। নতুন করে ৫০ হাজার হেক্টর জমি বোরো চাষের আওতায় আনা হয়েছে। হাওড় অঞ্চলে আগাম বন্যার আশঙ্কা রেখে স্বল্পকালীন জাতের ধান উৎপাদনে জোর দেওয়া হচ্ছে। বোরো ধানচাষে বিদু্যৎ বিল ও কৃষি যান্ত্রিকীকরণে ভর্তুকি বাড়ানোর পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে মনিটরিং বাড়াতে উচ্চ পর্যায়ে ৮৩ সদস্যের কমিটি কাজ করছে।

আমন ধানে লাভ পেয়ে এবার তীব্র শীত উপেক্ষা করে বোরো আবাদে কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছেন কৃষক। তাই কৃষকদের দম ফেলার ফুরসত নেই। শীত ও কুয়াশার কাকডাকা ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাঠে ঘাম ঝরানো পরিশ্রম করছেন ফসলের হাসি দেখতে। ধানের এলাকা হিসেবে খ্যাত হাওত অঞ্চলে চলছে বোরো আবাদের ধুম। নেত্রকোনা, জামালপুর, বগুড়া, দিনাজপুর, রংপুর, মাগুরা, কুমিলস্না, কিশোরগঞ্জ ফরিদপুরের

\হকিয়দাংশ ও উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোসহ ময়মনসিংহের কৃষকরা প্রচন্ড শীত ও হিমেল হাওয়া উপেক্ষা করে বোরো ধান রোপণে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। বিস্তীর্ণ এলাকার মাঠজুড়ে বোরো আবাদের ধুম পড়েছে। ভোরের আলো ফোটার আগেই কোমর বেঁধে ফসলের মাঠে নেমে পড়ছেন কৃষকরা। কুয়াশায় ঢাকা শীতের সকালে বীজতলায় ধানের চারা পরিচর্যার পাশাপাশি জমি চাষের কাজ চলছে পুরোদমে। তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশার কারণে বোরোর বীজতলা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় দ্রম্নত ধানের চারা লাগাচ্ছেন ক্ষেতে।

জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত চলে বোরো আবাদে সেচের জন্য বিদু্যতের পিক পিরিয়ড। সরকার এ সময়টায় প্রয়োজনে শহরে লোডশেডিং করে সেচের জন্য গ্রামে বিদু্যৎ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেই সঙ্গে ডিজেল ও সার পাচাররোধে বিজিবিসহ সীমান্ত এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বয়ে গঠন করা হয়েছে বিশেষ টাস্কফোর্স।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) হিসেবে দেশে বছরে ২৬ লাখ টন ডিজেল ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে বোরো মৌসুমে প্রয়োজন হয় প্রায় সাত লাখ টন। এবার বোরো উৎপাদন বাড়াতে সরকার ১৪ লাখ টনের বেশি ডিজেল মজুদ করেছে। উত্তরাঞ্চলের ডিজেলের ডিপোগুলোতে পুলিশ মোতায়নের জন্য চিঠি দিয়েছে বিপিসি।

বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের হিসাবে বছরে সারাদেশে ২৫ লাখ টন ইউরিয়া সারের প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত বোরো মৌসুমের জন্য প্রয়োজন হয় ১৩ লাখ ১৯ হাজার ৪৯১ টন। এরমধ্যে জানুয়ারি মাসে ইউরিয়া সারের প্রয়োজন হয় তিন লাখ ৯৬ হাজার টন। ফেব্রম্নয়ারিকে সার লাগে ৪ লাখ ১১ হাজার টন আর মার্চ মাসে প্রয়োজন পড়বে দুই লাখ ২৩ হাজার টন। ইতোমধ্যে সরকার বোরো মৌসুমের জন্য ১৪ লাখ টন সারের মজুদ করেছে।

সারের মজুদ বিষয়ে বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী সচিব রিয়াজ উদ্দীন আহমদ যায়যায়দিনকে বলেন, বোরো মৌসুমের জন্য পর্যাপ্ত সার মজুদ রয়েছে। এরপরও সার উৎপাদন ও আমদানি নিয়মিত রয়েছে। সরকার উইরিয়া সারের পাশাপাশি ৬ লাখ ৩১ হাজার টন ডিএপি সার মজুদ রেখেছে। সারের মূল্য কমানোসহ মনিটরিং বাড়ানো হয়েছে। সার সংকটের কোন আশঙ্কা নেই।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) তথ্য অনুযায়ী, এ বছর সরকার বোরোর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৪৮ লাখ পাঁচ হজিার ২শ' হেক্টর জমিতে। যা গত বছরের চেয়ে ৫০ হাজার হেক্টর বেশি জমিতে হাইব্রিড আবাদ হচ্ছে। এরমধ্যে হাইব্রিড ধানের চাষ হবে ১১ লাখ ৪ হাজার ৬৩৩ হেক্টর জমিতে। উচ্চ ফলনশীল (ইফশি) ধান আবাদ হচ্ছে ৩৬ লাখ ৭৩ হাজার ৮৩০ হেক্টর জমিতে। স্থানীয় জাতের ধান চাষ হচ্ছে ২৬ হাজার ৭৩৭ হেক্টর জমিতে।

এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কৃষিবিদ মো. আসাদুলস্নাহ যায়যায়দিনকে বলেন, চলতি বোরো মৌসুমে উৎপাদনের টার্গেট নেওয়া হয়েছে দুই কোটি পাঁচ লাখ ৮১ হাজার ৩শ' টন। যা গত বছরের চেয়ে চার লাখ টন বেশি। সরকার বোরো উৎপাদনে খুব গুরুত্ব দিচ্ছে। এজন্য সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও সংস্থা এক সঙ্গে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে মাঠপর্যায়ে কাজ করছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে মনিটরিং সেল খোলা হয়েছে। মাঠ ও আঞ্চলিক কর্মকর্তাদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। ঢাকা থেকে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা মাঠে অবস্থান করে তদারকি করছেন। কৃষিমন্ত্রী, সচিবসহ এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মাঠে যাচ্ছেন প্রায় প্রতিদিন। তিনি নিজেও মাঠে রয়েছেন বলে জানান। বোরো উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কৃষকের দৌরগোড়ায় রয়েছেন কৃষি কর্মকর্তারা।

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) হিসাবে, বোরো মৌসুমে দেশে ডিজেল চালিত ১৭ লাখ ৯২ হাজার ৬৩০টি নলকূপ রয়েছে। এর মধ্যে বিদু্যতে চলে এক লাখ ৮৬ হাজার ৪০০টি। অগভীর নলকূপ বিদু্যতে চলে এক লাখ ৫০ হাজার। ডিজেলে চলে ১০ লাখ ৭০ হাজার। গভীর নলকূপের মধ্যে ১২ হাজার ডিজেলে এবং ২৬ হাজার বিদু্যতে চলে। সরকার বিদু্যৎ চালিত পাম্পে ২০ শতাংশ করে ভর্তুকি দিচ্ছে। প্রয়োজনে সেজকাজে ডিজেলেও ভর্তুকি দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।

এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের সেচ ও কৃষি বিষয়ক পরামর্শক ড. ইফতেখারুজ্জান চৌধরী যাযাদিকে জানান, এবছর পর্যাপ্ত বৃষ্টি হয়েছে। এতে পানির স্তর কিছুটা বেড়েছে। ফলে সেচের খরচ কিছুটা কমবে। কৃষকরাও অতিরিক্ত পানি ব্যয়ে সচেতন হয়েছেন। বোরো উৎপাদনে এবার সেচের পানি বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। এবার বরেন্দ্র অঞ্চলেও বোরো আবাদ হবে।

এ বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী ড, আব্দুর রাজ্জাক যাযাদিকে বলেন, প্রায় ৫০ লাখ হেক্টর বেশি জমিতে এবার বোরো হচ্ছে। আমনে কৃষকরা ধানের ভালো দাম পাওয়ায় উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে বোরো আবাদে নেমেছেন। সরকার কৃষকদের বোরো ধানের উন্নত বীজ, সার, সেচসহ বিভিন্ন কৃষি উপকরণ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় যে প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে, তা সুষ্ঠুভাবে বিতরণ নিশ্চিত করতে সমন্বয় কমিটি মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে