শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচারণা শেষ, ১২ ওয়ার্ড ঘিরে সংঘাতের শঙ্কা

হেলাল উদ্দিন চৌধুরী, চট্টগ্রাম
  ২৬ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০
আগামীকাল অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এ উপলক্ষে নগরীতে চলছে বিজিবির টহল। ছবিটি সোমবার কাজীর দেউড়ী থেকে তোলা -ফোকাস বাংলা

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) নির্বাচনের ২১ দিনের উৎসবমুখর প্রচার-প্রচারণা শেষ। এখন চলছে ভোটারদের মধ্যে শেষ মুহূর্তের হিসাব নিকাশ। প্রধান দুই মেয়রপ্রার্থী আওয়ামী লীগের রেজাউল করিম চৌধুরী এবং বিএনপির ডা. শাহাদাত হোসেনসহ ৭ মেয়রপ্রার্থী এবং ২২৫ জন কাউন্সিলর প্রার্থী কাল ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হচ্ছেন।

এবারের নির্বাচনে মেয়র পদে যত না উত্তাপ তার চেয়েও বেশি আশঙ্কা কাউন্সিলর পদ নিয়ে। প্রথমবারের মতো দলীয় সমর্থনে হওয়া চসিক নির্বাচনে কাউন্সিলর পদ নিয়ে অনেক ওয়ার্ডে সংঘাতের আশঙ্কা রয়েছে। নগর পুলিশ (সিএমপি) এরই মধ্যে ৪১টি ওয়ার্ডের প্রায় অর্ধেক ২০টি ওয়ার্ডকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আওয়ামী লীগের দলীয় ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যেই এসব সংঘর্ষের সম্ভাবনার কথা উঠে এসেছে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে।

সোমবার সকাল ১০টা থেকে মক (প্রতীকী) ভোটের ব্যবস্থা করে নির্বাচন কমিশন, যা চলে বিকাল ৪টা পর্যন্ত। তবে প্রতীকী ভোটে ভোটার উপস্থিতি তেমন একটা চোখে পড়েনি। চট্টগ্রাম জেলা সিনিয়র নির্বাচন কর্মকর্তা আতাউর রহমান বলেন, নগরের ৭৩৫টি ভোটকেন্দ্রে একযোগে মক ভোটিংয়ে ব্যবস্থা রাখা হয়।

আগামী ২৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন। ৪১টি ওয়ার্ডে ভোটকেন্দ্র রয়েছে ৭৩৫টি। মোট ভোটার সংখ্যা ১৯ লাখ ৩৮ হাজার ৭০৬ জন। এদের মধ্যে নারী ৯ লাখ ৪৬ হাজার ৬৭৩ জন এবং পুরুষ ভোটার ৯ লাখ ৯২ হাজার ৩৩ জন।

৩১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী তারেক সোলেমান সেলিমের মৃতু্যতে ওই ওয়ার্র্ডে কাউন্সিলর পদে নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে। ১৮ নম্বর পূর্ব বাকলিয়া ওয়ার্ডে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন কাউন্সিলর পদপ্রার্থী মো. হারুনুর রশিদ।

নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে সবচেয়ে বেশি শঙ্কা ফিরিঙ্গিবাজার ওয়ার্ড নিয়ে। এই ওয়ার্ডে মনোনয়নঞ্চিত হয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন সাবেক কাউন্সিলর হাসান মুরাদ বিপস্নব। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচন করছেন মোহাম্মদ সালাউদ্দিন। দুজনই নগর ছাত্রলীগের স্টিয়ারিং কমিটির নেতা। তবে এই ওয়ার্ডেও নির্বাচনে ফ্যাক্ট হিসেবে কাজ করছেন সিডিএর চেয়ারম্যান জহিরুল আলম চৌধুরী দোভাষ।

৯ নম্বর উত্তর পাহাড়তলি ওয়ার্ড নিয়ে শঙ্কা কাজ করছে আওয়ামী লীগ-বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থীর মধ্যে। এই ওয়ার্ডে সাবেক কাউন্সিলর জহিরুল ইসলাম জসিম নির্বাচন করছেন বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে। এখানে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন পাহাড়তলি থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল আবছার মিয়া। অন্যদিকে বিএনপির হয়ে লড়ছেন আরেক সাবেক কাউন্সিলর আব্দুস ছাত্তার সেলিম। বিএনপি অধু্যষিত এই ওয়ার্ডে জহুরুল হক জসিমের ভালো অবস্থান রয়েছে ভোটের মাঠে।

১১ নম্বর দক্ষিণ কাট্টলী এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যাপক ইসমাইল। মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী হয়ে নির্বাচন করছেন আগের দুই মেয়াদে কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়া মোর্শেদ আকতার চৌধুরী। চসিক নির্বাচনে এখন পর্যন্ত ঘটে যাওয়া দুটি হত্যাকান্ডের একটি ঘটেছে এখানে। করোনায় নির্বাচন স্থগিত হয়ে যাওয়ার আগে তানভীর নামে এক যুবলীগ নেতা খুন হন মোর্শেদ আকতার চৌধুরীর বাড়িতে। তিনি ছিলেন মোর্শেদের কর্মী। ইসমাইলের দাবি, হামলায় আহত হওয়ার পর ইসমাইলকে মামলার আসামি করতে মোর্শেদই তানভীরকে হাসপাতাল নিতে দেননি। তবে সদ্য সাবেক কাউন্সিলর হওয়ায় স্থানীয় রাজনীতিতে মোর্শেদের বেশ শক্ত অবস্থান রয়েছে। অধ্যাপক ইসমাইলও অবশ্য বেশ দ্রম্নত মাঠ গুছিয়ে নিয়েছেন।

২৮ নম্বর পাঠানটুলী ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন সাবেক কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম বাহাদুর। মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে এখানে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন সদ্য সাবেক কাউন্সিলর আব্দুল কাদের। চসিক নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই ওয়ার্ডে দুই প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে বাবুল নামে একজন খুন হয়েছেন। এই হত্যামামলায় বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী কাদের কারাগারে আছেন।

১৬ নম্বর চকবাজার ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন টানা ৫ বার কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়া সাইয়েদ গোলাম হায়দার মিন্টু। তবে তিনি আওয়ামী লীগের কেউ নন দাবি করে চকবাজার এলাকায় আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের ত্যাগ সংগ্রামের চূড়ান্ত বিজয় নিশ্চিত করার ঘোষণা দিয়ে এখানে নির্বাচন করছেন নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা দেলোয়ার হোসেন ফরহাদ। ভোটের ঠিক আগে চকবাজারের ত্রাস শীর্ষ সন্ত্রাসী নুর মোস্তফা টিনুর জামিন এই ওয়ার্ডে সংঘাতের সম্ভাবনা অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে।

১৪ নম্বর লালখান বাজার ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আবুল হাসনাত মো. বেলাল। অন্যদিকে নির্বাচনে প্রার্থী না হয়েও এই ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর প্রার্থীর সবচেয়ে বড় মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছেন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দিদারুল আলম মাসুম। এই দুই নেতার মধ্যে এখানে পুরনো বিরোধ রয়েছে। যার জের ধরে গত এক বছরে অন্তত অর্ধশত ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে তাদের মধ্যে। বেলালের অভিযোগ, তাকে হারাতে মরিয়া মাসুম। অন্যদিকে মাসুম বলছেন, বেলাল তাকে হত্যার পরিকল্পনা করছেন।

১৩ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন নগর যুবলীগের সদস্য ওয়াসিম উদ্দিন চৌধুরী। অন্যদিকে তাকে চ্যালেঞ্জ করে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন তারই এক সময়ের কর্মী মাহমুদুর রহমান। তবে মাহমুদের চেয়েও এখানকার মনোনয়নবঞ্চিত সাবেক কাউন্সিলর মোহাম্মদ হোসেন হীরণের সঙ্গেই বেশি লড়তে হচ্ছে ওয়াসিম উদ্দিনকে।

২৬ নম্বর উত্তর হালিশহর ওয়ার্ডে বিএনপির হয়ে নির্বাচন করছেন সদ্য সাবেক কাউন্সিলর আবুল হাশেম। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন সাবেক কাউন্সিলর মোহাম্মদ হোসেন। তবে বিদ্রোহী প্রার্থী লায়ন ইলিয়াস পাশে পাচ্ছেন স্থানীয় সাংসদ আফছারুল আমিনের পরিবার ও থানা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি দীঘলকে।

২ নম্বর জালালাবাদ ওয়ার্ডে সদ্য সাবেক কাউন্সিলর সাহেদ ইকবাল বাবুর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নগর যুবলীগের সদস্য মো. ইব্রাহীম। এলাকায় কাউন্সিলর বাবুর ভালো অবস্থান রয়েছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ইব্রাহীমও ছেড়ে কথা বলবেন না। পাশাপাশি স্থানীয় রাজনীতিতে বাবুর সঙ্গে চট্টগ্রাম পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আবু মোহাম্মদ মহিউদ্দিনের পুরনো বিরোধ এই ওয়ার্ডে সংঘাতের সম্ভাবনার পালে বাড়তি হাওয়া জোগাচ্ছে।

১ নম্বর দক্ষিণ পাহাড়তলি ওয়ার্ডে সদ্য সাবেক কাউন্সিলর তৌফিক আহমদ চৌধুরীকে বাদ দিয়ে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি গাজী মোহাম্মদ শফিউল আজিমকে প্রার্থী দিয়েছে আওয়ামী লীগ। মনোনয়নবঞ্চিত তৌফিক এখান থেকে বিদ্রোহী হিসেবে নির্বাচন করছেন। তিনি ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি ও নগর যুবলীগের সদস্য। এলাকায় তার প্রভাব-প্রতিপত্তিও রয়েছে বেশ। বিপরীতে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর অবস্থান তুলনামূলকভাবে দুর্বল।

৩ নম্বর পাঁচলাইশ ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন সাবেক কাউন্সিলর কফিল উদ্দিন খান। তবে এখানে এক কফিলকে ঠেকাতে মাঠে নেমেছে ৮ বিদ্রোহী প্রার্থী। জয়ের চেয়ে কফিলকে ঠেকানোই তাদের বড় টার্গেট। ফলে এই ওয়ার্ডেও সংঘাতের আশঙ্কা রয়েছে বেশ।

বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এই ১৯ নম্বর দক্ষিণ বাকলিয়া ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন নুরুল আলম। অন্যদিকে বিএনপির হয়ে নির্বাচন করছেন ইয়াছিন চৌধুরী আছু। আছু ও নুরুল আলম দুজনই ভাই। এখানে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীও রয়েছে একজন। তবে এখানে আছু ও নুরুল আলম দুই ভাইয়ের মধ্যে আগে থেকেই তিক্ত সম্পর্ক ছিল। নির্বাচনের শুরুতে আছু মাঠে না থাকলেও গত দুদিন ধরে প্রচারণা করছেন তিনি। আছু মাঠে নামতেই নুরুল আলম তার বাসার নিচে নির্বাচনী কার্যালয় ভাঙচুরের অভিযোগ তুলে মামলা করেছেন তার বিরুদ্ধে। তবে আছুর অভিযোগ নুরুল আলমের মামলাটি সাজানো অভিযোগের ভিত্তিতে করা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে