অভিজিৎ হত্যায় জিয়াসহ ৫ জনের মৃতু্যদন্ড, ফারাবীর যাবজ্জীবন

প্রকাশ | ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
মঙ্গলবার লেখক অভিজিৎ রায় হত্যা মামলায় মৃতু্যদন্ডপ্রাপ্ত আসামিদের কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে আদালত থেকে কারাগারে নেওয়া হয় -ফোকাস বাংলা
বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায় হত্যা মামলায় সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচু্যত মেজর জিয়াউল হক ওরফে জিয়াসহ পাঁচজনকে মৃতু্যদন্ড দিয়েছেন আদালত। আর সরাসরি জড়িত না থেকেও হত্যায় প্ররোচনা দেওয়ায় বস্নগার শফিউর রহমান ফারাবীকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে। ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইবু্যনালের বিচারক মজিবুর রহমান মঙ্গলবার দুপুরে এ রায় ঘোষণা করেন। মামলায় অভিযুক্ত ছয় আসামির মধ্যে সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচু্যত মেজর জিয়াউল হক ওরফে জিয়া, মোজাম্মেল হুসাইন ওরফে সায়মন ওরফে শাহরিয়ার, আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ওরফে সাজিদ ওরফে শাহাব, আরাফাত রহমান ওরফে সিয়াম ওরফে সাজ্জাদ ওরফে শামস, আকরাম হোসেন ওরফে হাসিব ওরফে আবির ওরফে আদনান ওরফে আবদুলস্নাহকে মৃতু্যদন্ডের পাশাপাশি ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। রায় ঘোষণা উপলক্ষে বৃহস্পতিবার আদালত এলাকায় নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়। কড়া নিরাপত্তার মধ্যে সকাল ১০টার দিকে কারাগার থেকে আদালতে আনা হয় আসামিদের। দুপুর পৌনে ১২টার দিকে তাদের হাজতখানা থেকে আদালতের কাঠগড়ায় নেওয়া হয়। রায়ে বলা হয়, আসামিরা সাংগঠনিকভাবে অভিন্ন অভিপ্রায়ে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশে বাধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে অভিজিৎ রায়কে হত্যা করে। সে কারণে তাদের সর্বোচ্চ শাস্তিই প্রাপ্য। আর অপর আসামি বস্নগার শফিউর রহমান ফারাবীকে রায়ে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে। হত্যাকান্ডে সরাসরি জড়িত না থাকলেও ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে অভিজিৎ রায়কে 'হত্যার প্ররোচনা দিয়েছিলেন' বলে তাকে এ মামলায় আসামি করা হয়। আসামিদের মধ্যে জিয়া ও আকরামকে পলাতক দেখিয়েই এ মামলার বিচার কার্যক্রম চলে। বাকি চার আসামি রায়ের সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন। আইনজীবীরা জানান, ফারাবীকে রায়ের পর কিছুটা বিমর্ষ দেখালেও বাকি তিনজন রায়ের আগে ও পরে ছিল একই রকম 'উৎফুলস্ন ও উদ্ধত'। তাদের একজন দুই আঙুল তুলে 'ভি' চিহ্নও দেখান। দন্ডিত আসামিদের মধ্যে জিয়া, সায়মন ওরফে শাহরিয়ার, আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব, আকরাম হোসেন ওরফে হাসিবকে প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যা মামলার রায়েও মৃতু্যদন্ড দেওয়া হয়েছে। অভিজিৎ হত্যা মামলায় আসামিপক্ষের আইনজীবী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা খায়রুল ইসলাম লিটন ও মো. নজরুল ইসলাম বলেছেন, এ রায়ের বিরুদ্ধে তারা আপিল করবেন। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি গোলাম সারোয়ার খান জাকির বলেছেন, এই রায়ে তারা সন্তুষ্ট। ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রম্নয়ারি রাতে স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে নিয়ে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনে কুপিয়ে হত্যা করা হয় যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী অভিজিৎ রায়কে। চাপাতির আঘাতে আঙুল হারান তার স্ত্রী। নিহত অভিজিৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক অজয় রায়ের ছেলে। ওই বছর বইমেলায় তার লেখা দুটি বই প্রকাশিত হয়। তাই ১৫ ফেব্রম্নয়ারি স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন তিনি। রায় ঘোষণার সময় আদালতে পরিবারের কেউ উপস্থিত ছিলেন না। অভিজিতের স্ত্রী বন্যা আছেন যুক্তরাষ্ট্রে। আর অভিজিতের বাবা ও এ মামলার বাদী অধ্যাপক অজয় রায় ২০১৯ সালের ৯ ডিসেম্বর মারা যান। আর ছেলের মৃতু্যর শোক সইতে না পেরে মাও মারা যান এর বছরখানেক আগে। মামলা ও তদন্ত মুক্তমনা বস্নগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায় নিহতের ঘটনার পর শাহবাগ থানায় এই হত্যা মামলা দায়ের করেন অধ্যাপক অজয় রায়। ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) হাত ঘুরে মামলাটির তদন্তভার কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের হাতে যায়। হত্যাকান্ডের চার বছর পর ২০১৯ সালের ১৩ মার্চ ছয়জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের (সিটিটিসি) পরিদর্শক মনিরুল ইসলাম। অভিযোগের পক্ষে ৩৪ জনকে সাক্ষী করা হয়। ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইবু্যনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমান ওই বছর ১ আগস্ট অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এ মামলায় ছয় আসামির বিচার শুরুর আদেশ দেন। অভিযোগপত্রে নাম থাকা রাষ্ট্রপক্ষের ৩৪ জন সাক্ষীর মধ্যে ২৮ জনের সাক্ষ্যগ্রহণের পর কারাগারে থাকা চার আসামি গত ২৭ জানুয়ারি আদালত নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন। ৩ ফেরুয়ারি রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি গোলাম সারোয়ার খান জাকির আসামিদের মৃতু্যদন্ড চেয়ে যুক্তিতর্ক শেষ করেন। পরদিন আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে মামলাটি রায়ের পর্যায়ে আসে। অভিযোগপত্রে বলা হয়, প্রযুক্তিগত তথ্যের ভিত্তিতে ২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর আসামি আবু সিদ্দিক সোহেলকে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। সোহেল অভিজিৎ হত্যাকান্ডে জড়িত ছিলেন। আদালতে তিনি ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। সোহেলকে প্রটেক্টেড টেক্সট আইডি খুলে দেন চাকরিচু্যত মেজর জিয়া। আদালতে জমা দেওয়া অভিযোগপত্রে এ হত্যাকান্ডে মোট ১২ জন জড়িত থাকার কথা উলেস্নখ করা হয়। তাদের মধ্যে ৫ জনের পূর্ণ নাম ঠিকানা পাওয়া যায়নি। আর আসামিদের মধ্যে মুকুল রানা কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন। ফলে ছয়জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়। এরমধ্যে শফিউর রহমান ফারাবীকে হত্যাকান্ডে প্ররোচনা দেওয়ার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। যেভাবে হত্যাকান্ড হত্যাকান্ডের বিস্তারিত তুলে ধরে আসামি সোহেল আদালতে ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তার জবানবন্দি অনুযায়ী, আসামি আকরাম ও মোজাম্মেল এলিফ্যান্ট রোডে ভাড়া বাসায় থাকতেন। মোজাম্মেল সোহেলকে জানান, অভিজিৎ রায় একজন বড় মাপের নাস্তিক। আকরাম সোহেলকে অভিজিতের ছবি দেখান। ২১ ফেব্রম্নয়ারি সোহেল, আকরাম ও হাসান বইমেলায় যান। মেলার বিভিন্ন স্টলে ঘুরে দেখেন। অভিজিৎ রায়ের বইয়ের প্রকাশক জাগৃতির স্টলে যান। সেখানে তারা অপেক্ষা করেন। তবে অভিজিৎ সেদিন আসেননি। ২২ ফেব্রম্নয়ারি আবার তারা বইমেলায় যান। সেদিন অভিজিৎকে জাগৃতির স্টলের সামনে দেখতে পান। ওইদিন অভিজিৎ বইমেলা থেকে বের হয়ে ধানমন্ডির ২৭ নম্বরের একটি রেস্তোরাঁয় যান। অনুসরণ করে তারাও সেখানে যান। তবে অভিজিৎ সেদিন দ্রম্নত গাড়ি নিয়ে বের হয়ে যান। এরপর ২৪ ফেব্রম্নয়ারি অভিজিতকে অনুসরণ করে তারা ইন্দিরা রোডের একটি বাসায় যান। সেদিন ওই বাসার নিরাপত্তারক্ষীর কাছ থেকে জানতে পারেন, অভিজিৎ এখানে বেড়াতে এসেছেন। পরে মেজর জিয়া সোহেলকে বলেছিলেন, অভিজিৎকে বইমেলায় হত্যা করা হোক। ২৫ ফেব্রম্নয়ারিও তারা বইমেলায় যান। কিন্তু সেদিন অভিজিৎ বইমেলায় আসেননি। ২৬ ফেব্রম্নয়ারি বইমেলায় যাওয়ার পর শুদ্ধস্বরের স্টলের সামনে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেন অভিজিৎ। কিছুক্ষণ পর মোজাম্মেল সোহেলকে জানান, অভিজিৎ বইমেলায় এসেছেন। মেলায় তারা অভিজিৎকে দেখেন। এরপর মোজাম্মেল আকরাম ও হাসানের সঙ্গে কথা বলেন সোহেল। পরে তারা বইমেলা থেকে বের হয়ে টিএসএসির মোড়ে অবস্থান করেন। রাত সাড়ে আটটার দিকে অভিজিৎ বইমেলা থেকে বের হয়ে আসার পর তাদের সংগঠনের চারজন অভিজিৎকে কুপিয়ে হত্যা করেন। আনসার আল ইসলামের অপারেশন শাখার মুকুল রানা, চাকরিচু্যত মেজর জিয়া, সেলিমসহ তাদের সংগঠনের অনেকে সেখানে ছিলেন। আরেক আসামি আরাফাত রহমানের দেওয়া জবানবন্দি অনুযায়ী, সেদিন রাত সাড়ে আটটার দিকে অভিজিৎ ও তার স্ত্রী বইমেলা থেকে বের হয়ে আসতে থাকলে মেজর জিয়া তাকে টিএসসির মোড়ের দিকে যেতে বলেন। আরাফাত ও অন্তু টিএসসির মোড়ের রাজু ভাস্কর্যের কাছে উত্তর-পূর্ব দিকের ফুটপাতের দিকে যান। সেখানে গিয়ে দেখেন, তাদের সহযোগী আলী ও আনিক অভিজিৎকে কোপাচ্ছেন। অভিজিতের স্ত্রী চিৎকার দিলে আনিক তাকে কুপিয়ে আহত করেন। আনিকের চাপাতির কোপ অভিজিতের স্ত্রীর হাতে লাগে। লোকজন জড়ো হলে তারা সেখান থেকে পালিয়ে যান।