মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১
একনেকে ২০ হাজার কোটি টাকার ৯ প্রকল্প অনুমোদন

মহাসড়কে টোল আদায়ের নির্দেশনা দিলেন প্রধানমন্ত্রী

যাযাদি রিপোর্ট
  ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০০:০০
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মঙ্গলবার গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে একনেক সভায় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা দলিলের মোড়ক উন্মোচন করেন -ফোকাস বাংলা

দেশের বড় সড়কগুলোতে টোল আদায়ের নির্দেশনা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিনা পয়সায় সেবার দিন শেষ। এখন থেকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কসহ দেশের বড় সড়কগুলোতে টোল আদায় করা হবে। তিনি বলেন, বিনা পয়সায় সেবা নেওয়ার ধারণা থেকে বেরিয়ে আসা উচিত।

মঙ্গলবার গণভবন থেকে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী ও একনেক চেয়ারপারসন শেখ হাসিনা। গণভবন থেকে প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এবং শেরেবাংলা নগর এনইসি সম্মেলনকক্ষে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও সচিবরা সভায় উপস্থিত ছিলেন। একনেক সভা শেষে প্রকল্পের সার্বিক বিষয়সহ সাংবাদিকদের সামনে প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন তুলে ধরেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।

একনেকে প্রায় ১৯ হাজার ৮৪৪ কোটি ৫৭ লাখ টাকা খরচে ৯টি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সরকার নিজস্ব তহবিল থেকে দেবে ৬ হাজার ৫৯৯ কোটি ৮৮ লাখ টাকা এবং বিদেশি প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেবে ১৩ হাজার ২৪৪ কোটি টাকা। সভা শুরুর আগে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মোড়ক উন্মোচন

\হকরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগামী ৫ বছর (২০২৫ সাল পর্যন্ত) এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে সরকার।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা তুলে ধরে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, তিনি বলেছেন, বিনা পয়সায় সেবার দিন শেষ। আমাদের এমন মনোভাব-সবকিছুর সেবা চাই কিন্তু পয়সা দিতে রাজি না। বিশেষ করে যাদের পকেটে পয়সা আছে, তারা দেয়ই না। এটা আমাদের কালচার। এ থেকে বেরিয়ে আসা উচিত। প্রধানমন্ত্রী চান- বড় সড়ক যেগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে, সেগুলোতে টোল আদায় করা হোক।

মন্ত্রী বলেন, একনেকে সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগের 'সাসেক ঢাকা-সিলেট করিডোর সড়ক উন্নয়ন' প্রকল্পের বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে পুনরায় মহাসড়কে টোল আদায়ের বিষয়টি বলেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য তুলে ধরে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ঢাকা-সিলেটে যে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হবে, সেটি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এগুলো থেকে আমরা টোল আদায় করব। এ ব্যাপারে আবার প্রধানমন্ত্রী বলেছেন। এই টোল আদায় করে শুধু সরকারের রাজস্ব আদায়ের জন্য নয়, যাতে ওই সড়কগুলোর মেরামতে এই টাকা ব্যয় করা যায় সেটিও একটি কারণ।

শেখ হাসিনার আরও নির্দেশনা তুলে ধরে এম এ মান্নান বলেন, 'এই যে সড়ক বানাচ্ছি, যাওয়ার পথে যেন বিশ্রামের জায়গা থাকে। কফি খাওয়ার জায়গা থাকে। একটু বসে হালকা হওয়ার জায়গা থাকে। একটা সুন্দর ওয়াশরুম থাকে। নারীদের চেঞ্জিং রুম ও বসার জায়গা যেন থাকে। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরকে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন যে, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক বা ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে এগুলো করতেই হবে।'

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, 'করোনাভাইরাস প্রতিরোধে বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ টিকা প্রয়োগের ব্যবস্থা না করতে পারলেও বাংলাদেশ এই টিকা এনে দৃষ্টান্ত দেখিয়েছে। আমাদের প্রশাসন থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সশস্ত্রবাহিনী, আমাদের নেতাকর্মীরা সবাই দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। সবার পরিশ্রমেই আমরা করোনাভাইরাসকে কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছি। যে কারণে করোনাভাইরাসের এই মহামারির মধ্যে যখন সারাবিশ্বের অর্থনীতি অচল, উন্নত দেশগুলোও যখন টিকা দিতে পারেনি, আমরা বাংলাদেশে তখন ভ্যাকসিন দিতে পেরেছি এবং একটি দৃষ্টান্ত আমরা দেখাতে পেরেছি।'

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, করোনাভাইরাস কেবল আমাদের ওপর নয়, সারাবিশ্বের ওপরই প্রভাব ফেলেছে। সারাবিশ্বে মহামারি আকারে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশে আমরা আমাদের সীমিত সম্পদ দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ভৌগোলিক সীমারেখায় ছোট হলেও আমাদের দেশ জনসংখ্যার দিক থেকে বড়। সেই দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টার মাধ্যমে আমরা কোভিড-১৯ মোকাবিলাতেও সক্ষম হয়েছি।

তিনি আরও বলেন, 'আমরা করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য যেমন বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছি, তেমনি আর্থিক সংকট থেকে উত্তরণের জন্য প্রণোদনা দিয়েছি। একই সঙ্গে টিকাও নিয়ে এসেছি। অনেক উন্নত দেশও এখনো টিকা দেওয়া শুরু করতে পারেনি। কিন্তু যখন গবেষণা হচ্ছিল, তখন থেকেই এই ভ্যাকসিন কেনার জন্য সব জায়গায় আমরা যোগাযোগ করেছি। আগাম অর্থ দিয়ে আমরা বুকিং রেখেছিলাম, যেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদনের পর ভ্যাকসিন বিক্রি শুরু হলেই আমরা ভ্যাকসিনটা পাই এবং দেশবাসীকে দিতে পারি। আমরা সেটি করতে সক্ষম হয়েছি।'

তিনি এজন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান। দেশবাসীও ধৈর্য ধরেছে। তাদের সহযোগিতার জন্যই আজ তাদের সেবা করার সুযোগ পাচ্ছেন। তারা ভোট দিয়েছিল বলেই ক্ষমতায় আসতে পেরেছেন বলেও তিনি বলেন।

ঘনবসতি বাংলাদেশের একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল উলেস্নখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অনেক উন্নত দেশেরই হয়তো এ চ্যালেঞ্জ ছিল না। তাদের জনসংখ্যা কম, ফলে কাজ করা সহজ। আমরা আমাদের জনসংখ্যার বিষয়টি মাথায় রেখেই পদক্ষেপ নিয়েছি।

পরিকল্পনামন্ত্রী জানান, এক সপ্তাহের মধ্যে পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দরের টোটাল ওয়ার্কপস্ন্যান তৈরি করে জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগামী একনেক পরবর্তী সভায় এই পরিকল্পনা উপস্থাপন করতে হবে। এ বিষয়ে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতেও বলেছেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, হালদা নদীতে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে সতর্ক হতে হবে, যেন মা মাছের কোনো ক্ষতি না হয়। এ বিষয়ে মৎস্যবিজ্ঞানীদের সঙ্গে কাজ করতে হবে। আর নদীগুলোতে ড্রেজিং করতে হলে কাজ শুরু হওয়ার পর শেষ না হওয়া পর্যন্ত যেন কাজ বন্ধ না হয়, সে বিষয়েও সতর্ক থাকা এবং মাঝপথে কাজ বাকি রেখে চলে যাওয়া যাবে না বলেও বলেছেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রীর বরাত দিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, প্রধানমন্ত্রী সোমবারের মন্ত্রিসভার বৈঠক ও মঙ্গলবারের একনেক বৈঠকের জন্য অপেক্ষা করে থাকেন। তবে মন্ত্রিসভার বৈঠকের চেয়ে একনেক বৈঠকের জন্যই বেশি অপেক্ষা করেন। কেননা, এই বৈঠক থেকেই উন্নয়ন প্রকল্পগুলো অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এই বৈঠকেই বাংলাদেশের উন্নয়নসহ আশা-আকাঙ্ক্ষা সবকিছুই নির্ভর করে।

এ দিন একনেক সভায় অনুমোদিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে সংশোধিত প্রকল্প তিনটি এবং নতুন প্রকল্প ছয়টি। সংশোধিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে নৌ-পরিবহণ মন্ত্রণালয়ের 'পায়রা সমুদ্র বন্দরের প্রথম টার্মিনাল এবং আনুষঙ্গিক সুবিধাদি নির্মাণ' প্রকল্পের প্রথম সংশোধন আনা হয়েছে। প্রকল্পটির মূল ব্যয় ছিল ৩ হাজার ৯৮২ কোটি ১০ লাখ টাকা। সংশোধনীতে ৫৩৪ কোটি ৬৫ লাখ টাকা ব্যয় বাড়িয়ে করা হয়েছে ৪ হাজার ৫১৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। প্রকল্পটির মেয়াদও বেড়েছে। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে শুরু হওয়া প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত, এখন সময় বাড়িয়ে করা হয়েছে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত।

তথ্য মন্ত্রণালয়ের 'বাংলাদেশ বেতার, সিলেট কেন্দ্র আধুনিকায়ন ও ডিজিটাল সম্প্রচার যন্ত্রপাতি স্থাপন' প্রকল্পেরও প্রথম সংশোধন আনা হয়েছে। প্রকল্পটির মূল খরচ ছিল ৫৬ কোটি ২২ লাখ টাকা। সংশোধনীতে ৩১ কোটি ৭ লাখ টাকা খরচ বাড়িয়ে ৮৭ কোটি ২৯ লাখ টাকা করা হয়েছে। ২০১৮ সালের জুলাই থেকে শুরু হওয়া প্রকল্পটি ২০২০ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল। দুই বছর বাড়িয়ে প্রকল্পটির মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত।

পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের 'চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী ও রাউজান উপজেলায় হালদা নদীর উভয় তীরের ভাঙন থেকে বিভিন্ন এলাকা রক্ষাকল্পে তীর সংরক্ষণ কাজ' প্রকল্পের দ্বিতীয় সংশোধন অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটির মূল খরচ ছিল ২১২ কোটি ৭ লাখ টাকা। দ্বিতীয় সংশোধনীতে এর খরচ বেড়েছে ১০৫ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। বর্তমানে প্রকল্পের খরচ বেড়ে দাঁড়াল মোট ৩৪৯ কোটি ৭৪ লাখ টাকা।

এদিকে নতুন অনুমোদন দেওয়া ছয়টি প্রকল্পের মধ্যে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের 'বিটিসিএলের ইন্টারনেট প্রটোকল (আইপি) নেটওয়ার্ক উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ' প্রকল্প। এতে খরচ হবে ৯৪৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা। ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৩ সালের জুন মেয়াদে বাস্তবায়ন করা হবে।

সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগের 'সাসেক ঢাকা-সিলেট করিডোর সড়ক উন্নয়ন' প্রকল্পটি ১৬ হাজার ৯১৮ কোটি ৫৯ লাখ টাকা খরচে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এতে সরকার দেবে ৩ হাজার ৬৭৩ কোটি ৯০ লাখ এবং এডিবি ঋণ দেবে ১৩ হাজার ২৪৪ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৬ সালের ডিসেম্বর মেয়াদে বাস্তবায়ন করা হবে।

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের 'পশ্চিম গোপালগঞ্জ সমন্বিত পানি ব্যবস্থাপনা (প্রথম পর্যায়)' প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ১৩৫ কোটি ৫১ লাখ টাকা খরচে প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মেয়াদে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে।

এ মন্ত্রণালয়ের 'ভোলা জেলার দৌলতখান উপজেলাধীন দৌলতখান পৌরসভা ও চকিঘাট এবং অন্যান্য অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা মেঘনা নদীর ভাঙন হতে রক্ষা' প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এতে খরচ করা হবে ৫২২ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মেয়াদে বাস্তবায়ন করা হবে।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের 'অনাবাদি পতিত জমি ও বসতবাড়ির আঙ্গিনায় পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপন' প্রকল্পটি ৪৩৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকা খরচে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে।

পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা তৈরির দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম বলেন, এর আগে পরিকল্পনা অনুমোদন দিয়েছিল জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (এনইসি)। এখন বই আকারে পরিকল্পনাটির মোড়ক উন্মোচন করার মধ্য দিয়ে পূর্ণতা পেল।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে